কলকাতার ইডেনে সেবার এক বড় উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ও সুরকার ভি বালসারার জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। ভি বালসারার অনুষ্ঠানের পর ‘নির্বাক কৌতুক’ পরিবেশনের জন্য নাম ঘোষণা করা হয়েছে এক অপরিচিত বাঙালি তরুণের। দর্শকরা উঠল খেপে। এত জমজমাট একটা অনুষ্ঠানের পর কেউ দেখতে চায়না সেই অপরিচিত তরুণের ততোধিক অপরিচিত পরিবেশনা। সে মঞ্চে ওঠার পরই শুরু হল তার উদ্দেশ্যে দর্শকদের জুতোবর্ষণ। সব জুতো এক জায়গায় জড়ো করলো সে। তারপর হাত জোড় করে অনুরোধ করলো তাকে একটা সুযোগ দেবার। ভালো না লাগলে দর্শকরা তাকে ইচ্ছামতো জুতোপেটা করতে পারবেন এমন প্রতিশ্রুতিও দিল সে। অনুষ্ঠান শুরু হল। সেদিন তার নির্বাক অভিনয়ে ফুটে উঠেছিল একটি বেকার ছেলের চরিত্র এবং ‘এক্সপ্লয়টেশন অফ রবীন্দ্রনাথ’। অভিনয় করতে করতে এতটাই বিভোর হয়ে যায় যে অভিনয়ের শেষে মঞ্চেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে। যখন জ্ঞান ফেরে তখনও চারদিক মুখরিত হাততালির শব্দে। সেদিনের এই অপরিচিত তরুণটির নাম কবি যোগেশ দত্ত – মূকাভিনয়ের বাঙালি জাদুকর বা পথিকৃৎ।
যোগেশ দত্তের জন্ম ১৯৩৫ সালে অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর সাব ডিভিশনে। আড়িয়াল খাঁ নদীর বুকে প্রকৃতির অদ্ভুত সব আবেগ চিনতে চিনতেই বড় হয়ে ওঠা। তারপর এল সেই দিন ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট। ভারতীয় উপমহাদেশে এক খুশির দিন। এত বছরের ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি। কিন্তু এই ‘মধ্যরাতের সূর্যোদয়’ বহু পরিবারকে হঠাৎ ঠেলে দিয়েছিল অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। কারণ দেশভাগ, স্বভূমে হঠাৎ পরবাসী হয়ে ওঠা। তেমনই এক পরিবার ছিল তাদের। প্রথমে নৌকা তারপর ট্রেন ধরে কোনরকমে পৌঁছানো শিয়ালদহ স্টেশনে, দেশ ছেড়ে ‘রিফিউজি’র বেশে। কোনরকমে জোগাড় করা একটা চালের ঘর। কিন্তু সেই বা কতদিন! প্রায় পরপরই মারা গেলেন বাবা, মা। ঠাঁই হল মামাবাড়িতে। মামাতো ভাইয়ের দুর্ব্যবহারে ছাড়লেন সেই ঘরও। হাওড়া স্টেশনে গিয়ে উঠে পড়লেন একটা ট্রেনে। কিন্তু টিকিটহীন যোগেশকে চেকার নামিয়ে দিলেন রামপুরহাট স্টেশনে। তারপর জীবন নির্বাহের জন্য কত বিচিত্র বৃত্তি! প্রথমে চায়ের দোকান, তারপর হোটেল, মুদির দোকান। এরমধ্যেই পরিচয় এক অধ্যাপকের সাথে। পড়াশোনাও করলেন কিছু। তখন তিনি ফারাক্কাতে। কিন্তু ঘরের টানে এবার ফিরলেন কলকাতাতেই। দাদা ভর্তি করে দিলেন স্কুলে। তার সাথে ভর্তি হলেন ‘মণিমালা’তে। বিমল ঘোষ প্রতিষ্ঠিত মণিমালাতে শেখানো হত নাচ, গান, থিয়েটার, হাতের কাজ। মণিমালাই বোধহয় কিছুটা উসকে দেয় তার শিল্পীসত্তাকে।
একদিন বসে আছেন লেকের পারে। দেখলেন দূরে মানুষেরা কথা বলছে। কিন্তু কথা শোনা যাচ্ছেনা শুধু তাদের অঙ্গভঙ্গীই দেখা যাচ্ছে। অমনি মাথায় খেলে গেল এক বুদ্ধি। কথা না বলে শুধু অঙ্গভঙ্গী দিয়ে কৌতুক করলে কেমন হয়। যেমন ভাবা তেমন কাজ। হাওড়ার এক অনুষ্ঠানে প্রথম পরিবেশন করলেন আয়নার সামনে মেয়েদের সাজগোজ করার এক নির্বাক কৌতুক। প্রথম প্রচেষ্টাতেই বাজিমাত। বছরটা ১৯৫৬, শুরু হল তার জয়যাত্রা। এরপর ইডেনের সেই অনুষ্ঠানের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। যুবসংঘের হয়ে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে শো করলেন। এরপর ১৯৬০ সালে কলকাতায় ইয়ুথ ফেস্টিভ্যালও তাকে বিশেষ পরিচিতি দেয়। প্রথমে তিনি তার এই নতুন শিল্পকলার নাম দেন ‘নির্বাক কৌতুক’। কিন্তু তিনি পরে উপলব্ধি করেন তার এই শিল্প ‘কৌতুক’-এর বাইরেও আরো কিছু। কারণ তার পরিবেশনার বিষয় শুধু হাস্যরস ছিলনা বরং সমাজ ও জীবনের অনেক নিগূঢ় সত্য উঠে আসত তার পরিবেশনায়। তাই সৃষ্টি হয় এক নতুন শব্দবন্ধ ‘মূকাভিনয়’।
আক্ষরিক অর্থে আপাদমস্তক শিল্পী এই মানুষটা তার সবচেয়ে প্রধান গুরু মানেন আয়নাকে। এছাড়া উদয়শঙ্করের ‘কল্পনা’ ও চার্লি চ্যাপলিনের সিনেমাগুলি তাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে বলে তিনি মনে করেন। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই অর্জন করা এত বিচিত্র জীবন অভিজ্ঞতার নিপুণ পর্যবেক্ষণ তাকে নিখুঁত থেকে নিখুঁততর করেছে। সারা পৃথিবীতে অনুষ্ঠান পরিবেশনা করে বেড়ানো এই মানুষটা পুরোদস্তুর বাঙালি। তাই বুলগেরিয়ার সোফিয়াতে ধুতি পাঞ্জাবি পরেই পরিবেশনা করেছিলেন ‘বার্থ অফ ডেথ’। কত বিচিত্র তার পরিবেশনার বিষয়গুলি, তার চরিত্ররা। পুরাণ থেকে প্রাত্যহিকতা- তার পরিবেশনার পরিধি এতটাই বড়। ৫৩ বছরের অভিনয়জীবনে তার অভিনীত চরিত্রের সংখ্যা প্রায় ১০০। মূলত মূকাভিনয় শিল্পী হলেও যোগেশ দত্ত কলকাতার অন্যতম বিখ্যাত নাট্যদল ‘সুন্দরম’-এর প্রতিষ্ঠাতাও।
১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন নিজের মূকাভিনয়ের দল ‘পদাবলী’। ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘যোগেশ মাইম একাদেমি’। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়েও কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন এই গুণী শিল্পী। ১৯৮৫ তে তিনি পান ‘শিরোমণি পুরস্কার’ এবং ১৯৯৩ সালে ‘সঙ্গীত নাটক একাদেমি পুরস্কার’। ভারত সরকার ১৯৮৩ সালে তার ওপর একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করে- ‘সাইলেন্ট আর্ট অফ যোগেশ দত্ত’ যা অনূদিত হয়েছে ১৪টি ভাষায়। এছাড়াও জার্মানি, ফ্রান্স ও ব্রিটেনেও তার ওপর নির্মিত হয়েছে তথ্যচিত্র।
মূকাভিনয়ের এই মুকুটহীন সম্রাট ২০০৯ সালের ২১শে আগস্ট কলকাতার রবীন্দ্রসদনে তার শেষ শো করেন। এতদিনের ব্যবহৃত শিল্পীর পোষাক মঞ্চে খুলে রেখে ভেঙে পড়েন কান্নায়। বাঁধনভাঙ্গা ভিড়ে পরিপূর্ণ প্রেক্ষাগৃহের দর্শকদের চোখেও তখন ছলছল করছে জল। তারপরেও এই মানুষটা নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন শিক্ষকতায়। বিশেষত প্রতিবন্ধী যুবক যুবতীদের বাঙময় উপস্থাপনায়। তাদের দিয়ে পরিবেশন করিয়েছেন ‘খোল দ্বার’ নামক উপস্থাপনা যা আসলে রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’র রূপান্তর। বর্তমানে এই শিল্পীর আশ্রয়স্থল রবীন্দ্রনাথ আর সারাজীবন শিখে চলার অদম্য স্পৃহা। বিখ্যাত পরিচালক মৃণাল সেনের মতে ৮২ বছরের এই যুবকের পদবী দত্ত নয় ‘মাইম’।
তথ্যসূত্রঃ
১। Silence takes a bow – Mime artist Jogesh Dutta retires from stage, The Telrgraph, August 23 , 2009.
২। মারসিউ নন, লেকই আমার মাইমের অনুপ্রেরণা: যোগেশ দত্ত, kolkata24x7 online desk on March 10, 2015