এই মুহূর্তে মোহামেদ সালাহর মুখোমুখি হতে চাইছেন না কেউই, এমনকি অনুশীলনে তাঁর সতীর্থরাও না! রোমার বিপক্ষে সেমিফাইনালের প্রথম লেগে ৫-২ গোলে জয়ের পর সালাহর লিভারপুল সতীর্থ ট্রেন্ট অ্যালেকজান্ডার আর্নল্ড স্বীকার করেছেন, তারা এখন অনুশীলনেও সালাহর মুখোমুখি হতে চান না। অনুশীলনে সতীর্থদেরও যে এভাবেই ‘হেনস্তা’ করেন সালাহ!
আর্নল্ডের ভাষ্যমতে, ‘ওর মুখোমুখি হওয়াটা একটা দুঃস্বপ্ন। কোন কোন সময় ওকে আমার ভালো লাগে না। আমাকেও যে ওভাবে বল পায়ে নাচায় ও!’
শুধু আর্নল্ড নন, বর্তমান বিশ্বের কোন ডিফেন্ডারেরই সালাহকে পছন্দ হওয়ার কথা নয়। জাদুকরী ফুটবল দিয়ে যে ডিফেন্ডারদের রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছেন তিনি। লিভারপুলের হয়ে কাটাচ্ছেন স্বপ্নের এক মৌসুম।
ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগের খেলোয়াড়দের ভোটে এরই মধ্যে পিএফএ বর্ষসেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছেন। অনেকের মতে, এবার ব্যালন জয়ের দৌড়েও সবচেয়ে এগিয়ে আছেন সালাহই।
লিভারপুল কিংবদন্তি স্টিভেন জেরার্ড গত সপ্তাহে বিটি স্পোর্টকে জানিয়েছেন, ‘সালাহকে মেসি-রোনালদোর সাথে তুলনা করা বৃথা, কারণ ওরা দুজনে বছরের পর বছর ধরে এই জিনিসগুলো ধারাবাহিকভাবে করে আসছে। তবে এই কথা বিন্দুমাত্র কোন সন্দেহ ছাড়াই বলে দেয়া যায়, ঠিক এই মুহূর্তে সালাহই বর্তমান বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়।’
মোটামুটি মাঝারি মানের এক দল নিয়ে লীগ ও কাপ জয় করেছেন মেসি, আর রোনালদো আছেন টানা তৃতীয় চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জয়ের মিশনে, নিজে ১২ ম্যাচেই করেছেন ১৫ গোল। তারপরেও দুজনের সাথেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো অবস্থায় আছেন সালাহ।
গত মঙ্গলবার গাজেত্তা দেল্লো স্পোর্টকে রোমা গোলকিপার অ্যালিসন বলেছেন, ‘আমি যাদের বিপক্ষে খেলেছি তাদের মধ্যে মেসিই সেরা। কিন্তু এই মুহূর্তে সালাহকেও মেসির মতোই ভয় পেতে হচ্ছে। যে রকম মৌসুম কাটাচ্ছে এবার, ও এবার ব্যালন জয়ের অন্যতম বড় দাবিদার হবে।’
পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে মেসির পাশাপাশিই রাখতে হবে সালাহকে। ইউরোপিয়ান গোল্ডেন শু জয়ের লড়াইয়ে দুজনের মধ্যে চলছে ইদুর দৌড় খেলা, এই মুহূর্তে মেসির চেয়ে সালাহ পিছিয়ে আছেন মাত্র এক গোলে। ৩৮ ম্যাচের প্রিমিয়ার লীগে সর্বোচ্চ ৩১ গোলের রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলেছেন মাত্র ৩৪ ম্যাচ খেলেই।
আবার এখনো পর্যন্ত অপরাজিত থেকে বার্সার লীগ জেতার পেছনে মেসির সর্বময় ভূমিকার কথাও অস্বীকার করা যায় না। লীগে শুধু সর্বোচ্চ গোলই করেননি, সবচেয়ে বেশি অ্যাসিস্ট (১২) ও সবচেয়ে বেশি চান্স ক্রিয়েটও করেছেন তিনিই (৮২)।
নয়টি স্প্যানিশ লীগ জিতে কিংবদন্তি আলফ্রেডো ডি স্টেফানোকে ছাড়িয়ে গেলেও চ্যাম্পিয়ন্স লীগের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বাদ পড়ে যাওয়াটা মেসির জন্যে হতে পারে মাইনাস পয়েন্ট। কারণ ব্যালন জয়ের পথে চ্যাম্পিয়ন্স লীগের পারফরম্যান্স বরাবরই একটি বড় নির্ধারক হিসেবে কাজ করে এসেছে। কারণ কিছুটা অদ্ভুত শোনালেও সত্যি, এখন মৌসুম ব্যাপী লীগের পারফরম্যান্সের চেয়ে কাপ ভিত্তিক চ্যাম্পিয়ন্স লীগের পারফরম্যান্সই গুরুত্ব পাচ্ছে সবার কাছে।
মাদ্রিদ অধিনায়ক সার্জিও রামোস এরই মধ্যে জানিয়েছেন, ‘বার্সেলোনা মৌসুমে দুটি শিরোপা জিতেছে ঠিকই, কিন্তু চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জয় ওই দুই শিরোপা জয়ের সমান, কিংবা তার চেয়েও বেশি কিছু।’
সাম্প্রতিক সময়ের ব্যালন জয়ের ইতিহাস দেখলে রামোসের কথাকেই সত্য বলে ধরে নিতে হয়। গত দশ বছরে চ্যাম্পিয়ন্স লীগ না জিতে ব্যালন জয়ের ঘটনা ঘটেছে মাত্র তিনবার- ২০১০ ও ২০১২ তে মেসি, এবং ২০১৩ তে রোনালদো।
কিন্তু ব্যতিক্রমও আছে। চ্যাম্পিয়ন্স লীগ সহ ট্রেবল জিতেও ২০১০ সালে ওয়েসলি স্নাইডার ও ২০১৩ সালে ফ্রাঙ্ক রিবেরি ব্যালন জয়ের মুকুট মাথায় পড়তে পারেননি। ২০১০ সালে ইন্টারের হয়ে ট্রেবল জিতেছিলেন স্নাইডার, এমনকি নেদারল্যান্ডসকে নিয়ে গিয়েছিলেন বিশ্বকাপের ফাইনাল পর্যন্তও। কিন্তু মেসির অবিশ্বাস্য ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের কাছে পাত্তা পায়নি স্নাইডারের অর্জন। রিবেরির দুর্ভাগ্যও অনেকটা একই রকম। বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে ট্রেবল জিতলেও রোনালদোকে ছাড়াতে পারেননি, এমনকি মেসিকে হটিয়ে দ্বিতীয় স্থানটিও পাননি। অথচ মাদ্রিদের হয়ে ওই মৌসুমে একটি শিরোপাও না জেতা রোনালদো কেবল ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের জোরেই জিতে যান ব্যালন।
তবে এবার চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জিততে পারলে ট্রফির সাথে ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স দুটোই যোগ হবে রোনালদোর প্লাস পয়েন্ট হিসেবে। তবে একই কথা কিন্তু সালাহর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সালাহর দলও দাঁড়িয়ে আছে চ্যাম্পিয়ন্স লীগ জয়ের দ্বারপ্রান্তে, চ্যাম্পিয়ন্স লীগে রোনালদোর চেয়ে ৫ গোল কম করলেও লীগে সালাহর পারফরম্যান্স রোনালদোর চেয়ে ভালো।
তবে এতক্ষণের আলোচনায় না থাকা নেইমার কিন্তু সব হিসাব উল্টে দিতে পারেন স্রেফ বিশ্বকাপের পারফরম্যান্স দিয়ে। বাছাইপর্ব থেকেই দুর্দান্ত দলীয় সমন্বয় দেখিয়ে যাচ্ছে তিতের ব্রাজিল, রাশিয়া বিশ্বকাপের অন্যতম ফেভারিটও মানা হচ্ছে নেইমারের ব্রাজিলকে। রাশিয়ায় যদি ব্রাজিলকে ষষ্ঠ শিরোপা এনে দিতে পারেন ব্রাজিলের পোস্টার বয়, নিশ্চিতভাবেই তাহলে ব্যালনের হিসাব উল্টে যাবে আবারো। দেখাই যাক কী হয়!