রহস্য, প্রতীকের মাঝে লুকিয়ে থাকা গোপন সংকেত, ধর্ম ইত্যাদি বিষয়ে যাদের আগ্রহ রয়েছে, তাদের মধ্যে ড্যান ব্রাউনের নাম শোনেন নি এমন কেউ হয়তো নেই। খ্যাতিমান এই লেখক ইতোমধ্যেই দ্য ডা ভিঞ্চি কোড, এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস, দ্য লস্ট সিম্বল, ইনফার্নো কিংবা হালের অরিজিন- বইগুলো দিয়ে বাজিমাত করে দিয়েছেন। রহস্যপ্রেমীরা চাতকের জন্য অপেক্ষা করে তার বইয়ের জন্য। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রবার্ট ল্যাংডনের সাথে পাঠকেরা ছুটে চলে পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে, উন্মোচন করে প্রতীক, ধর্ম আর রহস্যের অজানা সব দুয়ার। কেবল বইয়ের পাতাতেই ল্যাংডন সীমাবদ্ধ নেই। চলে এসেছেন রুপালি পর্দায়ও। জনপ্রিয় অভিনেতা টম হ্যাংকস নিদারুণ নৈপুণ্যের সাথে রবার্ট ল্যাংডন চরিত্রটির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন। এইতো, কিছুদিন আগে প্রকাশিত ল্যাংডন সিরিজের নতুন কিস্তি ‘অরিজিন’ সাড়া ফেলে দিয়েছে। আলোচনায় চলে এসেছেন ড্যান ব্রাউন। কারণ, তার বইতে যে শুধু রহস্য থাকে, তাই নয়, বরং ধর্মের নানা দিক তুলে ধরেন তিনি। সত্যাসত্য কিংবা মিথ্যের মিশেলে থাকা ধর্মের নানা অজানা কাহিনীকে নিয়ে আসেন মানসপটে। সংগত কারণেই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কড়া সমালোচনা করেন ড্যান ব্রাউনের। তাতে থোড়াই কেয়ার করেন তিনি! ৫৬টি ভাষায় ২০ কোটিরও অধিক কপি ছাপা হয় তার বই। বেস্টসেলারের তালিকায় আসতে দেরি হয় না মোটেও। ‘হটকেক’এর মতো মানুষ তার বই কিনতে থাকে।
সিবিএস নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারের টুকরো কিছু অংশই তুলে ধরব আজ প্রিয়লেখার পাতায়ঃ
ডুকোপিলঃ আপনার বই বের হবার পর ভ্যাটিকান সিটির প্রতিক্রিয়া কেমন হয়?
ব্রাউনঃ ভ্যাটিকান সিটি সকল ক্যাথোলিক চার্চকে ডেকে বলে, “এই বইকে বয়কট করে দাও। গসপেলের প্রচার করো ভালোভাবে এবং সবাইকে বোঝাও ড্যান ব্রাউন মিথ্যে বলছেন।”
ডুকোপিলঃ নিজেকে কি হিসেবে দেখেন, ক্যাথোলিক বিরোধী নাকি ধর্ম বিরোধী?
ব্রাউনঃ একেবারেই না। ধর্ম পৃথিবীকে সুন্দর করে তুলছে। একইসাথে, প্রত্যেক ধর্মেই কিছু না কিছু প্রতীকী কথা রয়েছে, নানা ধরণের লেখা রয়েছে। সেগুলোকে একদম প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয় কোন ধরনের ব্যাখ্যা না করেই। দর্শন বা ধর্মের যে কোন শাখাই বলুন না কেন, বিষয়টি ভয়ঙ্কর।
এবার আসা যাক, ড্যান ব্রাউনের নতুন বই ‘অরিজিন’ সম্পর্কে। স্বভাবতই সিরিজের বাকি বইগুলোর মতোই এটিতেও ঈশ্বরকে মোটামুটি বিলীন হবার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসা হয়েছে। এ সম্পর্কে তিনি বলেন,
‘সকল ঈশ্বরেরই পতন ঘটে। আজকে যে ঈশ্বরকে আমরা মানছি, তার যে একই পরিণতি হবে না, সেটি মেনে নেয়ার মতো বোকামি কেন করব আমরা?’
ডুকোপিলঃ যদি তাই হয়, পৃথিবীটা কি আরো সুন্দর হবে?
ব্রাউনঃ আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ধর্ম ছাড়া পৃথিবীটা অনেক সুন্দর হবে। আস্তে আস্তে সে অবস্থানের দিকেই যাচ্ছি সকলে।
আবার আসা যাক ব্রাউনের একদম নিজের বিবর্তনের গল্পে। নিউ হ্যাম্পশায়ারের নামজাদা এক স্কুল, ফিলিপস এক্সিটার একাডেমীতে সূচনাটা হয়েছিল। বাবা অঙ্ক কষাতেন। ছেলেকে বিজ্ঞানের ওপর আস্থা রাখাটা তিনিই শিখিয়েছেন।
ডুকোপিলঃ গণিত, আপনার বাবা, এই শ্রেণীকক্ষ- এসবকিছু কিভাবে আপনার কাজে প্রভাব রেখেছে বলে মনে করেন?
ব্রাউনঃ এগুলো আমার কাজের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সূক্ষ্ম বিচার করতে শিখিয়েছে এই উপাদানগুলো।
ড্যান ব্রাউনের মা, গত বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন। স্কুলের গানের শিক্ষিকা ছিলেন তিনি। চার্চ অর্গান বাজাতেন। মায়ের গানের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে ব্রাউনের সঙ্গীত শিক্ষায় হাতেখড়ি। তিনিই ছেলেকে ঈশ্বরে ভক্তি এবং বিশ্বাস শিখিয়েছেন।
ব্রাউনকে যখন প্রশ্ন করা হয় যে ধর্ম কখন তার মতে নিজ অবস্থান থেকে সরে আসতে শুরু করেছে, ব্রাউন বলেন,
‘সত্যিটা কি, তা জানতে আমার অন্বেষণ শুরু হয়। ১৩ বছর বয়সে যাজককে জিজ্ঞাসা করি, “একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। আপনি অ্যাডাম আর ঈভের কথা বলছেন, সাত দিনে সমগ্র সৃষ্টির কথা বলছেন কিন্তু আমি বিবর্তনবাদ শিখছি। কোন গল্পটা তাহলে সত্যি?”
যাজক উত্তর দিয়েছিলেন, “ভালো ছেলেরা ওমন প্রশ্ন করে না।”
এই প্রশ্নটাই ব্রাউনকে শক্তি জুগিয়েছে তার লেখনীতে। প্রথম দিকে ড্যান ব্রাউন গান লিখতেন। তবে র্যাপ সঙ্গীতের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠে যাবার কারণে তার গান কেউ পছন্দ করত না। খুব কম মানুষই ব্রাউনের বই কিনত। ছদ্মনামে তিনটি উপন্যাস এবং একটি কৌতুকের বই লেখেন। নাম “187 Men To Avoid”
ডুকোপিলঃ সেসময়, এটাই কি আপনার বেস্ট সেলিং বই ছিল?
ব্রাউন হাসতে হাসতে জবাব দেন, “ওটাই আমার একমাত্র বিক্রিত বই ছিল।”
ফিলিপস এক্সিটারে শিক্ষকতাও শুরু করেন ব্রাউন। দুপুরে ইংরেজি পড়াতেন। সকালে এক বন্ধুর বইয়ের দোকানের ওপর ছোট্ট অফিসে লিখতে শুরু করেন দ্য ডা ভিঞ্চি কোড। বইটি ধাঁধা, কোড ইত্যাদিতে ভরপুর ছিল। ক্রিসমাসে যেমন ব্রাউন তার ভাইবোনদের সাথে গাছের নিচে যেয়ে দেখতেন সেখানে কোন উপহার নেই, শুধুই খামে ভরা একটা কোড।
বাবা নানা ধরনের পাজল মেলাতে দিতেন ব্রাউনকে। সেগুলোও তার কাজের গতিকে বেশ ত্বরান্বিত করে। ২০০৩ সালে প্রকাশিত দ্য ডা ভিঞ্চি কোড বিক্রিত হয় ৮ কোটি কপিরও অধিক।
ব্রাউনঃ আমি অরেগনের পোর্টল্যান্ডে বেড়াতে গিয়েছিলাম। নিউ ইয়র্ক টাইমসের লেখকদের তালিকাটা তখনই প্রকাশিত হলো। আমার নামটা সেখানে আছে কি না, জানতে কৌতুহল হলো। হোটেলে পৌছুবার পর আমাকে বলা হলো, একটা ফ্যাক্স এসেছে। আমার নাম তালিকার সবার প্রথমে! বাবা মাকেই প্রথম ফোনটা করি।
ডুকোপিলঃ আজ কি সেটা কোন অর্থ বহন করে?
ব্রাউনঃ অবশ্যই। এখানে বাবা মা নিয়ে কথা হচ্ছে। জীবনে যা কিছুই করি না কেন, বাবা মায়ের সম্মতি থাকলে যে কোন কিছু করা সম্ভব।
ডুকোপিলঃ তবে সমসাময়িক কিছু লেখক কিন্তু আপনাকে ছেড়ে কথা বলে নি। যেমন, স্টিফেন কিং। তিনি আপনার বইকে বলেছেন কাগজে ছাপা কিছু ম্যাকারনি আর পনির।
ব্রাউনঃ ম্যাকারনি আর পনির আমার খুবই পছন্দের। আমরা, লেখকেরা একটা কথা বলতে খুব পছন্দ করি, “হাহ! আমি বইয়ের রিভিউ পড়ি না। কেউ খারাপ মন্তব্য করলে কিছু এসে যায় না।” কথাটা সর্বৈব মিথ্যে মনে হয় আমার কাছে। সৃষ্টিশীল মানুষ মাত্রই চাইবে সবাই যেন তার কাজ পছন্দ করে। আমি এমন বই লিখতে পছন্দ করি যেগুলো স্বাদে মনে হবে আইস্ক্রিম কিন্তু পুষ্টিতে হবে তাজা সবজির মতো। মানুষ যেন এগুলো পছন্দ করে। উইলিয়াম ফকনারকে অনুকরণ করি না আমি।
৫৩ বছর বয়সী ড্যান ব্রাউনের জীবনটা বেশ চলছে। স্ত্রীকে নিয়ে এমন একটি বাড়িতে থাকেন, যেটি দেখলে মনে হবে যেন তারই বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসেছে। কোড, গোপন ঘর, লুকানো প্যাসেজ ইত্যাদিতে ঠাসা এই বাড়িটি।
ড্যান ব্রাউনের মনে হয় সাফল্য কোন ধাঁধা নয়। নতুন বইটা পড়ার সৌভাগ্য মায়ের হয় নি, তবে বাবা দু’জনের হয়েই সম্মতি দিয়েছেন। ডুকোপিলের শেষ প্রশ্ন ছিল, ‘বইটি পড়ে বাবা কি বললেন?’
ব্রাউনঃ ড্যান, এটা তোমার লেখা সবচেয়ে সেরা বই। আমি জানি না ঠিক বললেন কিনা, তবে এটাই বলেছেন!
পাঠক, বাকিটা আপনাদের হাতে।
(অনুবাদটি ঈষৎ সংক্ষেপিত, পরিবর্তিত ও পরিমার্জিত)