সাংবাদিকতা যেমন মহান এক পেশা, তেমনি এই পেশায় ঝুঁকির পরিমাণও কিন্তু কম নয়। দুষ্কৃতিকারীদের টার্গেটে সবসময়ই থাকে রিপোর্টার, ফটোগ্রাফার কিংবা ব্লগাররা। বিভিন্ন রিপোর্ট করতে গিয়ে তাই অনেকসময়ই নিজেদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে হয় সাংবাদিকদের। সাংবাদিকদের মৃত্যুঝুঁকি প্রায় প্রতি বছরই বেড়ে চলেছে। ‘কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস’ নামের একটি সংস্থা কোন দেশে সাংবাদিকদের জন্য ঝুঁকি বেশি তার একটি তালিকা তৈরি করে। সেটি নিয়েই আজকের প্রিয়লেখার আয়োজন।
১৯৯২ সাল থেকে শুরু করে ২০১৭, এই ১৫ বছরে বিশ্বজুড়ে মোট ১২৬২ জন সাংবাদিকের কর্মস্থলে মৃত্যু নিশ্চিত করতে পেরেছে ‘কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস’। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাংবাদিক হত্যা করা হয়েছে ২০০৯ সালে, ৭৫ জন। আর সবচেয়ে কম ২০০২ সালে, ২১ জন। এছাড়া ১৯৯২ সালে ৪৪ জন, ১৯৯৩ সালে ৫৬ জন, ১৯৯৪ সালে ৬৬ জন, ১৯৯৫ সালে ৫১ জন, ১৯৯৬ ও ১৯৯৭ সালে ২৬ জন, ১৯৯৮ সালে ২৪ জন, ১৯৯৯ সালে ৩৬ জন, ২০০০ সালে ২৪ জন, ২০০১ সালে ৩৭ জন, ২০০৩ সালে ৪২ জন, ২০০৪ সালে ৬১ জন, ২০০৫ সালে ৫০ জন, ২০০৬ সালে ৫৭ জন, ২০০৭ সালে ৭০ জন, ২০০৮ সালে ৪২ জন, ২০১০ সালে ৪৪ জন, ২০১১ সালে ৪৮ জন, ২০১২ সালে ৭৪ জন, ২০১৩ সালে ৭৩ জন, ২০১৪ সালে ৬১ জন, ২০১৫ সালে ৭২ জন, ২০১৬ সালে ৪৮ জন ও ২০১৭ সালে এখনো পর্যন্ত ৩৪ জন সাংবাদিকের হত্যাকান্ডের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে সংস্থাটি।
৯) মেক্সিকো- ৪২ জন
এই ১৫ বছরে মেক্সিকোতে ৪২ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। এদের বেশিরভাগের পেছনেই আছে কুখ্যাত ড্রাগ ব্যবসায়ী ও ক্রিমিনাল গ্যাংরা। নিহত সাংবাদিকদের বেশিরভাগই ছিলেন ক্রাইম বীটের রিপোর্টার। এমনই এক সাংবাদিক ছিলেন ২১ বছর বয়সী ফটোগ্রাফার লুইস এমানুয়েল রুইজ। মাত্রই আগের বছর সাংবাদিকতায় পুরস্কার পাওয়া রুইজকে তার কাজিন হুয়ান গোমেজ মেলেন্দেজ ও জনপ্রিয় টিভি শো উপস্থাপক হোসে লুইজ মেলেন্দেজ সহ অপহরণ করা হয়। অপহরণের কিছুদিন পর তিনজনকেই মাথায় গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। লাশের পাশেই ছিল খুনীদের বীভৎস বার্তা, ‘জেতাস এর বিরুদ্ধে যাওয়া বন্ধ কর’। জেতাস ছিল ওই সময়ের অন্যতম ভয়ংকর ড্রাগ ডিলার। তাদের এমনই ক্ষমতা ছিল, পুলিশের উপস্থিতিতে ক্রাইম সীন থেকে লাশ সরিয়ে নিয়ে চলে যেত তারা!
৮) কলম্বিয়া- ৪৭ জন
দক্ষিণ আমেরিকার দেশ কলম্বিয়ায় এই ১৫ বছরে খুন হয়েছেন ৪৭ জন সাংবাদিক। মূলত প্যারামিলিটারি সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করা সাংবাদিকদেরই লক্ষ্য বানিয়েছে সন্ত্রাসীরা।
পলিটিকাল স্যাটায়ারিস্ট জেমি গার্জন বোগোটা রেডিওনেট নামক বেতারে একটি মর্নিং শো করতেন। ওই অনুষ্ঠানে তিনি গেরিলা কিডন্যাপিংয়ে জিম্মিকৃত লোকেদের মুক্তি প্রার্থনা করতেন। ১৯৯৯ সালের ১৩ আগস্ট কর্মস্থলে আসার পথে বাইকে করে দুজন সন্ত্রাসী এসে অতর্কিতে হামলা চালায় গার্জনের উপর, তার মাথায় ও বুকে গুলি করে হত্যা করে তাকে। গার্জন আগে থেকেই ডানপন্থী প্যারামিলিটারি গ্রুপ ইউনাইটেড সেলফ ডিফেন্স ফোর্সেস অফ কলম্বিয়া এর নেতা কার্লোস কাস্তানোর টার্গেট ছিলেন। যেদিন গার্জনকে হত্যা করা হয়, তার ঠিক পরের দিনই কাস্তানোর সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রেখেছিলেন গার্জন ও তার সহকর্মীরা। ২০০০ সালে কলম্বিয়া সরকার কাস্তানোকে গার্জনের খুনের মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে।
৭) রাশিয়া- ৫৮ জন
গত ১৫ বছরে রাশিয়ায় যে ৫৮ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে, তাদের বেশিরভাগই প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিক। রাজনীতি, দুর্নীতি, যুদ্ধ, ক্রাইম, অর্থনীতি কোন বীটের সাংবাদিকদেরই রেহাই দেয়নি সন্ত্রাসীরা।
মস্কোভিত্তিক একটি পত্রিকার ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ছিলেন অ্যানাস্থেশিয়া বাবুরোভা। ২০০৯ সালের ১৯ জানুয়ারি তিনি বিখ্যাত মানবাধিকার উকিল স্তানিসলাস মার্কেলভের সংবাদ সম্মেলন কভার করে ফিরছিলেন। ফেরার পথেই ক্রেমলিনের সামনে ভরদুপুরে আক্রমণের শিকার হন বাবুরোভা ও মার্কেলভ দুজনেই। দুইজন দুষ্কৃতিকারী প্রথমে পেছন থেকে এসে মার্কেলভকে গুলি করে, বাঁধা দিতে গেলে বাবুরোভাকেও গুলি করে হত্যা করা হয়।
৬) আলজেরিয়া- ৬০ জন
ক্যামেরা অপারেটর থেকে শুরু করে মালিক কিংবা প্রকাশক, কেউই বাদ যায়নি আলজেরিয়ার সন্ত্রাসীদের হাত থেকে। গৎ ১৫ বছরে অন্তত ৬০ জন সাংবাদিককে খুন করা হয়েছে দেশটিতে। স্থানীয় একটি পত্রিকায় কাজ করা তিন সাংবাদিককে রাজধানী আলজিয়ার্সে বোমা বিস্ফোরণে হত্যা করা হয়। যেই ভবনে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়, ওই ভবনেই আরও ৩ টি পত্রিকার অফিস ছিল, এবং ওই হামলায় আরও ১৫ জন নিহত হয়।
৫) পাকিস্তান- ৬০ জন
যুদ্ধ, রাজনীতি ও দুর্নীতি নিয়ে কাজ করা ৬০ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে পাকিস্তানে, এবং এই ৬০ জনের সকলেই পুরুষ সাংবাদিক। ২০০৫ সালের ডিসেম্বরে ফ্রিল্যান্স রিপোর্টার হায়াতুল্লাহ খানকে বন্দুকের মুখে অপহরণ করে ৫ বন্দুকধারী। ছয় মাস পরে হ্যান্ডকাফে হাত বন্ধ অবস্থায় অসংখ্য গুলিতে ঝাঁঝরা হওয়া হায়াতুল্লাহর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। হায়াতুল্লাহর ‘অপরাধ’ ছিল, অপহরণের আগের দিন এক মিসাইল হামলায় আল-কায়েদার সিনিয়র সদস্য হামজা রাবিয়া নিহত হয়। পাকিস্তান সরকার সেটিকে ঘরের ভেতর বোমা বানানোর সময় বিস্ফোরণে মৃত্যু বলে চালিয়ে দিয়ে চেয়েছিল। কিন্তু হায়াতুল্লাহ ফাঁস করে দেন, এটি আসলে আমেরিকার ড্রোন হামলা ছিল। হায়াতুল্লাহর মরদেহে যে হ্যান্ডকাফ পাওয়া গিয়েছিল, সেটি ছিল পাকিস্তানের ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির ব্যবহৃত হ্যান্ডকাফ।
৪) সোমালিয়া- ৬৪ জন
কোন কার্যকর সরকার কিংবা গঠনতন্ত্র না থাকায় ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন সোমালিয়াকে বলে থাকে ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’। সেখানে যে সাংবাদিকদের জীবনের ঝুঁকি থাকবে এ আর আশ্চর্যের কি! সাংবাদিকতা পেশার সাথে জড়িত যে কেউই সেখানে প্রতিনিয়ত হুমকির মুখে থাকেন। অর্ধেকের বেশি হত্যাকান্ডের দায়ভার চাপানো হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর উপর। মোগাদিসু ক্যাফেতে আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হন লিবান আলী নূর সহ আরও তিন সাংবাদিক। বিকেল ৫ টার দিকে ক্যাফেতে ঢুকে দুইজন লোক আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়, আর এতে চার সাংবাদিক সহ মোট ১৪ জন নিহত ও ২০ জন গুরুতর আহত হয়।
৩) ফিলিপাইন- ৭৮ জন
অর্ধেকেরও বেশি সাংবাদিককে বন্দী করে ও নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে ফিলিপাইনে। ২০১০ সালে নির্বাচনের সময় একটি দলকে নিয়ে সোজাসুজি কথা বলায় ২০১১ সালের ১৩ জুন নির্মমভাবে হত্যা করা হয় সাংবাদিক রোমেও ওলেয়াকে। মারার আগে ওলেয়াকে তার বাসায় হুমকি পাঠানো হয়। ওলেয়ার স্ত্রী হাতজোড় করে ওলেয়াকে বলেছিলেন এত সোজাসাপ্টা নিউজ না করতে। জবাবে ওলেয়া বলেছিলেন, ‘আমি যদি না করি, তাহলে আর কেউই করবে না’। নিজের কাজের প্রতি নিবেদিত থাকার দাম ওলেয়াকে চুকাতে হয়েছিল নিজের প্রাণ দিয়ে।
২) সিরিয়া- ১১৪ জন
পাঁচ বছর আগেও এই তালিকায় সিরিয়ার অবস্থান ছিল অষ্টম, কিন্তু গত পাঁচ বছরে এত সাংবাদিক হত্যা করা হয়েছে যে দেশটি এখন তালিকার দুই নম্বরে। স্রেফ গত ৫ বছরেই দেশটিতে হত্যা করা হয়েছে ৮৫ জন সাংবাদিককে! বেশিরভাগ সাংবাদিকই মুখোমুখি ক্রসফায়ারে পরে মারা গেছেন। সিরিয়ায় চলা গৃহযুদ্ধের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে দেশটিতে সাংবাদিক হত্যার সংখ্যা বেড়েছে।
১) ইরাক- ১৮৬ জন
সাংবাদিকদের জন্য সবচেয়ে ভীতিকর দেশ ইরাক। গত ১৫ বছরে ইরাকেই সবচেয়ে বেশি ১৮৬ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। যুদ্ধমধ্যবর্তী ক্রসফায়ারে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন অনেক সাংবাদিক। নিহত সাংবাদিকদের মধ্যে বেশিরভাগই টেলিভিশন সাংবাদিক। ২০০৭ সালে আদনান আল সাফি নামের এক সাংবাদিক কাজের পর বাগদাদ বাস স্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছিলেন বাসায় ফেরার জন্য। হঠাৎই ছাদের উপর থেকে টার্গেট করে গুলি করে হত্যা করা হয় আদনানকে।
লিস্টভার্স ও সিপিজে.ওআরজি অবলম্বনে