দেশপ্রেমিক ও বিপ্লবী নেতাদের নাম উঠলে একদম উপরের সারিতেই থাকবে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের নাম। ১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার ওড়িশ্যায় জন্মগ্রহণ করেন নেতাজী। ১৯০২ সালের জানুয়ারিতে ভাই বোনদের সাথে প্রোটেস্টেন্ট ইউরোপিয়ান স্কুলে ভর্তি হন তিনি। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ. পাশ করেন। ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশ নেবেন, বাবার কাছে এই প্রতিজ্ঞা করে ১৯১৯ সালে কেমব্রিজে পড়তে যান তিনি। পরবর্তীতে দেশে ফিরে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন তিনি। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। সেই নেতাজীর কম জানা কিছু তথ্য দিয়েই সাজানো হয়েছে আজকের প্রিয়লেখার আয়োজন।
‘দেশপ্রেমিকদেরও দেশপ্রেমিক’:
মহাত্মা গান্ধী ও নেতাজীর আন্দোলন পন্থা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। গান্ধী যেখানে অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে ইংরেজদের দেশ থেকে বিতাড়িত করতে চেয়েছেন, নেতাজী সেখানে পক্ষ নিয়েছেন সশস্ত্র আন্দোলনের। আন্দোলনের পদ্ধতি ভিন্ন হলেও নেতাজীর প্রতি শ্রদ্ধার কমতি ছিল না গান্ধীজীর। তাইতো নেতাজীকে ‘দেশপ্রেমিকদেরও দেশপ্রেমিক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন তিনি। ভারতের স্বাধীনতার স্বার্থে নিজেকে পুরোপুরি নিবেদিত করে দিয়েছিলেন বলেই এই নাম দিয়েছিলেন গান্ধীজী। আজ অব্দি দেশপ্রেমিকের আদর্শ হিসেবে হাজার হাজার তরুণের সামনে তুলে ধরা হয় নেতাজীর উদাহরণ। এমনকি কংগ্রেসে তাঁর অনেক প্রতিপক্ষও তাঁকে প্রকৃত দেশপ্রেমিক বলে শ্রদ্ধা করতেন।
শত্রুর শত্রুকে বানিয়েছেন বন্ধু:
যুদ্ধের একটা কমন পলিসি আছে, ‘শত্রুর শত্রু তোমার বন্ধু’। নেতাজীও এই পলিসিই অনুসরণ করেছেন। নেতাজী যখন বুঝলেন ইংরেজদের সহজে ভারত ছাড়া করা যাবে না, তখন তিনি ইংরেজদের শত্রুদের সাহায্য নেয়ার পরিকল্পনা করলেন। জার্মানি ও জাপানের সাথে হাত মেলালেন তিনি। জাপানের সহায়তায়ই তিনি ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ গঠন করেন, যেটি পরবর্তীতে ইংরেজদের মোকাবেলা করেছিল। জাপানিজ আর্মিদের সাথে নিয়েই তিনি আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে স্বাধীন করেন, এরপর মণিপুরও স্বাধীন করতে এসেছিলেন। কিন্তু ততদিনে জাপানিজ আর্মি দুর্বল হয়ে পড়ে, এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে জাপান নিজেদের প্রত্যাহার করে নিলে আজাদ হিন্দ ফৌজ পিছু হটতে বাধ্য হয়।
গভর্নর জেনারেলের বিপক্ষে গিয়েছেন:
নেতাজীর সাহসের ছোট্ট একটি নমুনা এই ঘটনাটি। একবার গভর্নর জেনারেলের সাথে দেখা করতে নেতাজী তাঁর অফিসে গিয়েছেন, সাথে হাতে ছাতা ঝুলিয়ে। হাতে ছাতা ঝুলিয়ে নিয়ে আসার জন্য গভর্নর জেনারেল তাঁকে তিরস্কার করলে নেতাজী ছাতাটা গভর্নর জেনারেলের কাঁধে ঝুলিয়ে তাঁকে সংযত ব্যবহার করার পরামর্শ দেন!
হিটলারের সাহায্য নিতে জার্মানি গিয়েছিলেন:
১৯৪১ সালে গ্রেফতারের হাত থেকে বাঁচতে গাড়ি দিয়ে প্রথমে কলকাতা থেকে গোমো যান, এরপর ট্রেনে করে পেশাওয়ার। সেখান থেকে কাবুল হয়ে জার্মানি পৌঁছান অ্যাডলফ হিটলারের কাছে, উদ্দেশ্য ভারতের স্বাধীনতার জন্য সাহায্য চাওয়া। হিটলারের অফিসের বাইরে তাঁকে অপেক্ষা করতে বলা হয়। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর হিটলার বের হলেন, কিন্তু নেতাজীর সাথে কথা বললেন না। নেতাজী তাঁর সামনে দিয়ে হেঁটে গেছেন, কিন্তু হিটলার ইচ্ছা করে তাঁকে দেখেও না দেখার ভান করলেন। বার কয়েক এরকম ঘটার পর অবশেষে নেতাজীর কাছে গিয়ে হিটলার তাঁর কাঁধে হাত রাখলেন। নেতাজী তখন সংবাদপত্র পড়ায় এতটাই ব্যস্ত ছিলেন, মুখ তুলে দেখারও প্রয়োজন বোধ করলেন না, কিছুক্ষণ পর তিনি বলে উঠলেন, ‘হিটলার’। হিটলার অবাক হয়ে বললেন, কিভাবে এত নিশ্চিত হলে এটা আমিই? নেতাজী জবাব দিলেন, ‘কেবল আসল হিটলারেরই স্পর্ধা হতে পারে আমার কাঁধে হাত রাখার।’ নিজের শত্রুদের বোকা বানানোর জন্য হিটলার অনেককে হুবহু নিজের মত করে সাজিয়ে রাখতেন। কিন্তু নেতাজী ঠিকই আসল হিটলারকে চিনতে পেরেছিলেন।
নেতাজীর পরিবার:
১৮৯৭ সালে জনাকী নাথ বোস ও প্রভাবতী বোসের ঘরে জন্ম নেতাজীর। নেতাজীরা ছিলেন মোট ১৪ ভাইবোন। তিনি বিয়ে করেছিলেন এক সুন্দরী অস্ট্রিয়ান নারীকে, নাম এমিল শিনকেন। নেতাজীর মেয়ের নাম অনিতা বোস, যিনি পরবর্তীতে জার্মানিতে একজন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ হিসেবে সুনাম কুড়ান।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর জনক:
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসকে বলা হয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর জনক। কারণ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য তিনি যেই আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেছিলেন, সেটিই ছিল ভারতের প্রথম সশস্ত্র বাহিনী। তাঁর বিখ্যাত স্লোগান ‘তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব’ আজও বিপ্লবীদের শরীরে টগবগে প্রেরণা যোগায়। বার্লিন রেডিও থেকে নিয়মিত তিনি বিপ্লবীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতেন।
ভারতীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় চতুর্থ হয়েছিলেন:
কেমব্রিজে পড়তে যাওয়ার আগে বাবাকে কথা দিয়ে গিয়েছিলেন, সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় বসবেন। সেই কথা শুধু পূরণই করেননি, মেধা তালিকায় একেবারে চতুর্থ স্থান দখল করে পূরণ করেছিলেন! কিন্তু তিনি এতে খুশি হননি, কারণ যেই সরকারকে পছন্দ করতেন না, সেই সরকারের হয়ে কাজ করতে হবে ভেবে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিলেন না। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড তাঁর মনে একটা গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল, শেষে ১৯২১ সালে তিনি আইসিএস থেকে পদত্যাগ করেন।
দশবারের বেশি কারাবরণ করেছেন:
১৯২১-৪১ এই বিশ বছরের মধ্যে তিনি দশ বারেরও বেশি জেলে গিয়েছেন। অবশেষে ১৯৪১ সালে পালিয়ে তিনি জার্মানি চলে যান।
সাবমেরিনে ভ্রমণ:
১৯৪২ সালে হিটলার নেতাজীকে সাবমেরিন জোগাড় করে দেয়ার প্রস্তাব দেন। নেতাজী দুটি সাবমেরিনে করে জার্মানি থেকে মাদাগাস্কার ভ্রমণ করেছিলেন। এই যাত্রা ছিল খুবই ভয়ংকর। কথিত আছে, এই যাত্রার আগে তিনি তাঁর স্ত্রী-কন্যার কাছ থেকে শেষ বিদায় নিয়ে গিয়েছিলেন।
‘জয় হিন্দ’ স্লোগানের প্রবক্তা:
ভারতের বিখ্যাত স্লোগান ‘জয় হিন্দ’ এর প্রবক্তা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস।
ভারতরত্ন অস্বীকার:
ভারত সরকার নেতাজীকে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ‘ভারতরত্ন’ দেয়ার প্রস্তাব করেছিল, কিন্তু নেতাজীর পরিবার তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। কারণ এই ‘ভারতরত্ন’ দেয়া হবে মরণোত্তর পদক হিসেবে, কিন্তু তাঁর পরিবারের সদস্যরা চাইছিলেন নেতাজীর মৃত্যু রহস্যের পূর্নাঙ্গ তদন্ত শেষ করতে।