পুরুষ টেনিসের ইতিহাসে সমসাময়িক দুই খেলোয়াড়ের দ্বৈরথ আছে বেশ কিছু। আন্দ্রে আগাসি – পিট সাম্প্রাস, জন ম্যাকেনরো – বিয়ন বোর্গ, রড লেভার – কেন রেজওয়াল । আরেকটু ভেতরে গেলে ইভান লেন্ডল – জন ম্যাকেনরো, জিমি কনর্স – ইভান লেন্ডল, বরিস বেকার – স্টিভেন এডবার্গ এদের দ্বৈরথের কথাও বলা যায়। কিন্তু পুরুষ টেনিসের সর্বকালের সেরা দ্বৈরথের কথা বলতে গেলে কি আপনার চোখে অন্য একটি দ্বৈরথই ভেসে উঠছে না? একজন লাল কোর্টের রাজা, আরেকজন সবুজ ঘাসের নৃপতি। সর্বকালের অন্যতম সেরা দুই টেনিস খেলোয়াড়, রাফায়েল নাদাল ও রজার ফেদেরারের দ্বৈরথ !
বছরের পর বছর ধরে দুজনে মিলে উপহার দিয়েছেন অবিশ্বাস্য সব লড়াই। ২০০৮ উইম্বল্ডন ফাইনাল , ২০১৭ অস্ট্রেলিয়ান ওপেন ফাইনাল আজীবন হয়তো চোখে লেগে থাকবে টেনিসপ্রেমীদের। এখনো পর্যন্ত টেনিস কোর্টে ৩৮ বার মুখোমুখি হয়েছেন এই দুই গ্রেট। গ্র্যান্ডস্ল্যাম জয়ের দিকে নাদালকে পেছনে ফেলেছেন ঠিকই , কিন্তু মুখোমুখি লড়াইয়ে এসে তাঁর চেয়ে অনেকটাই পেছনে পড়ে গেছেন অনেকের মতেই টেনিসের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় ফেদেরার । ৩৮ বারের মোকাবেলায় ফেদেরার জয় নিয়ে কোর্ট ছেড়েছেন ১৫ বার , যেখানে নাদাল জয়ের হাসি হেসেছেন ২৩ বার । হিসাবটা যখন শুধু গ্র্যান্ডস্ল্যামে সীমাবদ্ধ , সেখানেও অনেকটা এগিয়ে নাদাল ।
গ্র্যান্ডস্ল্যামে ১২ বার মুখোমুখি হয়ে ৯-৩ ব্যবধানে পাল্লাটা নিজের দিকেই ঝুঁকিয়ে রেখেছেন ‘স্প্যানিশ ম্যাটাডোর’। এই ১২ বারের মধ্যে ৯ বার দেখা হয়েছে গ্র্যান্ডস্ল্যাম ফাইনালে, যার মধ্যে ৬টিতেই জয়ী নাদাল। এর মধ্যে ফ্রেঞ্চ ওপেনের ফাইনালে চারবার নাদালের মুখোমুখি হয়ে চারবারই হেরেছেন ফেদেরার। লাল মাটির কোর্টে নাদালের আধিপত্যও আরেকটু স্পষ্ট হয় এতে। উইম্বল্ডন ফাইনালে ৩ বারের মোকাবেলায় ফেদেরার এগিয়ে ২-১ ব্যবধানে, আর অস্ট্রেলিয়ান ওপেন ফাইনালে দুইবারের মোকাবেলায় ১-১ সমতা। ইউএস ওপেনে এখনো পর্যন্ত দুজনে মুখোমুখি হননি।
বয়সে পাঁচ বছরের ছোট-বড় এই দুই তারকার মহা দ্বৈরথের যাত্রা শুরু আজ থেকে ১৪ বছর আগে। যুক্তরাষ্ট্রের মায়ামি মাস্টার্সের দর্শকেরা সেদিন বোধহয় বুঝতেও পারেননি, ভবিষ্যতের কোন মহাদ্বৈরথের শুরুর সাক্ষী হতে এসেছেন তারা! ২০০৪ সালের মার্চে মায়ামি মাস্টার্সের ৩য় রাউন্ডে মুখোমুখি হয়েছিলেন র্যাঙ্কিংয়ের নাম্বার ওয়ান তারকা ফেদেরার ও ৩৪ নম্বরে থাকা ১৭ বছরের এক কিশোর নাদাল। ফেদেরার হেসেখেলে জিতবেন এমনটাই হয়তো স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু সবাইকে চমকে ফেভারিট ফেদেরারকে সরাসরি সেটে হারিয়ে দেন বাঁহাতি এই স্প্যানিশ! যেন সেদিনই ঘোষণা দিয়ে রাখলেন, ভবিষ্যতে আরও অনেকবারই আমার কাছে তোমাকে মাথা নোয়াতে হবে রজার !
পরের বছর ঠিক একই জায়গায় আবারো মুখোমুখি দুজন, তবে এবার একেবারে ফাইনালে। প্রথম দুই সেটে এগিয়ে গিয়ে এবারও জয়ের সম্ভাবনা জাগিয়েছিলেন নাদালই , কিন্তু শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়নের অহম জেগে ওঠায় পেছন থেকে এসেই ম্যাচ জিতে নেন ফেডেক্স ।
গ্র্যান্ডস্ল্যামে দুজনের প্রথমবার মোকাবেলা ফ্রেঞ্চ ওপেনে, ২০০৫ সালেই। নিজের প্রথম গ্র্যান্ডস্ল্যাম জয়ের পথে সেমিফাইনালে চার সেটের লড়াইয়ে ফেদেরারকেই হারিয়েছিলেন নাদাল ।
এরপর আরও বহুবার মুখোমুখি হয়েছেন দুজন, তবে সবচেয়ে স্মরণীয় লড়াইটা বোধহয় হয়ে আছে ২০০৮ উইম্বল্ডন ফাইনালটাই। সর্বকালের অন্যতম সেরা গ্র্যান্ডস্ল্যাম ফাইনালের স্বীকৃতিও যে পেয়ে গেছে ম্যাচটি! এর আগের দুই বছরেও উইম্বল্ডন ফাইনাল খেলেছেন এই দুজনই। দুইবারই নিজের প্রিয় কোর্টে নাদালকে আটকে দিয়েছিলেন ফেদেরার। শুধু তাই নয়, টানা ষষ্ঠবারের মত উইম্বল্ডন শিরোপা জয়ের পথে ফেদেরারই ছিলেন বড় ফেভারিট। কিন্তু এবার যে অন্য পরিকল্পনা ছিল নাদালের!
বৃষ্টিতে প্রায় আধা ঘণ্টা দেরিতে শুরু হওয়া ম্যাচের প্রথম দুই সেটেই ৬-৪ এ জিতে উইম্বল্ডনে নিজের প্রথম শিরোপা জয়ের পথে অনেকটা এগিয়ে যান নাদাল। কিন্তু উইম্বল্ডনের সম্রাট ফেদেরার বিনা যুদ্ধে শিরোপা ছাড়বেন কেন! আবারো জাগিয়ে তুললেন নিজের অহমকে, বৃষ্টিবিঘ্নিত পরের দুইটি সেট জিতে নিলেন টাইব্রেকারে। চতুর্থ সেটে দুইটি চ্যাম্পিয়নশিপ পয়েন্ট বাঁচিয়ে ম্যাচে নিজের আশাও বাঁচিয়ে রাখেন সুইস গ্রেট।
পঞ্চম সেটে আবারো বৃষ্টির বাগড়া, সাথে এবার আলোকস্বল্পতাও। তারপরেও নাদালের সার্ভ ব্রেক করে নিজের টানা ষষ্ঠ উইম্বল্ডন মুকুট জয়ের একদম কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন, কিন্তু দারুণ খেলে নিজের সার্ভ জিতে নেন নাদাল। আর এরপর ফেদেরারের সার্ভ ব্রেক করে ৯-৭ এ জিতে নেন পঞ্চম সেট, ফেদেরারের রাজত্বে এসে নতুন রাজার মুকুট পরলেন রাফায়েল নাদাল! নিজের সাম্রাজ্যে এসে অন্য কাউকে শিরোপা উল্লাস করতে দেখেই কিনা, গ্যালারি ভর্তি দর্শকের সামনে কান্না আটকাতে পারেননি ঘাসের কোর্টের সর্বকালের সেরা ফেদেরার!
তবে ম্যাচ শেষে আলোকস্বল্পতা নিয়ে ক্ষোভ জানাতে ভোলেননি ফেদেরার। ম্যাচের এক পর্যায়ে নাকি কার বিপক্ষে খেলছেন সেটাই দেখতে পাচ্ছিলেন না তিনি! শেষ পর্যন্ত সব বিতর্ক পাশে ফেলে এটিই তাই গ্র্যান্ডস্ল্যাম ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফাইনাল।
পরের বছর অবশ্য হাঁটুর চোটের কারণে শিরোপা ধরে রাখতে পারেননি নাদাল, পুরোনো প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যান্ডি রডিককে হারিয়ে আবারো শিরোপা পুনরুদ্ধার করেন ফেদেরার। সেটিও ছিল আরেক এপিক ফাইনাল, পঞ্চম সেটে গিয়ে ১৬-১৪ সেটে জিততে হয়েছিল ফেদেরারকে! এই জয় দিয়েই পিট সাম্প্রাসকে পেছনে ফেলে পুরুষদের মধ্যে সর্বোচ্চ গ্র্যান্ডস্ল্যাম জয়ের রেকর্ড করেছিলেন ‘ফেড এক্সপ্রেস’।
একটা জায়গায় দুজনের মধ্যেই আছে অদ্ভুত এক মিল। উন্মুক্ত যুগে ঘাসের কোর্ট (৬৫) ও হার্ড কোর্টে (৫৬) টানা ম্যাচ জয়ের রেকর্ড ফেদেরারের, ক্লে কোর্টে যে রেকর্ডটা নাদালের দখলে (৮১)। অদ্ভুতভাবে, দুজনের এই অপরাজিত থাকার রেকর্ড ভেঙ্গেছিলেন একে অপরেই!
দুজনের ৩৮ ম্যাচের মধ্যে ২০ টি ম্যাচ খেলা হয়েছে হার্ড কোর্টে, ১৫ টি ক্লে কোর্টে আর ৩ টি ম্যাচ হয়েছে ক্লে কোর্টে। ঘাসের কোর্টে ২-১ এ এগিয়ে ফেদেরার, এগিয়ে আছেন হার্ড কোর্টেও (১১-৯)। ক্লে কোর্টে আবার নাদালের একচ্ছত্র আধিপত্য, নাদালের ১৩ জয়ের বিপরীতে ফেদেরারের জয় মাত্র ২ টি।
তবে মাঠে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও মাঠের বাইরে দুজনেই খুব ভালো বন্ধু, এবং নিপাট ভদ্রলোক। একে অপরের প্রশংসা করতেও কার্পণ্য করেননি কখনো। ২০০৮ উইম্বল্ডনে স্বপ্নের ঘাসের কোর্টে নাদালের কাছে হারার পরে কান্নাভেজা চোখেই যেমন প্রশংসা করেছিলেন ৫ বছরের জুনিয়র নাদালের, “নাদাল অসাধারণ একজন খেলোয়াড়। আরও অনেকদিন রাজত্ব করবে ও। ও সব শিরোপা জিতে নেয়ার আগেই আমি কিছু জিততে পেরেছি, আমি তাই খুশি!”
নাদালও সমান সম্মান দেখিয়েছেন ফেদেরারের প্রতি। এক সাক্ষাৎকারে সর্বকালের সেরা টেনিস খেলোয়াড় সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, “যদি কেউ বলে আমি রজারের চেয়ে ভালো, আমি বলব সে তাহলে টেনিসের কিছুই বোঝে না”। আরেকবার এমনটাও বলেছিলেন, “রজার যখন শতভাগ দিয়ে খেলে, ওকে হারানো অসম্ভব”।
২০১১ ইউএস ওপেনের আগে ফর্ম নিয়ে খুব ভুগছিলেন ফেদেরার। এক সাংবাদিক তখন নাদালের কাছে জানতে চেয়েছিলেন ফেদেরার ফুরিয়ে গেছেন কিনা। নাদাল জবাব দিয়েছিলেন দারুণভাবে, “আমি সাংবাদিক নই। আপনারা সাংবাদিকেরা এখনো পর্যন্ত বহুবার রজারের শেষ ঘোষণা করে দিয়েছেন। কিন্তু প্রতিবার সে ফিরে এসেছে, আপনাদের ভুল প্রমাণিত করেছে। রজার ফুরিয়ে গেছে এমনটা ভাবার ভুল অন্য যে কেউ করলে করুক, আমি অন্তত করছি না”।
মানুষ হিসেবে যে সত্যিই তিনি অন্য ধাঁচের, তাঁর প্রমাণ আরও একবার ফেদেরার দিয়েছিলেন নাদাল সম্পর্কে করা তাঁর এক মন্তব্যে। নিজের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বীর সম্পর্কে মুগ্ধতা জানাতে গিয়ে বলেছিলেন, “আমি রাফার এক নম্বর ফ্যান। ওর খেলা সত্যিই অবিশ্বাস্য। প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে সে সেরা, আমি খুশি যে আমরা দুজনে মিলে সেরা কিছু লড়াই উপহার দিতে পেরেছি”।
নিজেদের বন্ধুত্বটাকে দুজনে টেনে এনেছেন টেনিস কোর্টেও। একজন অপরজনের ডাকে সাড়া দিয়ে খেলতে গেছেন প্রদর্শনী টুর্নামেন্ট, দুজনে প্রথমবারের মত জুটি বেঁধে খেলেছেন লেভার কাপেও। নিপাট ভদ্রলোক এই দুজন মানুষ যেন প্রমাণ করে দিতে চান, তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা দিয়েও কিভাবে বন্ধুত্বের মিতালি গড়ে তোলা যায়!