আর্নেস্তো ভালভার্দে কি এর চেয়ে ভালো বড়দিনের উপহার আর চাইতে পারতেন? বোধহয় না। বড়দিনের ছুটির আগে তাঁকে এবং বার্সেলোনার সমর্থকদের সম্ভাব্য সেরা উপহারটাই দিয়েছেন লিওনেল মেসি ও তাঁর কোম্পানি। প্রথমার্ধের সংগ্রামের পর দ্বিতীয়ার্ধে রিয়ালকে নিয়ে স্রেফ ছেলেখেলা করেছেন মেসিরা। যার প্রতিফলন পড়েছে স্কোরলাইনেও, বার্সেলোনা ৩-০ রিয়াল মাদ্রিদ! কাতালান স্বাজাত্যবোধের কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হল অভিজাত মাদ্রিদ।
এল ক্লাসিকোর আবেদন এমনিতেই অন্যরকম। তবে এই ক্লাসিকোটির বিশেষত্ব ছিল দুইটি। প্রথমত, এই ম্যাচের ফলাফলের উপরই অনেকটা নির্ভর করে ছিল মাদ্রিদের এবারের লীগ ভাগ্য। আর দ্বিতীয়ত, দুই প্রদেশের অহংবোধের লড়াই। মাদ্রিদের শোষণের বিরুদ্ধে অনেকদিন ধরেই সোচ্চার কাতালান প্রদেশ। স্পেন থেকে আলাদা হয়ে সার্বভৌমত্ব দাবি করে গণভোটের আয়োজনও করেছে। গণভোট নিয়ে সাংঘর্ষিক অবস্থানে ছিল দুই পক্ষই, রক্তারক্তি কান্ডও ঘটেছে। নিজেদের দাবি প্রকাশের সবচেয়ে ভালো মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয়া ফুটবল দিয়ে কাতালানবাসীর হয়ে তাই একটা জবাব দেয়ার ছিল বার্সেলোনার। জবাবটা বোধহয় এর চেয়ে ভালোভাবে আর দেয়া যেত না!
অথচ ম্যাচের শুরুটা কিন্তু দিয়েছিল অন্য আভাসই। ইস্কোকে বেঞ্চে রেখে মাতেও কোভাচিচকে একাদশে রেখে কিছুটা চমকে দিলেও শুরু থেকেই খুব আত্মবিশ্বাসী আর গোছানো লাগছিল জিদান শিষ্যদের। বার্সার খেলোয়াড়দের পায়ে যেন বলই যাচ্ছিল না। লিওনেল মেসি বলে প্রথমবার পা ই ছোঁওয়াতে পেরেছেন পঞ্চম মিনিটে! অবশ্য তার আগেই বার্নাব্যুর ফ্যানদের গোলের আনন্দে প্রায় ভাসিয়েই ফেলেছিলেন রোনালদো। হেডে টের স্টেগেনকে পরাস্ত করলেও পরিষ্কার অফসাইডে থাকায় বাতিল হয় তাঁর গোল। গোল বাতিল হলেও প্রথমার্ধে বার্সার চেয়ে পরিষ্কারভাবেই এগিয়ে ছিল লস ব্লাঙ্কোসরা। গোলের বেশ কয়েকটি ভালো সুযোগও পেয়েছিল, কিন্তু কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন টের স্টেগেন, কিংবা কখনো গোলপোস্ট। ১০ মিনিটে ডি বক্সের ভেতর একদম ফাঁকায় পেয়েও বলে পা ই ছোঁয়াতে পারেননি রোনালদো।
এরপর আস্তে আস্তে খোলস ছেড়ে বের হতে শুরু করেন মেসি, বার্সাও ফিরতে থাকে চেনা ছন্দে। ৩০ মিনিটে প্রায় এগিয়েই গিয়েছিল তারা, গোলটা হয়নি কেইলর নাভাসের দুর্দান্ত রিফ্লেক্স সেভের কারণে। মাঝমাঠের একটু উপর থেকে মেসির দুর্দান্ত থ্রু খুঁজে নেয় পাউলিনহোকে। পাউলিনহো শটটাও নিয়েছিলেন দারুণ, কিন্তু অনবদ্য সেভ করে সে যাত্রায় বাঁচিয়েছেন নাভাস। পরমুহূর্তে প্রতিআক্রমণ থেকে বার্সার মনে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিলেন রোনালদো, এবারে রক্ষাকর্তা আরেক কিপার টের স্টেগেন। রোনালদোর দুর্দান্ত মাটি কামড়ানো শট ফিরিয়ে না দিলে এগিয়ে যেতে পারত মাদ্রিদই। বিরতির আগেই আরেকবার সুযোগ পেয়েছিল বার্সা, এবারো মেসি পাউলিনহো যুগলবন্দী। এবারে পাউলিনহোর হেড ডান দিকে ঝাঁপিয়ে পরে কর্ণারের বিনিময়ে বাঁচান নাভাস।
তবে বিরতির পরেই বিধ্বংসী রূপে ধরা দেয় বার্সা। দ্বিতীয়ার্ধে স্বাগতিকদের নিয়ে স্রেফ ছেলেখেলা করেছেন মেসিরা। গোলমুখ খুলেছে ৫৪ মিনিটে। সার্জিও বুস্কেটসের বল ধরে অনেকটা এগিয়ে গিয়ে ডান প্রান্তে সার্জিও রবার্তোকে বল দেন ইভান রাকিটিচ। বুদ্ধিদীপ্ত পাসে রবার্তো বল বাড়ান সুযোগসন্ধানী সুয়ারেজকে। নাভাসকে একা পেয়ে জালে বল ঠেলে দিতে ভুল করেননি এই উরুগুইয়ান, গোটা বার্নাব্যুকে স্তব্ধ করে দিয়ে এক গোল এগিয়ে যায় বার্সা।
চাইলে সেখান থেকেও ম্যাচে ফিরতে পারত মাদ্রিদ, কিন্তু সেই আশা শেষ হয়ে যায় ৬৪ মিনিটে। আবারো সুয়ারেজের উদ্দেশ্যে দুর্দান্ত এক থ্রু বল বারিয়েছিলেন মেসি। সহজ গোলের সুযোগটাও নাভাসের গায়ে মেরে নষ্ট করেন সুয়ারেজ। ফিরতি বল আবার সুয়ারেজের পায়ে এলে এবার তিনি মারেন বারে। সেই বল আবারো ঘুরে পাউলিনহোর পায়ে এলে গোলমুখে শট নিয়েছিলেন তিনি। নিশ্চিত গোল হতে যাওয়া সেই বল হাত দিয়ে আটকে সরাসরি লাল কার্ড দেখেন দানি কার্ভাহাল। আর সেই পেনাল্টি থেকে করা গোলে বার্সাকে ২-০ গোলে এগিয়ে তো নিয়েছেনই, মাদ্রিদকেও ম্যাচ থেকে ছিটকে দিয়েছেন ক্লাসিকোতে এই নিয়ে ২৫ তম গোলের দেখা পাওয়া মেসি।
এরপর বেল আর অ্যাসেন্সিওকে নামালেও টের স্টেগেনের খুব বেশি পরীক্ষা নিতে পারেনি মাদ্রিদ। বেল অবশ্য একবার খুব ভালো সুযোগ পেয়েছিলেন ব্যবধান কমানোর। মড্রিচের বাড়ানো বল ঠিকভাবে মারতে পারলেই গোল হত, কিন্তু পায়ে লাগাতে পারেননি ঠিকভাবে। ২-০ তেই যখন খেলা শেষ হবে মনে হচ্ছিল, তখন ইনজুরি টাইমে মেসির অ্যাসিস্টে গোল করে মাদ্রিদের আভিজাত্যবোধে শেষ পেরেকটি ঠোকেন অ্যালেক্স ভিদাল।
বার্নাব্যুতে এল ক্লাসিকো হলে মেসি যে সেটি ভালই উপভোগ করেন, তার প্রমাণ তিনি আরেকবার রাখলেন আজ। প্রথমার্ধের শুরুর দিকটা ছাড়া প্রায় পুরো ম্যাচেই দুর্দান্ত খেলেছেন মেসি। গোল, অ্যাসিস্ট তো করেছেনই, মেসিসুলভ পাসগুলোও ছিল নজরকাড়া। পুরো ম্যাচে মোট ৯ টি কী পাস দিয়েছেন, ড্রিবলের নেশা লাগিয়েছেন ৬ বার। যুদ্ধের মধ্যে আরেক খণ্ডযুদ্ধেও তাই রোনালদোকে সরাসরি ব্যবধানেই হারালেন ফুটবলের এই বরপুত্র!