আফ্রোদিতি বা আফ্রোদাইতি হলেন সৌন্দর্য, প্রেম, বাসনা, এবং আনন্দের দেবী। স্বর্গদেবতা ও দেবতাধিরাজ জিউসের কন্যা আফ্রোদিতি ছিলেন অনিন্দ্য সুন্দরী। গ্রীসের বারো অলিম্পিয়ানের মধ্যে বাবা জিউসের পরে তিনিই সর্বাধিক আলোচিত।
অপরুপ সৌন্দর্যের কারণে আবহমান কাল ধরে তাকে বন্দনা করা হতো সৌন্দর্য ও প্রেমের দেবী হিসেবে। তবে একসময় আফ্রোদিতিকে গ্রিকরা সমুদ্রের দেবী হিসেবে পূজা করত। রোমান পুরাণে তার নাম ভেনাস। রোমে তিনি তিন মাতৃদেবীর অন্যতম এবং সেখানেও তিনি প্রেমের দেবী রূপে পূজিত। তিনি ব্যাবিলনীয় এবং আসিরীয় পুরাণের প্রেম ও যুদ্ধের দেবী ইশতারের সমতুল্য। প্রাচীন গ্রিসের স্পার্টায় তিনি প্রেম ও যুদ্ধদেবী হিসেবে পূজিত হতেন। তিনি ছিলেন দেবীদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী।
আফ্রোদিতির জন্ম পরিচয় নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। হেসিওডের থিওগনি অনুসারে আফ্রোদিতির জন্ম সমুদ্রের ফেনা বা আফ্রোস এবং ইউরেনাসের বিচ্ছিন্ন যৌনাঙ্গ থেকে জন্মগ্রহণ করেন। অন্যদিকে হোমার অবশ্য তার ইলিয়াদে আফ্রোদিতিকে জিউস ও দাইওনের কন্যা বলে বর্ণনা করেছেন।
সিথেরা দ্বীপের নিকটবর্তী সমুদ্রে ফেনাপুঞ্জ থেকে জন্মলাভ করেন আফ্রোদিতি। তখন তিনি ছিলেন একটি ঝিনুকের মধ্যে। ঝিনুকটি ভাসতে ভাসতে সাইপ্রাস দ্বীপের কাছে চলে যায়। আর সেই ঝিনুকের ভেতর থেকেই পূর্ণ যৌবনা দেবী আফ্রোদিতি বেরিয়ে আসেন। আর এ কারণে দুটি দ্বীপই পবিত্র দ্বীপ হিসেবে গণ্য হয়।
প্রাচীন দু-একটি পুরাণে আফ্রোদিতিকে পোশাক পরিহিতা হিসেবে বর্ণনা করা হলেও অধিকাংশ পুরাণের বর্ণনায় তিনি নিরাবরণা। দেবরাজ জিউসের ধারণা ছিল পরমা সুন্দরী আফ্রোদিতিকে বিয়ে করার জন্য দেবতাদের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যাবে। তাই তিনি তড়িঘড়ি করে দেবতাদের কারিগর খঞ্জ হেফাস্টাসের সঙ্গে আফ্রোদিতির বিয়ে দিয়ে দেন। এ কুৎসিতদর্শন দেবতার স্ত্রী হয়ে আফ্রোদিতি মোটেই সুখী হতে পারেননি। ফলে প্রেমের আশায় অন্যদের সঙ্গে জড়িয়ে যেতে থাকলেন আফ্রোদিতি। দেবীর এক প্রেমিক ছিলেন রণ দেবতা অ্যারেস। হেফাস্টাস একবার হাতেনাতে ধরে ফেলেন এ যুগলকে। দেবকারিগর এমন একটি সুন্দর খাট বানান, যা আসলে দারুণ ফাঁদ। আফ্রোদিতি আর অ্যারেস সেই খাটে শোয়া মাত্র সোনার জালে আটকে যান।
হেফাস্টাস দুজনকে জিউসের কাছে নিয়ে গেলেও দেবরাজ তাদের কোনো শাস্তি দেননি। অ্যারেস ও প্রেমদেবীর সন্তান হলেন কামদেবতা অ্যারেস, যার রোমান নাম কিউপিড এবং কন্যা হারমোনিয়া। জিউসের বার্তাবাহী দেবতা হার্মিসের সঙ্গেও দেবীর প্রেম ছিল। হার্মিসের সঙ্গে সম্পর্কের ফলে তার পুত্র হার্মাফ্রোদিতাসের জন্ম হয়। পোসাইডনসহ আরও অনেক দেবতার সঙ্গে খণ্ডকালীন প্রেম সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন আফ্রোদিতি। মর্ত্যের মানুষের সঙ্গেও দেবীর প্রেম ছিল। ট্রয়ের রাজপুত্র অ্যাংকাইসিজ ছিলেন দেবীর অন্যতম প্রেমিক। তার সঙ্গে মিলনের ফলে জন্ম নেন ইনিয়াস, যাকে বলা হয় রোমান জাতির জনক। সেজন্য রোমে তিনি মাতৃদেবী হিসেবে পূজিত হতেন। দেবীর আরেক মর্তপ্রেমিক হলেন অ্যাডোনিস।
আফ্রোদিতিকে নিয়ে সবচেয়ে বিখ্যাত কাহিনী হলো সোনার আপেলের। শ্রেষ্ঠ সুন্দরীর প্রাপ্য লেখা সোনার আপেলের জন্য প্রতিযোগিতা করেন তিন দেবী- আফ্রোদিতি, হেরা ও অ্যাথেনি। সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার বিচারক ছিলেন ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিস। হেরা ধনসম্পদ, অ্যাথেনি বীরত্বের খ্যাতি প্রদানের লোভ দেখান প্যারিসকে। আর আফ্রোদিতি বলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারীর ভালোবাসা দেবেন তাকে। প্যারিস আফ্রোদিতিকে বিজয়ী ঘোষণা করেন। আফ্রোদিতির আশীর্বাদেই প্যারিসের প্রেমে পড়েন স্পার্টার রানী ও মেনেলাউসের স্ত্রী হেলেন। হেলেন ছিলেন পৃথিবীর সেরা সুন্দরী। তার কারণেই ট্রয়ের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ট্রয় যুদ্ধে আফ্রোদিতি ট্রোজানদের সাহায্য করতে যুদ্ধ ক্ষেত্রে আসেন। কিন্তু যুদ্ধে তিনি খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি।
দেবী আফ্রোদিতির প্রতীক মরিচ, গোলাপ এবং স্কাল্প বা মাথার খুলি। তার পবিত্র পশুদের মধ্যে কবুতর এবং চড়ুই পাখি অন্তর্ভুক্ত। গ্রীসের ন্যাশনাল আর্কিওলজিক্যাল মিউজিয়ামের সবচেয়ে মূল্যবান সংগ্রহ হিসেবে সমাদৃত হয় প্রেক্সিটেলাস নির্মিত আফ্রোদিতির মূর্তি। সেই মূর্তি এতটাই জীবন্ত যে তাতে দেবীর শরীরের প্রতিটি ভাঁজ, ত্বকের উজ্জ্বলতা, এমনকি ত্বকের নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া শিরাগুলোও স্পষ্ট দেখা যায়। আফ্রোদিতি সর্বকালের সবার জন্য সাহস, প্রেম এবং গৌরবের প্রতিকৃতি।