“ভয় তো ভয়ই। যারা আমাকে চেনেন, তারা কখনোই আমাকে ভয় পান না। তবে যারা আমাকে প্রথমবার দেখেন, তাদের চোখে আমি স্পষ্ট আতংক দেখতে পাই। দিনের শেষে এটা আমার ভালোই লাগে।”
-অনিরূদ্ধ আগরওয়াল
আপনার হয়তো মনে হতে পারে, কে এই অনিরূদ্ধ আগরওয়াল?
ভদ্রলোকের জন্ম ১৯৪৯ সালের ১ ডিসেম্বরে, ভারতের দেরাদুনে। জন্মের সময়ে কিছু সমস্যার কারণে তার গোটা চেহারাটাই বিকৃত হয়ে যায়। বয়স পাঁচ বছর পার হওয়ার পর থেকে অস্বাভাবিক রকমের লম্বা হতে শুরু করেন তিনি। শেষ পর্যন্ত তার উচ্চতা এসে দাঁড়ায় ছয় ফুট চার ইঞ্চিতে! তার গলার আওয়াজও অস্বাভাবিক মোটা হয়ে যায়।
আপনি যদি ভারতের আশির দশকের পুরনো ভারতীয় সিনেমাগুলো দেখে থাকেন তবে আপনি উনাকে অবশ্যই চিনবেন।
আরেকটু সহজ করে দেব? মনে আছে ‘পুরানা মন্দির’ এর সেই নরপিশাচ ‘সামরি’কে? অথবা ‘বনধ্ দরওয়াজা’ সিনেমার সেই রক্তচোষা দানব ‘নেওলা’ কে?
হ্যা, এই বিশাল আকৃতির দানবটির পিছনে যে অভিনেতা লুকিয়ে আছেন, তিনিই অনিরূদ্ধ আগরওয়াল!
ভদ্রলোক পেশায় ছিলেন একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। ১৯৭৪ সালে আইআইটি, রুকরে থেকে তিনি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ স্নাতক পাশ করেন। তারপর ইঞ্জিনিয়ারিং পেশাতে জড়িয়ে যান।
ইঞ্জিনিয়ারিং তাকে খুব একটা টানতো না। আইআইটির হোস্টেলে থাকার সময়ে গভীর রাতে বন্ধুদের ঘরের দরজায় সামনে দাঁড়িয়ে তাদের ভয় দেখাতে খুব ভালো লাগতো তার। এছাড়া মাঝে মধ্যে দুষ্টুমি করে রাতের বেলা বাথরুমেও অনেক বন্ধুকে ভয় দেখাতেন তিনি। তার বিকৃত চেহারা, অস্বাভাবিক উচ্চতা আর মোটা গলার স্বর এই ব্যাপারে পুরোপুরি সাহায্য করতো।
হাইস্কুলে থাকার সময়ে স্কুলের বার্ষিক নাটকে একবার অভিনয় করেছিলেন তিনি আর তখন থেকেই অভিনয়ের ভূত মাথায় চেপে বসে। কিন্তু ভালো ছাত্র হওয়াতে এই ব্যাপারে কেউই তাকে উৎসাহিত করতো না। বাবা-মা চাইতেন তাদের ছেলে একজন পুরোদস্তুর ইঞ্জিনিয়ার হোক। তাই মা-বাবার স্বপ্নকে সফল করতেই কঠোর পরিশ্রম করে জয়েন্ট এনট্রান্স দিয়ে আইআইটিতে নিজের জায়গা করে নেন। কিন্তু মনের মধ্যে অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন তিনি সবসময়ই পুষে রাখতেন।
লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে মুম্বাইয়ে চলে আসেন এবং একটি প্রতিষ্ঠানে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে যোগ দেন।
অফিসেও তাকে নিজের চেহারার জন্য বিব্রতকর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হতো। তাকে দেখে অনেকেই ভয় পেত। একবার এক সহকর্মী ঠাট্টা করে তাকে বলেন, “বন্ধু তোমার রামসে ভাইদের সাথে দেখা করা উচিত। তারা নিজেদের হরর সিনেমার জন্য নতুন মুখ খুঁজছে।”
সত্যি সত্যিই রামসে ভাইদের সাথে দেখা করেন অনিরুদ্ধ। তখন আশির দশক চলছিল, আর রামসে ভাইয়েরা হলিউডের অনুকরণে বলিউডে হরর সিনেমা বানানোর চেষ্টা করছিলেন। তবে হাতে বাজেট খুব বেশী ছিল না। আর সে সময় মেকআপ ব্যবস্থাও এখনকার মতো এত উন্নত ছিল না। তাই নিজেদের ছবির খলনায়ক কে হবে, এই নিয়ে তারা বেশ চিন্তিতই ছিলেন।
এই সময়ে অনিরূদ্ধকে দেখে হাতে যেন চাঁদ পেয়ে যান। তারাই অনিরূদ্ধের নাম দেন ‘সামরি’। আর বর্তমানে এই নামেই বেশী পরিচিত তিনি।
১৯৮৪ রামসে ভাইদের ছবি ‘পুরানা মন্দির’ এর মাধ্যমে বলিউডে অভিষেক ঘটে অনিরূদ্ধের। এই ছবিতে “সামরি” চরিত্রটিতে অভিনয় করেন। এই চরিত্রটি ছিল একজন পিশাচের, যে শয়তানের পূজারী ছিল এবং মরা মানুষ খেতো। ছবিটি ব্যবসাসফল হয়ে যায়। রামসে ভাইয়েরাও খুবই খুশি হন তার ওপর। এরপর তিনি তাদের ‘সামরি’ নামের ছবিটিতে অভিনয় করেন। এটিও বেশ সফল হয়।
এরপরে কিছু কারণে রামসে ভাইদের সাথে একটু দূরত্ব সৃষ্টি হয় অনিরূদ্ধের আর রামসে ভাইয়েরাও নিজেদের ছবির জন্য অন্য খলনায়ক দিয়ে কাজ চালিয়ে নেন। কিন্তু কোনো ছবিই সফল হলো না।
যার ফলে তাদের আবার অনিরূদ্ধের কাছেই ফিরতে হলো। ১৯৯০ সালে রামসে ভাইদের ‘বনধ্ দওয়াজা’ ছবিতে অভিনয় করেন অনিরূদ্ধ। এই ছবিটি সফল হয়।
বলতে গেলেই তিনটি ছবির সফলতার কারণই ছিলেন অনিরূদ্ধ একাই। এরপর আর রামসে ভাইদের কোনো ছবিতে কাজ করেননি তিনি।
অনিরূদ্ধের চেহারার কারণে তার তেমন কোনো মেকআপই লাগতো না। হরর সিনেমার আদর্শ খলনায়ক হয়ে গেলেন তিনি।
বেশ কিছু মূলধারার সিনেমাতেও অভিনয় করেছেন। যেমন: দস্যু সর্দার ফুলনদেবী জীবন অবলম্বনে নির্মিত ছবি ‘ব্যান্ডিট কুইন’, রাম-লক্ষণ, মেলা ইত্যাদি। কিন্তু এগুলোতে কেউই তার চরিত্রগুলোকে খুব বেশী গুরুত্ব দেয়নি।
তাকে নিয়ে ‘হরর সিনেমার পিশাচ’ ছাড়া আর কোনো চিন্তাই মাথায় আনতে পারতেন না পরিচালকেরা। মনে মনে এই নিয়ে বেশ দুঃখই পেতেন অনিরূদ্ধ।
১৯৯৪ সালে হলিউডের সিনেমা ‘দ্য জঙ্গল বুক’ এ ‘তাবাকি’ চরিত্রে অভিনয় করেন অনিরূদ্ধ। যদিও এই চরিত্রটি নিয়ে কখনোই খুব একটা খুশি ছিলেন না তিনি। ১৯৯৮ সালে ইন্দো-কানাডিয়ান ছবি ‘সাচ আ লং জার্নি’-তেও অভিনয় করেন তিনি।
সিনেমাতে তিনি শেষবার অভিনয় করেন ২০১০ সালের ছবি ‘মল্লিকা’তে।
এছাড়া জি টিভির হরর সিরিয়াল ‘জি হরর শো’ তে অভিনয়ের মাধ্যমে ছোট পর্দাতেও নাম লেখান অনিরূদ্ধ।
অভিনয়ে কখনোই নিয়মিত হতে পারেননি তিনি। তাকে পিশাচের বাইরের কোনো চরিত্র দিতে রাজি ছিলেন না পরিচালকেরা আর সেই সময়ে হরর ছবির নির্মাণ হচ্ছিল খুব কম। তাই কাজের অভাবে একটা সময়ে আবার ইঞ্জিনিয়ারিং এ ফিরে যান অনিরূদ্ধ।
শক্তিমান এই অভিনেতার আরো অভিনয় করার ইচ্ছা ছিল তবে বলিউড তাকে সেই সুযোগ কখনোই দেয়নি।
এই ব্যাপারে তিনি বলেন, “আমার অভিনয় করতে ভালো লাগে। কিন্তু আমাকে সেই সুযোগ দেওয়া হলো কই? কিছু ছবিতে কাজ করেছি কিন্তু তারপর আর কাজ পাইনি। আমার নিয়মিত কাজের দরকার ছিল। শেষে আর উপায় না দেখে আবার ইঞ্জিনিয়ারিং এ ফিরে গেলাম। আমার কোনো আফসোস নেই, কারো ওপরে রাগও নেই।”
ব্যক্তিগত জীবনে বেশ সুখী এই অভিনেতা। স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে মুম্বাইয়েই বাস করেন। অবসর সময়ে হরর মুভি দেখতে বেশ ভালোবাসেন। ‘দ্য এক্সরসিস্ট’ তাঁর প্রিয় সিনেমা। প্রিয় লেখকের তালিকাতে আছেন স্টিফেন কিং, ব্রাম স্টোকার, জে সারিডন লে ফানু প্রমুখ।
হয়তো তিনি কখনোই মহানদের কাতারে দাঁড়াতে পারবেন না কিন্তু তবুও হরর প্রেমীদের মনে অনিরূদ্ধ আগরওয়ালের জন্য একটা আলাদা জায়গা আছে। এই উপমহাদেশের হরর ভক্তরা সর্বদাই অনিরূদ্ধের নাম শ্রদ্ধার সাথেই উচ্চারণ করে থাকেন। এখনো অনেকেই তাকে ‘The Scariest Man in India’ বলে থাকেন।
(চমৎকার এই ফিচারটি লিখেছেন জনপ্রিয় লেখক লুৎফুল কায়সার। রুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগে পড়াশোনা করছেন এবং “আরবান লিজেন্ডস” ও “ক্রিপিপাস্তাস”-এর লেখক। বইদুটো প্রকাশ করেছে ভূমিপ্রকাশ প্রকাশনী। এবারের অমর একুশে বইমেলাতে পাওয়া যাবে সাহিত্য বিকাশের স্টলে)