আব্রাহাম লিংকন, তার প্রেতাত্মা আর হোয়াইট হাউজ- এই ত্রিভুজ ভৌতিক কাহিনীর কথা ছড়িয়ে পড়েছে মানুষের মুখে মুখে। আমেরিকার ১৬তম প্রেসিডেন্ট তিনি, ১৮০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি, আমেরিকার কেনটাকি রাজ্যের হার্ডিন কাউন্টিতে অতি সাধারণ একটি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম থমাস লিংকন ও মায়ের নাম ন্যান্সী হ্যাঙ্কস লিংকন। লিংকনের বয়স যখন মাত্র ৯ বছর তখন তার মা মারা যান এবং এর কয়েক মাস পরে তার বাবা আবারও তিন সন্তানসহ একজন বিধবা মহিলা সারাহ বুশ জন্সটনকে বিয়ে করেন। তিনি আব্রাহামকে খুব ভালবাসতেন এবং লেখাপড়ার জন্য উৎসাহ দিতেন। আব্রাহাম লিংকনের ছিল বই পড়ার প্রতি অসম্ভব রকমের আগ্রহ। কিন্তু লিংকন সর্বসাকুল্যে মাত্র ১৮ মাস প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া করেছেন। তিনি একজন স্বশিক্ষিত ব্যক্তি। বই পড়ার জন্য তিনি মাইলের পর মাইল পথ হেঁটে বই সংগ্রহ করেছেন। তিনি পারিবারিক বাইবেল এবং তখনকার বিখ্যাত বইসমূহ যেমন- রবিনসন ক্রুসো, তীর্থযাত্রীদের অগ্রগতি ও ইশপের গল্প পড়তে খুবই পছন্দ করতেন। জ্ঞান অন্বেষণে লিংকন ছিলেন একজন মনযোগী পাঠক।
একজন খুন হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রপতি ও তাঁকে খুন করে পালিয়ে যাওয়া আততায়ীকে আবর্তন করে ইতিহাসে ঘনীভূত হয়েছে রহস্যের জাল। অতঃপর আততায়ীকে পাওয়া গেল আহত অবস্থায়। আততায়ী মৃত্যুশয্যায় জবানবন্দী নেয়ার পরপরই আততায়ীর বীভৎস আত্মহত্যা। আততায়ীর পরিবারে চরম সামাজিক অসম্মানের সাথে আদালতে উত্থাপিত হতে লাগলো একের পর এক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। তর্ক-বিতর্ক চলার মাঝখানেই আততায়ীকে গোপনে কবর দেয়া হলো আর সেটি করা হলো কোন রকম চিহ্ন না রেখেই। অতঃপর একদিন দাবি উঠলো সন্দেহভাজন কবরের মৃতদেহকে কবর থেকে তুলে ডি এন এ বিশ্লেষণের জন্য। উপরের কথাগুলোর সব গুলোই কি মনে হচ্ছে না কোন এক জটিল ধাঁধা? গত দেড়শ বছর ধরে এই জটিল আর এলোমেলো সূত্রগুলোকে এক সাথে সাজিয়ে প্রকৃত ঘটনা উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। কিন্তু একের পর এক অস্বাভাবিক মৃত্যু আর কল্পকাহিনীর ডাল-পালার অস্বাভাবিক বিস্তার কোথায় যেন সত্যকে আড়াল করে দিচ্ছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন খুন হন আততায়ী উইলকিস বুথের গুলিতে। সেসময় আমেরিকার দক্ষিণের কিছু রাজ্য স্বাধীন হয়ে যেতে চাইছিলো, কিন্তু লিংকন আমেরিকার একত্রীকরণে আগ্রহী ছিলেন। বুথ ভেবেছিল, লিংকনকে মেরে ফেললে এই ইস্যুটিকে পুনর্জীবিত করা যাবে। তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। অচিরেই বুথকে খুঁজে বের করা হয়। এরপর বুথ আত্মহত্যা করে। সমস্যা হলো, ধরা পড়ার সময় বুথ আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে প্যারালাইজড অবস্থায় ছিল, যে কিনা নিজের হাত পর্যন্ত নাড়াতে সক্ষম ছিল না। তাহলে বুথ কিভাবে মারা গেল?
বুথ কি আসলেই আত্মহত্যা করেছিলেন? নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছিল? ১৮৬৫ সালে প্রকাশিত তদন্ত রিপোর্টের পুরোটাই ছিল ঘোলাটে যেটা ঘটনার সমাধান না করে বিতর্কটিকে আরো উসকে দেয়। এটাও বলা হয় বুথের বদলে হয়তো অন্য কোন ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে। ইতিহাসবিদরা এটিকে খুব বেশি গুরত্ব না দিলেও বুথের মৃত্যু নিয়ে এই ঘটনাগুলো কিছুদিন পর পরই নতুন বিতর্ক নিয়ে ফিরে আসে। বুথ মারা গিয়েছে কিন্তু তার জীবনের ঘটনাগুলো আজো ঘুরে বেড়াচ্ছে বিদেহী আত্মার মতোই। নেট অর্লোওয়েক তাঁর জীবনের চল্লিশ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন ঘটনার রহস্য উন্মোচনে। তিনি বলেন, “যে কোন তথ্য খুঁজে বের করার জন্য আমাদের জানা ও অজানা, ইতিহাসে উল্লেখিত কিংবা লুকায়িত-সব বক্তব্য জানতে হবে”।
তাঁর মতে, বুথ আত্মহত্যা করেছেন বলে যে কথা ইতিহাস বলছে তা হয়তো ঠিক নয়। যদিও তিনি বা এরকম যারা বিশ্বাস করেন, তাদের হাতে এ সংক্রান্ত প্রমাণ খুব কম আছে। ওর্লোয়েক ও বুথের উত্তরাধিকারীরা এবার সত্য অনুসন্ধানে ডি এন এ টেস্টের শরণাপন্ন হচ্ছেন। এটা হয়তো জানাবে বুথ কি নিজেই আত্মহত্যা করেছিল নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছে। একাজের জন্য প্রথমে তাঁদেরকে বুথ এর ভাই এডউইন বুথ এর দেহাবশেষ সমাধি থেকে অনুমতি সাপেক্ষে তুলতে হবে। এরপর এতে প্রাপ্ত ডি এন এ’র সাথে ১৪৮ বছর আগে যে ব্যক্তিকে ঘাড়ে গুলি করে মারার পর বুথ হিসেবে নির্ণয় করা হয়েছিল, তার মেরুদণ্ডের তিনটি হাড়ের নমুনাতে প্রাপ্ত ডি এন এ’র সাথে মিলিয়ে দেখা হবে। ওর্লোয়েক ১৯৯২ সালে গ্রিন মাউন্ট সিমেট্রি কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানান তাদের সমাধিক্ষেত্রে বুথ এর সম্ভাব্য কবর থেকে বুথের দেহাবশেষ তোলার। কর্তৃপক্ষ বুথের আবেদন এই বলে নাকচ করে দেয়, এ ধরণের ‘সিনেমাটিক’ কাজের জন্য তারা সমাধিক্ষেত্রের পরিবেশ নষ্ট করতে পারবেন না। এবার ওর্লোয়েক ও বুথের উত্তরাধিকাররা সিমেট্রির বিরুদ্ধে মামলা করলেন।
দীর্ঘ দিন চলার পর আদালতের রায় ছিল এরকম, “বুথের দেহাবশেষ বলে দাবি করা শবদেহ ১৮৬৫ সালে কোন এক অজ্ঞাত স্থানে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে, সেই একই কবরে বুথের তিনজন অপ্রাপ্তবয়স্ক ভাই-বোনকে কবর দেয়া হয়েছে। এই কবরের মাটি পানিতে ডুবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া তার দাঁতের তথ্যগুলো কোন রেকর্ডে রাখা হয় নি, যেগুলো মিলিয়ে দেখা যেতে পারে। তাই, যে কোন ধরণের খননকাজে কোন ফলাফল আসবে না।…” এরপরে অনেকবার আবেদন করার পরও আদালত তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।
এখন যেহেতু বুথের মরদেহ পাওয়া যাচ্ছে না তবে কি করা যেতে পারে? বুথের ভাই এডউইন বুথের সমাধি বোস্টনে অবস্থিত। বুথের দেহাবশেষ কবর থেকে উঠিতে প্রাপ্ত DNA নমুনার সাথে National Museum of Health and Medicine এ রক্ষিত ব্যক্তির কশেরুকার DNA পরীক্ষা করে দেখা হবে। এই কশেরুকার মালিককেই গুলি করে হত্যা করা হয় ও বলা হয় এই ব্যক্তিই বুথ। ২০১৩ এর মার্চে National Museum of Health and Medicine জানিয়ে দেয়, তারা তাদের কাছে রক্ষিত মেরুদণ্ডের কশেরুকা পরীক্ষা করে দেখতে দিবে না। কারণ এর ফলে এটির ক্ষতিসাধন হতে পারে। দৃশ্যত ওর্লোয়েকের আর কিছুই করার রইলো না। আর আমাদেরও ইতিহাসের সবচেয়ে রহস্যময় ঘটনার দ্বার উন্মোচনের জন্য আরো কতদিন অপেক্ষা করতে হবে জানা নেই!