হাঁটতে শেখার আগে পালাতে শিখেছিল ম্যানুয়েলা এস্কোবার। কারো বাবার নাম যদি হয় পাবলো এস্কোবার, তবে উত্তরাধিকার সূত্রে সে দুনিয়ার আলো দেখবে প্রায় দুই মিলিয়ন অবৈধ ডলার, স্পটলাইটের ঝকঝকে আলোর সাথে পুলিশের তল্লাশি আর প্রতি মুহূর্তে বিপদের হাতছানিকে সঙ্গী করে। বাবার কুকর্মের জন্য জীবনে একবারও মাফ করা হবে না তাকে, ঈশপের সেই গল্পের মতো জল তুই ঘোলা না করলে তোর বাবা করেছে তত্ত্ব মেনে সাজা তাকে পেতেই হবে। মাফিয়া সম্রাট কন্যা ম্যানুয়েলা এস্কোবার তাই সবসময় নিজেকে পর্দার আড়ালে রাখতেই পছন্দ করেছে।
পাবলো এস্কোবারের নাটুকে জীবনের কথা আমরা সবাই কমবেশি জানি। মরার জন্যও সে বেছে নিয়েছিল অতি নাটকীয় পন্থা। ব্যারিও শহরের এক ছাদ থেকে পালাতে গিয়ে বন্দুকযুদ্ধে আহত পাবলো নিহত হয় কয়েকদিনের মধ্যেই। তবে মজার বিষয় হলো মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পাবলো এস্কোবারের জীবন শেষ হয়নি বরং নতুন করে যেন শুরু হয়েছে।
মাফিয়া সম্রাট পাবলো এস্কোবারের মৃত্যুর পর তার কন্যা ম্যানুয়েলা, পুত্র জুয়াল পাবলো আর স্ত্রী মারিয়া হেনাও এস্কোবার কলোম্বিয়ায় পালিয়ে যায়। এস্কোবারের কুকীর্তির কাহিনী শুনে কোনো আশ্রয়দাতাই তাদের সাথে সদয় ব্যবহার করেনি। তারা এমনকি ভ্যাটিকানের কাছেও সাহায্য প্রার্থনা করে খালি হাতে ফিরে এসেছে। অন্যদিকে কালি কার্টেল নামক এস্কোবারের এক প্রতিপক্ষ তাদের কাছে মিলিয়ন ডলার দাবী করছিল বারংবার। তার ভাষ্যমতে, এস্কোবারের এমন সব অপরাধের প্রমাণ তার কাছে আছে যাতে ফেঁসে যাবে গোটা পরিবার। এহেন প্রতিকূল পরিস্থিতেতে রীতিমতো ভয়ে কুঁকড়ে যায় এস্কোবার পরিবার। মাথার উপর এখন আর সেই শক্তিমান বটগাছের ছায়াও নেই, যার জন্য আজ তাদের এই দুর্দশা।
শেষ পর্যন্ত ১৯৫৫ সালে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মোজাম্বিকে চলে আসে তারা। কিছুদিন সেখানে থেকে চলে যায় ব্রাজিলে, তারপর আর্জেন্টিনায়। নতুন নামে, ছদ্ম পরিচয়ে জীবনযাপন শুরু করে তারা তিনজন। পাবলো এস্কোবারের কুকীর্তির সাথে পরিবারের বাকিদের কোনো সম্পর্ক নেই- এমনটা ভাবা ভুল। তার কাজের বিরোধিতা করা তো দূরে থাক, ক্ষেত্র বিশেষে তার কাজে সহায়তা করতো স্ত্রী মারিয়া আর ছেলে জুয়ান। এজন্যই আরও বাড়তি সতর্কতা নিয়ে দেশ থেকে দেশে পালিয়ে বেড়ায় তারা। ১৯৯৯ সালে মারিয়া, তখনকার দিনে ভিক্টোরিয়া ছদ্মনাম গ্রহণকারী, এবং তার ছেলে জুয়াল পাবলোকে, যার নতুন নাম সেবাস্তিয়ান মারকুইন, গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে জাল পরিচয় গ্রহণ, অর্থ পাচার, অবৈধ সংগঠন পরিচালনাসহ একাধিক অভিযোগ ছিল। পালিয়ে থাকতে থাকতে এক সময় তাদের খুঁজে পায় পুলিশ, ধরে নিয়ে সোজা পুরে দেয় জেলখানায়। এই গ্রেপ্তার কাণ্ড নিয়ে অবশ্য বেশ কিছু প্রশ্ন ছিল জনমনে। সবচেয়ে আলোচিত প্রশ্নটি হলো, ম্যানুয়েলা কোথায়?
এস্কোবার পরিবারের একমাত্র সদস্য ম্যানুয়েলা এস্কোবার যার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। এই পর্যন্ত তার নামে কোনো মামলা হয়নি। বাবার মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল মাত্র ৯ বছর। কাজেই বাবার অপকর্মের সাথে সরাসরি যুক্ত হওয়ার দুর্ভাগ্য তার হয়নি। পাবলো মারা যাওয়ায় মা মারিয়া তাকে কখনোই গণমাধ্যমের ধরাছোঁয়ায় আসতে দেয়নি। ১৯৯৯ সালে মা আর ভাইয়ের গ্রেপ্তারের পর প্রথমবার প্রশ্ন ওঠে তার অস্তিত্ব নিয়ে। পাঁচ বছরের মধ্যে পাবলো এস্কোবারের একমাত্র কন্যাকে নিয়ে সেবারই টনক নড়ে সাংবাদিকদের। ‘এল তিয়েম্পো’ নামক একটি কলোম্বিয়ান নিউজ ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জুয়ানা ম্যানুয়েলা মারকুইন ছদ্মনামে ব্যুয়েনাস অ্যায়ার্সে বসবাস করছে ম্যানুয়েলা এস্কোবার।
জারামিলো নামক এক আবাসিক ভবনের ১৯ নং অ্যাপার্টমেন্টে থাকে ম্যানুয়েলা। এস্কোবারের মিলিয়ন ডলারের গুজব যে পুরোটাই কানকথা, ম্যানুয়েলার দৈন্যদশা দেখে তা ভালমতো বোঝা যায়। অর্থবিত্তের ঝনঝনানি তো দূরে থাক, মধ্যবিত্ত জীবনযাপন করতেই রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে তাকে। দূর থেকে শুনতে অনেক কিছুই মধুর লাগে, জীবনটা যার সে-ই ভালো জানে কীভাবে তা চলে। অবশ্য দিনকে দিন তার অবস্থার উন্নতি হচ্ছে বলে জানা গেছে। সবচেয়ে ভালো বিষয় হচ্ছে, ম্যানুয়েলা এস্কোবার পরিচয়ের চেয়ে বরং জুয়ানা মারকুইন পরিচয়ে অনেক ভালো আছে সে। ম্যানুয়েলার জীবনে শিক্ষার সুযোগের অভাব, সারাক্ষণ পালানোর দুশ্চিন্তা, বন্ধুবান্ধবের অপ্রতুলতা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। জুয়ানার জীবনে আছে সত্যিকারের একটি আলোর হাতছানি। স্কুলে পড়ছে সে, থাকার একটি নির্দিষ্ট জায়গা আছে তার, আছে সমবয়সী বন্ধুদের সাথে হইচই করার স্বাধীনতা।
তবে জুয়ানা আর ম্যানুয়েলা দুজনের চরিত্রের একটি কমন বৈশিষ্ট্য আছে- ভয়। মা আর ভাই গ্রেপ্তার হওয়ার পর ম্যানুয়ালের জীবনে আরও একবার নতুন করে ভয় বাসা বাঁধে। এবার কী তবে তার পালা? বাবার অপরাধের সাজা কি তবে তাকেও পেতে হবে? বয়ঃসন্ধিকালে এই ভয়কে সঙ্গী করে একাকী জীবন কেটেছে তার। কয়েক বছরের মধ্যে অবশ্য ছাড়া পেয়ে যায় মারিয়া আর জুয়ান। তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি পুলিশ। কিন্তু তাদের সাথে আর নতুন করে নিজেকে জড়ায়নি ম্যানুয়েলা। পৃথিবীর কাছ থেকে লুকিয়ে নিজের একটি জগত তৈরি করে নিয়েছে সে।
সারাক্ষণ সাক্ষাৎকার দিয়ে, বাবাকে নিয়ে বই লিখে স্পটলাইটে আছে জুয়ান পাবলো। ম্যানুয়েলা তার ঠিক উল্টোটা করছে। ১৯৯৯ সাল থেকে তার জীবনে একাকী অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের দিন কেটেছে। ডিপ্রেশনের শিকার ম্যানুয়েলা নিজের জীবন নেয়ার চেষ্টাও করেছে বলে জানিয়েছে জুয়ান পাবলো। পাবলিক রিলেশন নিয়ে পড়ছে, আর ডিপ্রেশনের সাথে লড়ছে মেয়েটি। জুয়ানের মতে ম্যানুয়েলা, জুয়ান আর তার স্ত্রী একসাথেই বসবাস করে। তবে ম্যানুয়েলাকে কারো চোখে পড়েনি কখনো।
২০১৫ সালে বোনকে নিয়ে শেষ বারের মতো কথা বলেছে জুয়ান। জুয়ানের ভাষ্যমতে, ম্যানুয়েলা ভীষণ ভয় পায়। যে মানুষটিকে সে সেই অর্থে কখনো দেখেনি, যার সম্পর্কে সে তেমন কিছু জানে না, তার অপরাধের অপরাধী যেন ম্যানুয়েলাকে হতে না হয় সে ভয়েই নিজের পরিচয় লুকিয়ে রেখেছে সে। হয়তো তার শরীর যে মাফিয়া সম্রাটের রক্ত বইছে তার পরিপ্রেক্ষিতে একদিন তার জীবনের সত্যিকারের ভালোবাসা তাকে ছেড়ে চলে যাবে- এই ভয় আর ডিপ্রেশনকে সঙ্গী করেই দিন কাটাচ্ছে বেচারি।