দেখতে দেখতে আরেকটি বছরের সমাপ্তিঘণ্টা বাজছে কানের সামনে। গোটা ২০১৭ সাল জুড়েই অসাধারণ সব ব্যক্তিগত ও দলগত সাফল্যের দেখা পেয়েছে ক্রিকেট বিশ্ব। ক্রিকেটারদের পুরো বছরের পারফরম্যান্স হিসেব করে বছর শেষে একটি সম্ভাব্য সেরা একাদশ তৈরি করা একপ্রকারের রীতিতে পরিণত হয়েছে। প্রিয়লেখাও চেষ্টা করেছে ২০১৭ সালের সেরা টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-২০ একাদশ তৈরি করার। আজ প্রথম পর্বে থাকছে বর্ষসেরা টেস্ট একাদশ।
যেকোনো সেরা একাদশ ঘিরেই থাকে বিতর্ক, কোন একাদশই সম্পূর্ণভাবে নিখুঁত হওয়া সম্ভব নয়। এই একাদশ তৈরির ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। প্রথমত দেখা হয়েছে খেলোয়াড়ের ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স। এর সাথে বিবেচনায় রাখা হয়েছে দলে সেই খেলোয়াড়ের ইমপ্যাক্ট ও কোন পজিশনে খেলে সে সাফল্য অর্জন করেছে। যে যেই পজিশনের খেলোয়াড় তাঁকে সেই পজিশনে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টাই করা হয়েছে এই একাদশ তৈরির ক্ষেত্রে।
টপ অর্ডার:
ডিন এলগার (সাউথ আফ্রিকা)
বর্ষসেরা টেস্ট একাদশে ওপেনার হিসেবে প্রথম পছন্দ সাউথ আফ্রিকান ওপেনার ডিন এলগার। ২০১৭ সালে টেস্ট ক্রিকেটে তৃতীয় সর্বোচ্চ রানের মালিক এলগার, ওপেনারদের মধ্যে সর্বোচ্চ। ১১ টেস্টের ২০ ইনিংসে ব্যাট করে ১০৯৭ রান করেছেন এলগার। গড় ৫৪.৮৫, সর্বোচ্চ স্কোর ১৯৯। ২০ ইনিংসের মধ্যে ফিফটি আছে ৪ টি, সেঞ্চুরি ৫ টি। ম্যান অফ দ্য ম্যাচের পুরষ্কার পেয়েছেন ২ বার, ম্যান অফ দ্য সিরিজও সমানসংখ্যক। ঘরের মাটিতে এক কথায় অসাধারণ ছিলেন এই বছর এলগার। ৬ ইনিংস ব্যাট করে ৯০.১৬ গড়ে ৫৪১ রান করেছেন ঘরের মাটিতে, ৩ সেঞ্চুরির সবকয়টিই এসেছে ঘরের মাটিতে। দল জিতেছে এমন ম্যাচেও ভালো অবদান রেখেছেন এলগার। ৬ ম্যাচের ১০ ইনিংসে ৬৫.৩০ গড়ে ৬৫৩ রান করেছেন এলগার।
ডেভিড ওয়ার্নার (অস্ট্রেলিয়া)
প্রিয়লেখার বর্ষসেরা টেস্ট একাদশে দ্বিতীয় ওপেনারের জায়গাটি পূরণ করেছেন অজি ওপেনার ডেভিড ওয়ার্নার। নিজের সেরা ফর্মে না থাকলেও একেবারে খারাপও করেননি ওয়ার্নার, ১০ ম্যাচে ১৯ ইনিংসে ব্যাট করে ৮০৮ রান তাঁর। গড়টা একটু কম ছিল এই বছর, ক্যারিয়ার গড় যেখানে ৪৭.৯৭, ২০১৭ সালে গড় সেখানে ৪৪.৮৮। ফিফটি ও সেঞ্চুরি সমান ৩ টি করে। সর্বোচ্চ স্কোর ১২৩। ম্যাচসেরা ও সিরিজসেরা হয়েছেন ১ বার করে। ১৯ ইনিংসের মধ্যে ঘরের মাটিতে খেলেছেন ৭ ইনিংস, সেই ৭ ইনিংসে ৬০.৬৬ গড়ে করেছেন ৩৬৪ রান। ৩ সেঞ্চুরির ১ টি এসেছে ঘরের মাটিতে, বাকি দুইটি বিদেশে। সর্বোচ্চ স্কোরটিও এসেছে বিদেশের মাটিতেই। দল জিতেছে এমন ম্যাচে ওয়ার্নারের অবদান উল্লেখযোগ্য। দল জিতেছে এমন ৬ ম্যাচে ৫৪.৩০ গড়ে রান করেছেন ৫৪৩।
চেতেশ্বর পূজারা (ভারত)
ওয়ান ডাউনে চেতেশ্বর পূজারা ছাড়া এই বছরের বর্ষসেরা টেস্ট একাদশ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ২০১৭ সালে টেস্ট খেলা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে এখনো পর্যন্ত সর্বোচ্চ রানের মালিক পূজারা (স্টিভেন স্মিথের হাতে এখনো একটি টেস্ট বাকি, পূজারাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার সব সম্ভাবনা তাঁর আছে)। কিন্তু তাতেও পূজারার জায়গার হেরফের হবেনা এতটুকুও। পুরো বছর জুড়েই ব্যাট হাতে অনবদ্য ছিলেন এই ভারতীয়। অবিশ্বাস্য ধারাবাহিক ব্যাটিংয়ে দলকে দিয়েছেন নির্ভরতা। ১১ ম্যাচের ১৮ ইনিংসে ৬৭.০৫ গড়ে ১১৪০ রান পূজারার। ৫ ফিফটির পাশাপাশি সেঞ্চুরি আছে ৪ টি, সর্বোচ্চ স্কোর ২০২। দেশে এবং বিদেশে দুই জায়গাতেই সমান দুর্দান্ত ছিলেন পূজারা। দেশের মাটিতে ৮ ম্যাচের ১৪ ইনিংসে ৬৩.৯২ গড়ে ৮৩১ রান, আর বিদেশের মাটিতে ৩ ম্যাচের ৪ ইনিংসে ৭৭.২৫ গড়ে ৩০৯ রান। দল জিতেছে এমন ম্যাচে পূজারার অবদান চোখে পড়ার মত। দল জিতেছে এমন ৭ ম্যাচে ৩ সেঞ্চুরির সাথে ৭৫.৫০ গড়ে ৭৫৫ রান করেছেন।
মিডল অর্ডার:
স্টিভেন স্মিথ (অস্ট্রেলিয়া)
চার নম্বরের জন্য খেলোয়াড় বাছাই করতে গিয়েই সবচেয়ে বেশি বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। বিরাট কোহলি, স্টিভেন স্মিথ, হাশিম আমলা, জো রুট- কেউ যে কারোর চেয়ে কম যাননি! তবে শেষ পর্যন্ত বর্ষসেরা একাদশের চার নম্বর জায়গাটা পেয়েছেন অজি অধিনায়ক স্টিভেন স্মিথ। যে রানের ফোয়ারা ছুটিয়েছেন, তাঁকে বাদ দিলে অন্যায়ই হত সেটা!
এখনো পর্যন্ত এই বছরের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের তালিকায় আছেন দুইয়ে, তবে মেলবোর্নে বক্সিং ডে টেস্টে চেতেশ্বর পূজারাকে যে ছাড়িয়ে যাবেন, একটু ঝুঁকি নিয়ে সে কথা বোধহয় বলেই দেয়া যায়। দুজনের মধ্যের ব্যবধান যে মাত্র ১৩ রানের!
এবারের অ্যাশেজকে ধরা হচ্ছিল সময়ের অন্যতম সেরা দুই ব্যাটসম্যান স্মিথ ও রুটের লড়াই। লড়াইয়ে কে জয়ী, ইতোমধ্যে সবারই জানা। শুধু অ্যাশেজেই নয়, বছরজুড়েই হেসেছে স্মিথের ব্যাট। ফলাফল, ১০ ম্যাচের ১৮ ইনিংসে ৭০.৪৩ গড়ে ১১২৭ রান। পঞ্চাশ পার করার পড় সেটিকে সেঞ্চুরির দিকে টেনে নিয়ে গেছেন বেশিরভাগ সময়ই, যার সাক্ষ্য দেবে দুই ফিফটির পাশে ৫ সেঞ্চুরি। ম্যাচসেরা হয়েছেন ২ বার, সিরিজসেরা ১ বার।
ঘরের মাটিতে গড়ের দিক থেকে তো ‘ব্র্যাডম্যানীয় গড়’কেও ছাড়িয়ে গেছেন এ বছর। ৪ ম্যাচের ৬ ইনিংসে ব্যাট করে ৫০৯ রান করেছেন এখনো পর্যন্ত, গড় ১০১.৮০! বিদেশের মাটিতেও গড় পঞ্চাশের উপরে। ১২ ইনিংসে ব্যাট করে ৫৬.১৮ গড়ে ৬১৮ রান। দলের জয়ে অবদান রাখার ক্ষেত্রেও অধিনায়কের মতই সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন স্মিথ। দল জিতেছে এমন ৬ ম্যাচে ৭৯.৮৮ গড়ে করেছেন ৭১৯ রান। স্মিথকে তাই রাখতেই হত একাদশে!
বিরাট কোহলি (ভারত) ; অধিনায়ক
স্মিথের পড় মিডল অর্ডারে আরেকজন সফল ব্যাটসম্যানের নাম বলতে হলে সবার আগেই আসবে বিরাট কোহলির নাম। সদ্য সমাপ্ত শ্রীলঙ্কা সিরিজের ৩ টেস্টে করেছেন ৩ টি বিশ্বরেকর্ড! তবে বিরাট তাঁর বেশিরভাগ ইনিংসই খেলেছেন চার নম্বরে, যেখানে এরই মধ্যে জায়গা পেয়েছেন স্টিভ স্মিথ। আবার কোহলির যা পারফরম্যান্স এই বছরে, তাতে করে তাঁকে বাদ দেয়ার কোন সুযোগ নেই। বাধ্য হয়েই তাই কোহলির স্বাভাবিক ব্যাটিং পজিশনের চেয়ে এক ধাপ নিচে নামিয়ে পাঁচে রাখতে হয়েছে ভারত অধিনায়ককে।
পুরো বছর জুড়েই বোলারদের কচুকাটা করে ছেড়েছেন, নাভিশ্বাস উঠিয়েছেন প্রতিপক্ষ বোলারদের। প্রতিপক্ষ অধিনায়কের কাছে বিরাট কোহলি যেন এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। ২০১৭ সালে ১০ ম্যাচে ১৬ ইনিংসে ব্যাটিং করে ৭৫.৬৪ গড়ে ১০৫৯ রান করেছেন কোহলি। ফিফটি ১ টি, সেঞ্চুরি ৫ টি, তার মধ্যে ৩ টিকেই রূপ দিয়েছেন ডাবল সেঞ্চুরিতে। ম্যাচসেরার পুরষ্কার জিতেছেন ৩ বার, সিরিজসেরা ১ বার।
দেশের মাটিতে খেলতে নামলে কোহলির গড় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৮১.৬৩, রান ৮৯৮। বিদেশের মাটিতে এই বছর খুব বেশি খেলেনি ভারত, তাও ৪ ইনিংসে ৫৩.৬৬ গড়ে রান করেছেন ১৬১। দল জিতেছে এমন ম্যাচে কোহলির অবদান স্মিথের চেয়েও বেশি। ভারত জিতেছে এমন ৬ ম্যাচে ৮০.৩৭ গড়ে ৬৪৩ রান করেছেন। তাঁকে বাদ দেয়ার সাধ্য কোথায়!
অলরাউন্ডার:
সাকিব আল হাসান (বাংলাদেশ)
একাদশের অলরাউন্ডার হিসেবে আসলে সাকিব আল হাসানের চেয়ে যোগ্য কেউ ছিলেন না এই বছর। ব্যাটে বলে এমন ভারসাম্যপূর্ণ পারফরম্যান্স আর কোন অলরাউন্ডার দেখাতে পারেননি এই বছর। ব্যাট হাতে ৭ ম্যাচের ১৪ ইনিংসে ৪৭.৫০ গড়ে ৬৬৫ রান করেছেন। ৩ ফিফটির পাশাপাশি সেঞ্চুরি আছে দুইটি, একটিকে পার করিয়েছেন ডাবল সেঞ্চুরির ঘরও। ম্যাচসেরা ও সিরিজসেরা হয়েছেন ১ বার করে। ৬ নম্বরে নেমে প্রায় ৫০ গড়ে রান করে দিবেন, এমন কেউ যেকোনো দলের জন্যই সম্পদ হবেন।
ব্যাটের মত বল হাতেও সফল সাকিব। ৭ ম্যাচে ৩৩.৩৭ গড়ে উইকেট পেয়েছেন ২৯ টি। ৫ উইকেট পেয়েছেন দুইবার। অস্ট্রেলিয়াকে হারানো, শততম টেস্টে শ্রীলঙ্কাকে হারানো দুটিতেই অবদান রেখেছিলেন সাকিব।
উইকেটকিপার:
কুইন্টন ডি কক (সাউথ আফ্রিকা)
একাদশে উইকেট কিপার হিসেবে থাকবেন প্রোটিয়া কিপার কুইন্টন ডি কক। ২০১৭ সালে উইকেটের পেছনে সবচেয়ে বেশি ডিসমিসাল ডি ককের। ১১ ম্যাচে ডিসমিসালের হাফ সেঞ্চুরি ছুঁয়েছেন ডি কক, ৪৫ টি ক্যাচের পাশাপাশি আছে ৫ টি স্ট্যাম্পিং। গ্লাভসের সাথে ব্যাট হাতেও সলিড পারফরম্যান্স দিয়েছেন ডি কক। ১১ ম্যাচের ১৮ ইনিংসে ৩৭.১৮ গড়ে ৫৯৫ রান করেছেন ডি কক। ৪ ফিফটির পাশে আছে ১ টি সেঞ্চুরিও। সাত নম্বরে নেমে অনেক সময় দ্রুত রান তুলতে হয়, সেদিকেও সফল ডি কক। রান করেছেন ৭৩.৭২ স্ট্রাইক রেটে।
বোলার:
নাথান লায়ন (অস্ট্রেলিয়া)
একাদশে একমাত্র স্পিনার হিসেবে রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে টপকে একাদশে ঢুকবেন অজি স্পিনার নাথান লায়ন। ২০১৭ সালে সব বোলার মিলিয়েই সর্বোচ্চ উইকেটের মালিক লায়ন। ১০ ম্যাচে উইকেট পেয়েছেন ৬০ টি, ম্যাচপ্রতি ৬ উইকেট! প্রতি ২৩ রান খরচায় একটি করে উইকেট নিয়েছেন, একটি উইকেট পাওয়ার জন্য গড়ে বল করতে হয়েছে ৫০ টি। ইনিংসে ৫ উইকেট পেয়েছেন ৫ বার, ম্যাচসেরা ও সিরিজসেরা ১ বার করে। দেশের চেয়ে বিদেশের মাটিতেই বেশি ভয়ংকর ছিলেন লায়ন। দেশে উইকেট পেয়েছেন ১৯ টি, বাইরে ৪১ টি। দল জিতেছে এমন ৬ ম্যাচে উইকেট পেয়েছেন ৩৭ টি।
কাগিসো রাবাদা (সাউথ আফ্রিকা)
পেসারদের মধ্যে ২০১৭ সালে সবচেয়ে বেশি উইকেটের মালিক কাগিসো রাবাদা। ১০ ম্যাচে ১৮ ইনিংসে বল করে ৫৪ উইকেট পেয়েছেন রাবাদা। ইনিংসে ৫ উইকেট পেয়েছেন ৩ বার। উইকেটপ্রতি রান দিয়েছেন মাত্র ২১, বল করতে হয়েছে গড়ে ৩৮ টি করে। ৫৪ উইকেটের মধ্যে দেশের মাটিতে উইকেট পেয়েছেন ৩০ টি, বাইরের দেশে ২৪ টি। দল জিতেছে এমন ৫ ম্যাচে ৩৩ উইকেট পেয়েছেন রাবাদা।
জেমস অ্যান্ডারসন (ইংল্যান্ড)
নতুন বলে রাবাদার সঙ্গী হিসেবে থাকছেন ইংলিশ কিংবদন্তি জেমস অ্যান্ডারসন। ১০ ম্যাচে ১৯ ইনিংসে বল করে ৫১ উইকেট অ্যান্ডারসনের, বক্সিং ডে টেস্টে সুযোগ থাকছে উইকেট সংখ্যা আরও বাড়িয়ে নেয়ার। ইনিংসে ৫ উইকেট পেয়েছেন ৪ বার। উইকেটপ্রতি বল করতে হয়েছে ৪৩ টি, রান খরচা করতে হয়েছে প্রায় ১৭ করে। ৫১ উইকেটের ৩৯ টি পেয়েছেন দেশের মাটিতে। দল জিতেছেন এমন ৫ ম্যাচে ২৭ উইকেট পেয়েছেন।
নিল ওয়াগনার (নিউজিল্যান্ড)
একাদশের শেষ সদস্য ও থার্ড সীমার হিসেবে থাকছেন কিউই পেসার নিল ওয়াগনার। বাঁহাতি পেসার হওয়ার কারণে ও পুরোনো বলে বল সুইং করানোর ক্ষমতার কারণে ওয়াগনারের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিতভাবেই দলে ভারসাম্য বাড়াবে। এই বছর ৭ ম্যাচে উইকেট পেয়েছেন ৩৬ টি। প্রতি উইকেটের জন্য গড়ে খরচ করতে হয়েছে ২৫ রান, বল করতে হয়েছে গড়ে ৪৬ টি করে। দল জিতেছে এমন ৪ ম্যাচে উইকেট পেয়েছেন ২৪ টি।