ভাষা, সংস্কৃতি, পর্যটন মিলিয়ে ভারত ব্যাপক বৈচিত্র্যময় এক দেশ। বিবিসির সাবেক দিল্লী প্রতিনিধি স্যাম মিলার তার পেশাগত জীবনের অর্ধেকেরও বেশি সময় কাটিয়েছেন ভারতের মাটিতে। নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাই তিনি তুলে ধরেছেন বিবিসির পাতায়। প্রিয়লেখার পাঠকদের জন্য থাকছে সেই লেখাটি।
২০২৮ সালের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হবে ভারত:
জাতিসংঘের পূর্বানুমান অনুযায়ী, ২০২৮ সালের মধ্যে চীনকে টপকে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হবে ভারত। ততদিনে দেশটির জনসংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ১৪৫ কোটিতে। তবে ভারতের দুই প্রজন্মের মানুষ এই ব্যাপারটিকে দেখছেন দুইটি ভিন্ন দৃষ্টিতে। তুলনামূলক তরুণদের মতে, চায়নাকে জনসংখ্যার দিক থেকে ছাপিয়ে যাওয়াও ভারতের জন্য একটি অর্জন। কিন্তু বয়স্ক ব্যক্তিরা বিষয়টি নিয়ে শঙ্কিত, দেশটির জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উপরেই যে প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিবে এমন ঘটনা! জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী ২০৬০ সাল নাগাদ ভারতের জনসংখ্যা গিয়ে পৌঁছাবে ১৬০ কোটি পর্যন্ত। তবে এই শতকের শেষ দিকে এসে সেটি আবার ১৫০ কোটিতে নেমে আসবে।
এককালে এক দ্বীপ ছিল ভারত:
১০ কোটি বছর আগে, পৃথিবীতে যখন ডায়নোসরের অস্তিত্ব ছিল, বর্তমানে যেই অঞ্চল নিয়ে ভারত গঠিত, সেটি একটি দ্বীপ ছিল। গন্ডোয়ানাল্যান্ড নামে পরিচিত প্রাচীন সুপারকন্টিনেন্ট থেকে ভেঙ্গে গিয়ে আস্তে আস্তে উত্তরমুখী হতে শুরু করে অঞ্চলটি। এর প্রায় ৫ কোটি বছর পরে, ডায়নোসর ততদিনে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, ইন্ডিয়ার প্লেটের এশিয়া অঞ্চলের প্লেটের সাথে সংঘর্ষ ঘটে। এই সংঘর্ষের ফলেই উৎপত্তি হয় পৃথিবীর নবীনতম ও উচ্চতম পর্বতরাজি হিমালয়ের। এই ভারতীয় উপমহাদেশ যেই প্লেটের উপর অবস্থিত, সেই প্লেটটি ক্রমাগতই কিছুটা উত্তরমুখী হচ্ছে, আর এই কারণেই প্রতি বছর হিমালয়ের উচ্চতা কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পায়।
কোন রাষ্ট্রীয় ভাষা নেই ভারতের:
তর্কযোগ্যভাবে পৃথিবীর অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় ভারতের ভাষাগত বৈচিত্র্য অনেক বেশি। ১৯৬১ সালের হিসাব অনুযায়ী ভারতের ভাষার সংখ্যা ছিল ১৬৫২ টি। বর্তমানে ১ হাজারেরও বেশি ভাষাভাষীর মানুষ আছে ভারতে। সবচেয়ে বড় ও প্রচলিত ছয়টি ভাষা- হিন্দি, বাংলা, তামিল, তেলেগু, মারাঠি ও উর্দু, প্রত্যেকটির অন্তত ৫ কোটি করে ভাষাভাষী মানুষ আছে। ১০ হাজারের বেশি ভাষাভাষী আছে, এমন ভাষার সংখ্যা ১২২ টি।
অনেকেই হয়তো জানেন না, ভারতের কোন নির্দিষ্ট রাষ্ট্রীয় ভাষা নেই। হিন্দি ও ইংরেজি এই দুইটি দাপ্তরিক ভাষা।
মেগাসিটির দেশ ভারত:
২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, জনসংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীর শীর্ষ ২০ টি মেগাসিটির ৩ টি ভারতের, কলকাতা, দিল্লী ও মুম্বাই। ১৭ শতকে দিল্লী ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল শহর। কিন্তু ১৯৬০ এর দিকে এসে দিল্লী শীর্ষ ৩০ এর ও বাইরে চলে যায়। ২০১৫ এর হিসাব অনুযায়ী সেই দিল্লীই আবার উঠে এসেছে ৩ নম্বরে। এই হিসাব অনুযায়ী তালিকার শীর্ষস্থানটি জাপানের রাজধানী টোকিওর দখলে। তালিকায় ১৬ নম্বরে ছিল ঢাকার নামও।
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ভোটারের দেশ:
বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত ভারতে ভোটারের সংখ্যাও সবচেয়ে বেশি হবে, সেটাই স্বাভাবিক। ২০০৯ এর নির্বাচনে ৪১ কোটিরও বেশি ভোটার ভোটদানে অংশগ্রহণ করেছিল, যা দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬০%। ভোটগ্রহণের জন্য মোট ভোটকেন্দ্র ছিল ৮ লাখ ৩০ হাজার ৮৬৬ টি। এর মধ্যে গুজরাটের একটি ভোটকেন্দ্রে ভোটার ছিল মোটে ১ জন, একজন মন্দির দেখভালকারী!
ভারতের নির্বাচন কমিশনের মতে, কোন ভোটারকেই ভোটদানের জন্য ২ কিলোমিটারের বেশি ভ্রমণ করানো ঠিক না। সে কারণে কোন ভোটিং এরিয়ায় একজন ভোটার থাকলেও তার সুবিধার্থে ভোটদান কেন্দ্র বানানো হয়।
একটি নির্দিষ্ট আসনের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রার্থীর ভোটে দাঁড়ানোর রেকর্ডও ভারতের। ১৯৯৬ সালে তামিলনাড়ু রাজ্যের মোদাকুড়িচি আসনের জন্য ১০৩২ জন প্রার্থী নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন!
বিশ্বের অন্যতম মুসলিমপ্রধান দেশ ভারত:
হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবেই পরিচিত বেশি, তবে জানেন কি, বিশ্বের পাঁচটি মুসলিমপ্রধান দেশের একটি ভারত? যদিও ভারতের জনসংখ্যার ১৫% এরও কম মানুষ মুসলিম, কিন্তু এত বিশাল জনগোষ্ঠীর একটি দেশের ১৫% মানুষও কম নয়। মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষের অবস্থানের দিক থেকে ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তানের পরেই ভারতের অবস্থান। মোটামুটি সারা দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকলেও ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল হল কাশ্মীর ভ্যালি। তবে দেশটির উত্তর-পূর্ব ও পাঞ্জাব প্রদেশে মুসলিমদের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য।
মৃত্যুফাঁদ যেখানে সড়কের আঁকেবাঁকে পাতা:
উচ্চ দুর্ঘটনাপ্রবণ রাস্তার হিসাব করতে গেলে ভারত অনন্য। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল স্টাডির গবেষণা অনুযায়ী, প্রতি বছর কেবল সড়ক দুর্ঘটনায়ই ভারতে প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার মানুষ মারা যায়। নিহতদের মধ্যে ৩৭% পথচারী, ২৮% সাইকেল ও বাইক আরোহী এবং দুর্ঘটনা ঘটার ৫ মিনিটের মধ্যেই মৃত্যু ঘটে ৫৫% যাত্রীর।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি:
প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১১০০ সিনেমা মুক্তি পায় ভারতে, নাইজেরিয়ার চেয়ে যা একটু বেশি। এই সংখ্যা প্রতি বছর আমেরিকায় মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার প্রায় দ্বিগুণ, আর ব্রিটেনে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমার দশ গুণ! এক বলিউডেই প্রতি বছর গড়ে ২০০ টি করে সিনেমা মুক্তি পায়। তামিল ও তেলেগুতেও প্রায় সমান সংখ্যক সিনেমা মুক্তি পায়।
আমের রাজা ভারত:
বিশ্বের সর্ববৃহৎ আম উৎপাদনকারী ও ভোক্তা দেশ ভারত। বিশ্বের মোট উৎপাদিত আমের ৪০%ই ভারতে উৎপাদিত হয়। শতাধিক রকমের আমের চাষ হয় ভারতে, যার মধ্যে ৩০টির বেশি বাণিজ্যিকভাবে পাওয়া যায়। দেশটির জাতীয় ফলও আম।
রেকর্ড ভাঙার স্বর্গ:
রেকর্ড ভেঙ্গে নতুন নতুন রেকর্ড গড়ার ব্যাপারে বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় ভারতের সুখ্যাতি আছে। গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ডসের হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর নতুন রেকর্ড করার ব্যাপারে আমেরিকা ও ব্রিটেনের পরের স্থানটিই ভারতের। তবে এমন কিছু অদ্ভুত রেকর্ড আছে, যা গিনেস বুকে স্থান পায় না। এর একটি হল, গবাদি পশুর গোবর দিয়ে সবচেয়ে দীর্ঘ মালা বানানোর রেকর্ড! (প্রায় ২ কিলোমিটার লম্বা মালা)।
বিবিসি অবলম্বনে। ছবি ক্রেডিট: গেটি ইমেজ ও বিবিসি