মস্তিষ্ক একটি অত্যন্ত জটিল অঙ্গ যা শরীরের বিভিন্ন অংশের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। যদি কারো ‘স্ট্রোক’ ঘটে; তখন রক্ত প্রবাহ অঞ্চলের কোন নির্দিষ্ট অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও ক্ষতিগ্রস্ত অংশটি শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ~ আমেরিকান স্ট্রোক এসোসিয়েশন।
স্ট্রোক হল সমগ্র বিশ্বে মহিলাদের মৃত্যুর তৃতীয় সর্ববৃহৎ কারণ – সামগ্রিক জনসংখ্যার মধ্যে পঞ্চম – এবং যুক্তরাষ্ট্রের বহু নাগরিকের অক্ষমতার একটি প্রধান কারণ। স্ট্রোক তখনই ঘটে যখন মস্তিষ্কে অক্সিজেন এবং পুষ্টির বহনকারী দেহ কোষের গতি রক্ত জমাট বাঁধার কারণে আটকে যায় অথবা রক্ত ও পুষ্টি বাহী নালী ফেটে যায়। যখন এই ধরণের ঘটনা ঘটে তখন মস্তিষ্কের অংশগুলি প্রয়োজনীয় অক্সিজেন গ্রহণ করতে পারে না – ফলাফল কোষগুলি মরতে শুরু করে।
তিন ধরনের স্ট্রোক আছে: আস্কেমিক স্ট্রোক, হেমোরেজিক স্ট্রোক, ও ট্র্যান্সিয়াল আস্কেমিক অ্যাটাক-টি আই এ [transient ischemic attack (TIA)] । আস্কেমিক স্ট্রোক রক্ত জমাট বাঁধার কারণে সৃষ্ট হয়; রক্ত প্রবাহী শিরা ফেটে যাবার ফলে হেমোরেজিক স্ট্রোক ঘটে, এবং ট্র্যান্সিয়াল আস্কেমিক অ্যাটাক- টিআইএ তখন ঘটে যখন রক্তের স্বাভাবিক প্রবাহ এক বা একাধিক মস্তিষ্কের অঞ্চলে বাধাপ্রাপ্ত হয়। সাধারনত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অস্থায়ী জমাট বাঁধা রক্ত যাকে ব্লাড ক্লট বলে তাই টিআইএ ঘটার প্রধান কারণ। টিআইএ – চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষা হলেও সাধারণের মাঝে শারীরিক এই অবস্থাকে “মিনি স্ট্রোক” হিসাবে উল্লেখ করা হয় – প্রথম অবস্থায় বা একবার মিনি স্ট্রোক ঘটলে একে বিপজ্জনক হিসেবে গণ্য করা না হলেও সচেতনতা অতি আবশ্যক। কারণ মিনি স্ট্রোক-ই পরবর্তীতে পূর্ণাঙ্গ স্ট্রোক এর রূপ ধারণ করে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের অভিমত প্রায় ৮০% শতাংশ সময় স্ট্রোক প্রতিরোধ করা যায়। অন্যান্য ক্ষেত্রে বড় ধরণের স্ট্রোক প্রতিরোধ করার একমাত্র চাবি কাঠি হিসাবে সচেতনতা কথা বলা হয়েছে। বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য আরেকটি ব্যপার হচ্ছে, বেশিরভাগ সময় মহিলাদের স্ট্রোকের উপসর্গ সাধারন চোখে ধরা পড়ে না। কারণ হিসেবে জানা যায় ভিন্ন ভিন্ন নারীর স্ট্রোকের ভিন্ন ভিন্ন লক্ষণ প্রকাশ পায়। যে কারণে পরিসংখ্যানের ক্ষেত্রে স্ট্রোকে আক্রান্ত পুরুষের সংখ্যা নির্দিষ্ট করা গেলেও স্ট্রোকে আক্রান্ত নারীর সংখ্যা সহজে জানা যায় না।
এখানে স্ট্রোক ঘটার ১৫ টি সম্ভাব্য লক্ষণ তুলে ধরা হলো যা মোটেও উপেক্ষা করা উচিৎ নয়:
অটো ইমমিউনি ডিজিজঃ
স্পেনের গবেষকরা দেখিয়েছেন যে নারীরা অটোইমিউন রোগে অধিক আক্রান্ত হওয়ার তাদের হৃদরোগ ও স্ট্রোকে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি বেশি। গবেষণায় আরও দেখানো হয়েছে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের ঝুঁকিও বেড়ে যায়।
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাঃ
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা এবং স্ট্রোক এর মধ্যে সংযোগ এখনও পুরোপুরি পরিষ্কার নয়। তবে, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা উচ্চতর অ্যামিগডালা কার্যকলাপের মাঝে স্ট্রোকের উচ্চ ঝুঁকি খুঁজে পেয়েছেন।
অনিয়মিত হৃদস্পন্দনঃ
শরীরের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গে অক্সিজেন-সমৃদ্ধ রক্ত সরবরাহের জন্য দেহের যে অংশটি পাওয়ার হাউস হিসেবে কাজ করে তার নাম ‘হৃৎপিণ্ড’। এই হৃৎপিণ্ডেই আসে যখন অমোঘ আঘাত তখন তাকে আমরা স্ট্রোক বলি। অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন স্ট্রোকের উচ্চ ঝুঁকির লক্ষণ হিসাবে স্বীকৃত। অস্ট্রেলিয়ার স্ট্রোক ফাউন্ডেশন ‘অ্যাট্রায়াল ফাইব্রিলেশন’ নামক লক্ষণকে- স্ট্রোকের ঝুঁকিপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসাবে চিহ্নিত করেন।
নারীদের নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে মাসিক বা হরমোন জনিত সমস্যাঃ
গবেষণায় বলা হয় যে মেয়ে শিশুদের ১০ বছর বয়স হবার পূর্বে মাসিক হলে এবং নারীদের ৪৫ বছর বয়সের আগে মাসিক ও হরমোন জনিত সমস্যা স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
দৃষ্টি বিভ্রমঃ
দৃষ্টি বিভ্রম বা ভুল দেখা স্ট্রোক হবার একটি সার্বজনীন লক্ষণ। বিশেষ করে ভ্রান্তির শিকার বেশি হয়। যাইহোক, যদি আপনি এমন কিছু দেখতে পান যা আপনার যৌক্তিক মস্তিষ্ক জানে যৌক্তিক নয়, নির্দ্বিধায় হাসপাতালের জরুরী বিভাগে কল করুন ও যত দ্রুত সম্ভব অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
মানসিক ও ব্যবহারিক পরিবর্তনঃ
ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগান এর গবেষকদের মতে, মহিলাদের মানসিক অবস্থা ও ব্যবহারের পরিবর্তন খুবই দ্রুত হয় ও এই ব্যপারে তারা কারো সাথেই আলাপ করতে আগ্রহী নয়। কিন্তু এই নারীদেরই হৃদরোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা খুব বেশি । এটি কিন্তু মস্তিষ্ক জনিত সমস্যা, ব্যক্তিত্বের পরিবর্তনের জন্য মস্তিষ্ক দায়ী। মেজাজ পরিবর্তন সম্পর্কে আজই ডাক্তারের সাথে কথা বলুন – এটি আপনার জীবন বাঁচাতে পারে।
জ্ঞান হারানো বা মূর্ছা যাওয়াঃ
আগেই বলেছি মানব দেহের সবচেয়ে জটিল ও সংবেদনশীল অঙ্গটি হচ্ছে মস্তিষ্ক। আর এই মস্তিস্কের উপরেই অবস্থান করছে ব্রেইনস্টেম। তাই মস্তিস্কের এই অংশে কোন ভাবে যদি রক্ত প্রবাহ বাঁধা প্রাপ্ত হয় (ব্লাড ক্লটের মাধ্যমে) তাহলে মানুষ জ্ঞান হারায়। ঘন ঘন জ্ঞান হারানো হতে পারে স্ট্রোকের লক্ষণ। বিশেষত মহিলাদের ক্ষেত্রে ঘন ঘন মূর্ছা যাবার ঘটনাটি বেশি ঘটে। নারীদের কিন্তু এই ঘটনার প্রেক্ষিতে স্ট্রোকের মত দুর্ঘটনা ঘটে। জ্ঞান হারানোর মাধ্যমে স্ট্রোকের শিকার নারীদের চেয়ে পুরুষরাই বেশি হয়। তাই জ্ঞান হারানোকে হালকা ভাবে না নিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
জন্ম নিয়ন্ত্রন অথবা হরমোন রিপ্লেসমেন্টঃ
হরমোন প্রতিস্থাপন থেরাপি (এইচআরটি) এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল এর অধিক সেবন স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়। আমেরিকান স্ট্রোক এসোসিয়েশন মতানুসারে, “জন্ম নিয়ন্ত্রন পিল এর সেবন আপনার স্ট্রোক হবার সম্ভাবনাকে দ্বিগুণ করে তুলে।” জন্ম নিয়ন্ত্রণ পিল গ্রহণ অথবা হরমোন রিপ্লেসমেন্ট পদ্ধতি অনুসরণ করার পূর্বে অভিজ্ঞ চিকিৎসক কর্তৃক আপনার সুস্থ রক্তচাপের মাত্রা সম্পর্কে নিশ্চিত হোন।
কথা অস্পষ্ট হওয়া অথবা জড়িয়ে যাওয়াঃ
পুরুষ ও নারী উভয়ের ক্ষেত্রেই এই লক্ষণটি সুস্পষ্ট ভাবে জানা যায়। আপনার কথা যদি জিবের সাথে জড়িয়ে যায় বা অস্পষ্ট হয়ে আসে। তবে মুহূর্তেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। কারণ এটি স্ট্রোকের অনেক বড় একটি লক্ষণ। এই রকম মুহূর্তে কখনোই নিজের শরীরকে নিয়ে হেলাফেলা করবেন না।
বমি- বমি ভাব ও বমি হওয়াঃ
মস্তিস্কে রক্ত প্রবাহকারী শিরা যখন ফুলে যায় তখন তা লঘু মস্তিস্কে চাপের সৃষ্টি করে যা বমি বমি ভাবের সৃষ্টি করে। হেমোরেজ টাইপের স্ট্রোক এই ধরণের লক্ষণ প্রকাশ করে। যদি এমন ঘটনা আপনার সাথে ঘটে তবে অবিলম্বে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।
শ্বাস নিতে সমস্যা অনুভূত হওয়াঃ
আপনার যদি কোন মুহূর্তে মনে হয় শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছে, তবে অবিলম্বে হাসপাতালে যান। কারণ বিলম্বিত শ্বাস প্রশ্বাস স্ট্রোকের লক্ষণ।
মেডিক্যাল হিস্টোরি অফ মিসক্যারেজঃ
আবার ফিরে আসি নারীদের ঘটনায়, যদি কোন নারীর মিসক্যারেজ এর পূর্ব ইতিহাস থাকে তবে তাদের হৃৎপিণ্ডের দেহ কোষে বা মস্তিস্কে রক্ত জমাট বাধার ঝুঁকি বেড়ে যায়। ফলাফল স্ট্রোক। এই কথা উল্লেখ করেন ওয়েক ইউনিভার্সিটির স্নায়ু ও নিউরো সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডঃ সেরিল বুশনেল।
হরমোনের ভারসাম্যহীনতাঃ
হরমোনের ভারসাম্যহীনতা বিশেষত লো ডিএইচইএ স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।
অরা মাইগ্রেইনঃ
মাইগ্রেইন, বিশেষত চক্ষু ব্যাধি (অরুস), স্ট্রোকের জন্য একটি ঝুঁকিপূর্ণ ফ্যাক্টর। এই ক্ষতিকারক মাথাব্যথা মস্তিস্কের রক্তবাহী শিরার উপর চাপ সৃষ্টি করে, যা মস্তিষ্কের অক্সিজেন সরবরাহের উপর প্রভাব ফেলতে পারে, ফলে স্ট্রোকের ঝুঁকি আরও বৃদ্ধি পায়।
স্ট্রোকের প্রতিরোধঃ
প্রতিরোধ সবচেয়ে বড় প্রতিষেধক। ‘স্ট্রোক’ অবশ্যই বড় ধরণের মেডিক্যাল ইমারজেন্সি। চলুন জানি হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের সৌজন্যে স্ট্রোক কে প্রতিরোধ করার ৭টি উপায়ঃ-
নিয়মিত ব্যায়াম করুন
ওজন নিয়ন্ত্রনে রাখুন
আপনার রক্তচাপ এর প্রতি দৃষ্টি রাখুন
‘অ্যাট্রায়াল ফাইব্রিলেশন (অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন) এর চিকিৎসা করুন
পরিমিত/কম চিনি খান
ধুমপান ত্যাগ করুন
ন্যাশনাল স্ট্রোক এসোসিয়েশন একটি সম্ভাব্য স্ট্রোক সনাক্তকরণের জন্য ‘এফ-এ-এস-টি’ কৌশলকে ব্যাখ্যা করে:
– (F)ace : মুখের একপাশ কি অজান্তেই হেলে পড়ে?
– (A) rms: মাথার উপরে দুই হাত তুলুন। হাত কি নিজের অজান্তেই খসে পড়ে?
– (S) peech: টানা কথা বলতে কি কষ্ট হয়? কথা বলার সময় কি মুখে শব্দ জড়িয়ে যায়?
– (T) ime: অবিলম্বে জরুরী চিকিৎসা সেবায় কল করুন যদি আপনি বা অন্য কেউ এই এক বা একাধিক লক্ষণ দেখতে পান।
স্বাস্থ্য এক অমূল্য সম্পদ। নিজের স্বাস্থ্যের যত্ন নিন, জীবনকে উপভোগ করুন। আজ এই পর্যন্তই; অচিরে ফিরবো নতুন কোন লেখা নিয়ে ততদিন ‘প্রিয়লেখার’ সাথেই থাকুন।