সোশ্যাল মিডিয়ার বিপ্লবে যখন মোহিত বিশ্ববাসী, তখন নিজের অজান্তেই আপনার ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা হচ্ছে না তো হুমকির সম্মুখীন? এই প্রশ্নে এখন জর্জরিত প্রযুক্তি বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক মিডিয়া। সোশ্যাল মিডিয়া হিসেবে বিশ্বে সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত প্ল্যাটফর্মের নাম ফেইসবুক। প্রতিনিয়ত যার আপডেটে ব্যতিব্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো কিছুদিন আগেও ব্যবহারকারীরা ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে নিজেদের ভবিষ্যৎকে পুঁজি করা এফ-কমার্স ইন্ডাস্ট্রি। ব্যবহারকারীদের আশ্বস্ত করতে ফেইসবুক কর্তৃপক্ষ ও মার্ক জুকারবার্গ ঘোষণা দিয়েছিলেন ফেইসবুক পরিবার ও বন্ধুদের সাথে যোগাযোগের ব্যাপারকে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে ব্যাবসায়িক লাভের তুলনায়। এসবই কি শুধু ছিল আইওয়াশ!
এসব প্রশ্ন তুলছে এখন আন্তর্জাতিক মিডিয়া। কারণ ফেইসবুক এর বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত নজরদারি ও ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষণ করে তা বিভিন্ন উৎসের কাছে অর্থের বিনিময়ে বিক্রয় করার গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির ভূতপূর্ব এজেন্ট সোশ্যাল হিরো খ্যাত এডওয়ার্ড স্নোডেন। ১৭ মার্চ শনিবারে টুইটারে একটি টুইটের মাধ্যমে স্নোডেন ফেইসবুক কর্তৃপক্ষ সহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ার অভিযোগ করেন। ঘটনার প্রেক্ষাপট হিসেবে উঠে এসেছে ফেইসবুক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা নামক তথ্য বিশ্লেষণী সংস্থাকে বরখাস্ত করার বিষয়টি। ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা নামক সংস্থাটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় ফেইসবুক ব্যবহার করে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছিলেন।
ফেইসবুক কর্তৃপক্ষ বিগত শুক্রবার ১৬ মার্চ ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে তারা গ্রাহকদের তথ্য বিশ্লেষণ করার দায়িত্বে নিয়োজিত থেকেও তথ্য বিশ্লেষণ করার পড়ার সেই তথ্য না মুছে সংরক্ষণ করে পরবর্তীতে সেই সকল তথ্যের অপব্যবহার করে । এই অপব্যবহারের শিকার হয় প্রায় ১০ লক্ষ ফেইসবুক ব্যবহারকারী। ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা তাদের নিজস্ব অ্যাপের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সেই তথ্য সমূহ ব্যবহার করে।
কিন্তু এডওয়ার্ড স্নোডেন ফেইসবুক কর্তৃপক্ষকে অসহায় প্রতারনার শিকার না বলে ব্যক্তিগত তথ্য সংক্রান্ত প্রতারনায় সহযোগী বলে অভিযুক্ত করেছেন।
শনিবার ১৭ মার্চ ক্যামব্রিজের বিশ্লেষকেরা কোনও ভুল স্বীকার না করে একটি বিবৃতি প্রদান করে বলেছে যে তারা ফেইসবুকের পরিষেবার শর্তাবলী অনুযায়ী তাদের দায়িত্ব সম্পন্ন করেছে।
সিনেট জুডিসিয়ারি কমিটির সামনে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য ফেইসবুকের সিইও মার্ক জুকারবার্গকে তলব করেছেন আইন প্রণেতা সেন এ্যামি ক্লোবুরার, ডি-মিন।
ট্রাম্প প্রচারাভিযান এবং রাশিয়ার মধ্যে সম্ভাব্য সংঘর্ষের তদন্ত করছে এমন তদন্ত কমিটির বিশেষ পরামর্শদাতা রবার্ট মুলার কিছুদিন পূর্বেই কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কর্তৃপক্ষ কে অনুরোধ জানিয়েছিলেন তদন্ত কমিটির কাছে সেসব কর্মচারীদের ই-মেইল পাঠাতে, যারা ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণা অংশ নিয়েছিলো। কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কর্তৃপক্ষ দৃঢ় অনুরোধটি রাখতে বাধ্য হয়।
ফেসবুক ইতিমধ্যে নির্বাচনের সময় “জাল খবর” ছড়িয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে এবং ফেইসবুক কর্তৃপক্ষ পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো তাদের ব্যবহারকারীদের। সেই অনবরত পরিবর্তন ও আপডেট ব্যবহারকারীদের করে তুলেছিল ব্যতিব্যস্ত ও এফ-কমার্স নিয়ে যাদের জীবিকা তাদের করেছে ভীত সন্ত্রস্ত।
বিগত বছর ফেইসবুক কর্তৃপক্ষ রবার্ট মুলারকে রাশিয়ান ফেসবুক বিজ্ঞাপন সম্পর্কিত তাদের অনুসন্ধান রিপোর্ট জমা দিয়েছিলো। যেখানে প্রকাশ করা হয়েছিলো যে জুন ২০১৫ হতে মে ২০১৭ পর্যন্ত মোট ১,০০,০০০ মার্কিন ডলার খরচ করা হয়েছিলো বিজ্ঞাপনের পিছে। যার মূল অনুঘটক ছিল ইন্টারনেট স্টাডি এজেন্সি নামে এক রাশিয়ান “ট্রল ফার্ম” যারা ফেইসবুক ব্যবহার করে ছড়িয়েছে রাশিয়ান প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণা। ১,০০,০০০ মার্কিন ডলার সমপরিমাণ অর্থ যুক্ত ছিল প্রায় ৪৭০ টি ফেইক ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট যার মাধ্যমে প্রচার হয়েছিলো ৩,০০০ বিজ্ঞাপন।
গত সোমবার ২০ মার্চ ফেসবুকের তথ্য বেহাত হওয়ার খবর ছড়ালে ফেইসবুকের শেয়ারের দাম ৬.৭৭ % শতাংশ হ্রাস পায়। ফেইসবুক শেয়ারের মূল্য ৩ হাজার ৬০০ কোটি মার্কিন পড়ে গেলে বিনিয়োগকারীরা দুশ্চিন্তায় পড়েন। ফেসবুকে জুকারবার্গের মোট শেয়ার এর পরিমাণ ১৬% শতাংশ। শেয়ার ধ্বসে ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সম্পদ ৫৫০ কোটি মার্কিন ডলার কমে ৬ হাজার ৯০০ কোটি মার্কিন ডলারে নেমে আসে।
সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জুকারবার্গ বলেছেন, এ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য তিনি ‘সত্যিই দুঃখিত’। কিন্তু এই দুঃখপ্রকাশ কি ব্যক্তিগত ফেইসবুক ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে!
এদিকে অনুসন্ধানে জানতে পারা যায় মুলার ২০১৩ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মধ্যস্থতা করার জন্য ১৩ জন রাশিয়ান নাগরিক এবং তিন রাশিয়ান সংস্থাকে দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন, যারা ইন্টারনেট রিসার্চ এজেন্সির অংশ ছিল।
২০১৩ সালে স্নোডেন রাশিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন। তিনি জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার নজরদারি কর্মসূচির (National Security Agency Surveillance Program) গোপনীয় তথ্য ফাঁস করে দেন এবং এরপর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত রাশিয়াতেই অবস্থান করছেন ।
যদিও সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা এমনভাবে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গিয়েছি এক মুহূর্ত স্ট্যাটাস চেক না করে থাকতে পারি না, কিন্তু নিজের অজান্তেই আমারা আমাদের এত পরিমান ব্যক্তিগত তথ্য, ছবি বা বার্তা আদানপ্রদান করে ফেলেছি যা ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্যই হুমকি স্বরূপ।
ভার্চুয়াল বা সাইবার ওয়ার্ল্ড কখনোই জীবনকে নিয়ন্ত্রন করতে পারে না। মুঠোফোন ও ভার্চুয়াল পৃথিবী থেকে খুব দ্রুতই মানুষ ফিরে আসবে প্রকৃতির কোলে, বাস্তব জীবনে এই সকলের কাম্য।
আজ এই পর্যন্তই। আবার ফিরে আসবো নতুনভাবে নতুন রূপে নতুন কোন লেখা নিয়ে। ততদিন ‘প্রিয়লেখার‘ সাথেই থাকুন।
লেখাটি লিখেছেনঃ
নাসীব উর রহমান