সত্যজিৎ রায়ের ভেতর বাহির – Creative IT Blog
Notice: Trying to access array offset on value of type bool in /home1/cjsmpham/_addon/priyolekha.com/wp-content/plugins/taqyeem/taqyeem.php on line 611

Notice: Trying to access array offset on value of type bool in /home1/cjsmpham/_addon/priyolekha.com/wp-content/plugins/taqyeem/taqyeem.php on line 611

Notice: Trying to access array offset on value of type bool in /home1/cjsmpham/_addon/priyolekha.com/wp-content/plugins/taqyeem/taqyeem.php on line 611

Notice: Trying to access array offset on value of type bool in /home1/cjsmpham/_addon/priyolekha.com/wp-content/plugins/taqyeem/taqyeem.php on line 611

Notice: Trying to access array offset on value of type bool in /home1/cjsmpham/_addon/priyolekha.com/wp-content/plugins/taqyeem/taqyeem.php on line 611

Notice: Trying to access array offset on value of type bool in /home1/cjsmpham/_addon/priyolekha.com/wp-content/plugins/taqyeem/taqyeem.php on line 611
Home / ইন্টারভিউ / সত্যজিৎ রায়ের ভেতর বাহির

সত্যজিৎ রায়ের ভেতর বাহির

তাঁকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। বাংলা সিনেমার ইতিহাসে অন্যতম সেরা তো বটেই, চলচ্চিত্র ইতিহাসেই তাঁর স্থান থাকবে সর্বকালের সেরাদের তালিকায়। ৩৬ টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করা কিংবদন্তি এই পরিচালকের প্রথম সিনেমা ‘পথের পাঁচালী’ ১৯৫৬ কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘Best Human Document Award’ সহ জিতেছিল ১১ টি আন্তর্জাতিক পুরষ্কার। ৩২ বার ভারতীয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার পাওয়া এই গুণী পরিচালককে ভারত সরকার ১৯৯২ সালে সে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরষ্কার ‘ভারত রত্ন’ দিয়ে সম্মানিত করে। ১৯৯২ সালেই প্রথম ভারতীয় হিসেবে জিতেছেন ‘অ্যাকাডেমী অনারারি অ্যাওয়ার্ড’। নিজের কাজ, বাংলা সিনেমা, সমালোচকদের দৃষ্টিভঙ্গি- সবকিছু নিয়েই খোলামেলা কথা বলেছেন Cineaste Magazine কে দেয়া দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকারে। পড়ার জন্য স্বাগতম জানাই সবাইকে।

‘পথের পাঁচালী’ আপনাকে ঠিক কিভাবে বদলে দিয়েছিল? বাংলাকে আরও ভালোভাবে জানতে সহায়তা করেছিল আপনাকে?

সত্যজিৎ রায়: ‘পথের পাঁচালী’ করার সময় আমি অবশ্যই গ্রামীণ জীবনকে আরও স্পষ্টভাবে আবিষ্কার করেছি। এ বিষয়ে সন্দেহ নেই কোন। আমার জন্ম-কর্ম সবই শহরে, গ্রাম সম্পর্কে এত স্বচ্ছ ধারণা তাই আমার ছিল না। গ্রামের দিকে লোকেশন খুঁজতে গিয়ে, তারপর গ্রাম খুঁজে পেয়ে সেখানে কিছু সময় কাটানোর পর আমি আস্তে আস্তে বুঝতে শুরু করি। মানুষের সাথে কথা বলা, প্রকৃতির সাথে সময় কাটানো, প্রকৃতির শব্দের সাথে সময় কাটানো- সবই সাহায্য করেছে। কিন্তু তাই বলে ব্যাপারটা এমন নয় যে যারা গ্রামে বেড়ে উঠেছে কেবল তারাই গ্রামীণ জীবন সম্পর্কে সিনেমা বানাতে পারবে। বাইরের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এসেও গ্রামীণ জীবন নিয়ে সিনেমা বানানো সম্ভব।

আপনার কাজের উপর এছাড়া আর কি কি প্রভাব ফেলেছে?

সত্যজিৎ রায়: বিভূতিভূষণের লেখা আমাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। সত্যি বলতে গ্রামীণ জীবন সম্পর্কে প্রথম আমি পথের পাঁচালী পড়েই জেনেছিলাম। আমি তাঁর সাথে একটা সংযোগ অনুভব করেছিলাম, গ্রামের প্রতি তাঁর যে দৃষ্টিভঙ্গি সেটার সাথে একটা সম্পর্ক অনুভব করেছিলাম। ‘পথের পাঁচালী’ বানানোর একটা অন্যতম প্রধান কারণ বলতে পারেন এটাকে। তাঁর বই দ্বারা আমি গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলাম।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাজ দিয়েও প্রভাবিত হয়েছিলাম। সেটা যে গ্রামীণ জীবন সম্পর্কেই হতে হবে তা প্রয়োজনীয় নয়। আমাদের সাংস্কৃতিক পটভূমিটা আসলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের একটা মিশ্রণ। শহুরে শিক্ষিত জীবন যাপনে অভ্যস্ত, ইংরেজি সাহিত্যের ক্লাসিক লেখাগুলোর সাথে পরিচয় আছে, এমন যে কারোর ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য। পাশ্চাত্যের লোকেরা আমাদের সম্পর্কে যতটা জানে, আমরা তাদের সম্পর্কে ঢের বেশি জানি। পাশ্চাত্য শিক্ষাটাকে আমরা একপ্রকার হজম করে নিয়েছি। পাশ্চাত্য সঙ্গীত, পাশ্চাত্য চিত্রকলা, পাশ্চাত্য সাহিত্য সবই ভারতে অনেক প্রভাব রাখে।

চলচ্চিত্রের বিস্তারটা আসলে পশ্চিমেই হয়েছে। আপনি যদি যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রকে বুঝতে চান, পাশ্চাত্য ও পাশ্চাত্য আর্ট ফর্ম সম্পর্কে ধারণা থাকলে আপনার জন্য সুবিধা হবে। একজন বাঙালি ফোক শিল্পী কিন্তু চলচ্চিত্রকে একটি আর্ট ফর্ম হিসেবে বুঝতে পারবে না। পাশ্চাত্য শিক্ষা থাকলে আপনাকে সেটা বাড়তি সুবিধা দেবেই।

ভারতীয় সমালোচকেরা প্রায়ই বলে থাকেন, ‘পথের পাঁচালী’ একদিক থেকে বিপ্লবী ছিল, কারণ এটি ভারতীয় সিনেমার অর্থনীতিকেই একপ্রকার পাল্টে দিয়েছিল। স্টুডিওর সহায়তা ছাড়াও যে এরকম দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবসম্পন্ন সিনেমা বানানো সম্ভব, পথের পাঁচালীই সেটি প্রমাণ করেছিল। দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের কথা তো সবাই জানে, সিনেমাটির কোন তাৎক্ষণিক প্রভাব কি ছিল?

সত্যজিৎ রায়: আমার তেমনটা মনে হয়না। দর্শক ও সমালোচকদের কাছে এটি একটি ল্যান্ডমার্ক হলেও পরিচালকেরা কিন্তু অত তাড়াতাড়ি এটিকে অনুসরণ করেননি। অন্য পরিচালকদের মাঝে এর কোন তাৎক্ষণিক প্রভাব আমি অন্তত দেখতে পাইনি। প্রভাবটা আরও অনেক পরে এসেছে। আরও অনেক পরে পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে বের হওয়া পরিচালকেরা স্বীকার করেছেন, তারা ‘পথের পাঁচালী’ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।

আপনার চলচ্চিত্রগুলো যে ভারতের বাইরেও এত ভালোভাবে গৃহীত হয়েছে, বিস্মিত হয়েছেন এতে?

সত্যজিৎ রায়: আমি কখনোই ভাবিনি আমার কোন চলচ্চিত্র, বিশেষ করে ‘পথের পাঁচালী’, সারা দেশের কিংবা দেশের বাইরের লোকেরা দেখবে। এই যে সবাই দেখেছে, এতে এটাই প্রমাণ হয়, সার্বজনীন আবেগ, অনুভূতি, চরিত্র এগুলো যদি আপনি আপনার কাজে ফুটিয়ে তুলতে পারেন, তাহলে আপনি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে যেতে পারবেন, এমনকি অবাঙ্গালিদের কাছেও পৌঁছে যেতে পারবেন।

আপনার বানানো কোন চলচ্চিত্রের উপর আপনি সবচেয়ে অসন্তুষ্ট?

সত্যজিৎ রায়: সবচেয়ে অসন্তুষ্ট বলতে গেলে ‘চিড়িয়াখানা’র কথা বলতে হয়। আমি আসলে সিনেমাটা পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়ে করেছিলাম, এটা আমার পছন্দের জায়গা ছিল না। আমার কয়েকজন সহকারীর এই সিনেমায় আমার সাথে কাজ করার কথা ছিল, কিন্তু হঠাৎই কেন জানিনা তারা আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলল। আমাকে তারা বলল সিনেমার কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে।

‘চিড়িয়াখানা’ একটি রহস্যময় গল্প, আর রহস্যময় গল্প দিয়ে ভালো সিনেমা হয়না। আমি এমন থ্রিলার সিনেমা করতে পছন্দ করি, যেখানে আপনি গল্পের শুরু থেকেই ভিলেনকে কম-বেশি চিনবেন। রহস্যময় গল্পে বেশিরভাগ সময়ই যেটা হয়, গোয়েন্দা নায়ক গল্পের শেষে এসে কথোপকথনের মাধ্যমে কিভাবে সে ক্রিমিনালকে ধরল, কোন কোন ক্লু সে ব্যবহার করেছে এগুলো বর্ণনা করতে থাকে। গল্প বলার এই ধারা আমাকে ঠিক আকর্ষণ করে না।

আর আপনার বানানো সবচেয়ে সন্তোষজনক চলচ্চিত্র?

সত্যজিৎ রায়: আমার একটি সিনেমা যদি আবার নতুন করে বানানোর সুযোগ থাকত, একদম হুবহু আগেরটার মত করে, তবে সেটি হল ‘চারুলতা’। এছাড়া ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ও বেশ ভালো। শিশুদের জন্য বানানো চলচ্চিত্রের মধ্যে ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ টা আমার পছন্দের। সিনেমাটিতে বুদ্ধিমত্তা ছিল, ‘ফিল্ম আই’ ছিল, সন্তোষজনক একটি চরিত্র ছিল, আর ছিল কিছু দুর্দান্ত অভিনয়। মিউজিকাল ফিল্ম বানানোটাও আমি খুব উপভোগ করি, কারণ সেখানে মিউজিক কম্পোজের সুযোগ পাওয়া যায়। সেগুলো বাণিজ্যিকভাবেও সফল হয়, যেটা আলাদা একটা সন্তুষ্টি দেয়। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ও আমার খুব পছন্দের। হতে পারে এটা আমার প্রথম অরিজিনাল স্ক্রীনপ্লে কিংবা খুবই ব্যক্তিগত সিনেমা বলে। সময়ের চেয়ে দশ-পনেরো বছর এগিয়ে ছিল সিনেমাটি।

আপনার সিনেমায় পুরুষ চরিত্রগুলোর তুলনায় নারী চরিত্রগুলো বরাবরই একটু বেশি শক্তিশালী, দৃঢ়সংকল্প, প্রাণবন্ত হয়। এটাকে কি বাঙালি সামাজিক ইতিহাসের প্রতিফলন বলবেন?       

সত্যজিৎ রায়: লেখক যা লিখেছেন এটা তার প্রতিফলন। যেই বইগুলোর উপর ভিত্তি করে সিনেমাগুলো নির্মিত, সেই বইতে লেখক যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লিখেছেন তার প্রতিফলন। রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্কিমচন্দ্রের লেখায় অনেক শক্তিশালী নারী চরিত্রের উপস্থিতি আছে। তবে এর সাথে নারীদের সম্পর্কে আমার নিজের দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও যুক্ত করেছি।

কিরকম অভিজ্ঞতা?

সত্যজিৎ রায়: শারীরিকভাবে পুরুষের মত অতটা শক্তিশালী না হলেও প্রকৃতি সেটা পুষিয়ে দেয়ার জন্য নারীদের কিছু গুণাবলি দিয়েছে। পুরুষের তুলনায় তারা বেশি সৎ, বেশি স্পষ্ট এবং শক্তিশালী চরিত্রসম্পন্ন। আমি সব নারীর কথা বলছি না, তবে নারীর এই বৈশিষ্ট্যগুলো আমাকে মুগ্ধ করে। আমি সেসব নারী চরিত্রকে আমার সিনেমায় তুলে ধরতে চাই যারা পরিস্থিতির সাথে পুরুষের চেয়ে বেশি খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম।

চারুলতা তাহলে সেরকমই চরিত্র?

সত্যজিৎ রায়: অবশ্যই।

নবীনতম পাশ্চাত্য সমালোচকেরা বলে থাকেন ভারত সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণহীন, নিরানন্দ।  

সত্যজিৎ রায়: একমাত্র ‘জন অরণ্য’ ছাড়া অন্য কোন সিনেমার ক্ষেত্রে এ ধরণের সমালোচনার সুযোগ নেই।

কিন্তু অনেকে তো ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ সম্পর্কেও এমন মন্তব্য করেছেন।

সত্যজিৎ রায়: এটাকে আমি ঠিক নিরানন্দ দৃষ্টিভঙ্গি বলব না। কিছু অপ্রিয় সত্য সিনেমাটিতে তুলে ধরা হয়েছে, কিন্তু এটি সিনেমারই অংশ। পাশ্চাত্য সিনেমা বিশ্লেষণ করেও কিন্তু আপনি পাশ্চাত্য মূল্যবোধ সম্পর্কে হতাশাসূচক উক্তি বের করতে পারবেন। সবসময় শুধু আনন্দের সিনেমা বানালে চলে না।

আপনি একটা সমস্যা নিয়ে সিনেমা বানাচ্ছেন, কিন্তু আপনার কাছে সমস্যার সমাধান নেই, সেই সিনেমা হতাশাসূচক হতে বাধ্য। একটি বড় শহরে স্বামী স্ত্রী একই সাথে চাকরিহারা হয়ে যায়, তাদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি হয়, তারা আলাদা হয়ে যায়, আবার একত্রিতও হয়। কিন্তু তারপরেও তারা চাকরি খুঁজে পায় না। কিছুদিন তারা চাকরি না-ই পেতে পারে, কিন্তু এটি কোন সিনেমাকে হতাশাসূচক বানিয়ে দেয় না।

আমি একমাত্র যেই নিরানন্দ সিনেমাটি বানিয়েছি, সেটি ‘জন অরণ্য’। এই বিষয়ে কোন দ্বিমত নেই। আমি চারপাশে দুর্নীতি অনুভব করেছি, ক্রমবর্ধনশীল, লাগামছাড়া দুর্নীতি। দুর্নীতি নিয়ে কলকাতায় সবাই কথা বলে। সবাই জানে, রাস্তা কিংবা পাতালরেল নির্মাণের জন্য যে সিমেন্ট বরাদ্দ হয়েছে, ঠিকাদারেরা সেগুলো নিজেদের বাড়ি বানানোর কাজে ব্যবহার করছে। ‘জন অরণ্য’ সে ধরণের দুর্নীতি নিয়েই নির্মিত চলচ্চিত্র, এবং আমি মনে করি এর কোন সমাধান নেই।

আপনি প্রায়ই বলেছেন, কোনটা সঠিক কিংবা কোনটা ভুল, এই বিষয়ে কোন মন্তব্য করা একজন শিল্পীর উচিত নয়, বা দরকারও নেই এরকম মন্তব্য করার। প্রধান প্রধান রাজনৈতিক বক্তব্যগুলো থেকেও আপনি দূরে থাকতে চেয়েছেন।

সত্যজিৎ রায়: মৃণাল সেন সহ অন্য যে কারোর চেয়ে আমি স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছি। ‘জন অরণ্যে’ আমি একটি বিশাল কথোপকথনের অংশ রেখেছি যেখানে একজন রাজনৈতিক নেতা তার ভবিষ্যৎ করণীয় নিয়ে কথা বলেন। তিনি ননসেন্স কথাবার্তা বলেন, মিথ্যা বলেন, কিন্তু তার উপস্থিতিটা তাৎপর্যপূর্ণ। অন্য কোন পরিচালক সিনেমাটা বানালে কথোপকথনের ওই অংশটুকু সিনেমায় দেখানোর অনুমতি পেতেন না। হ্যাঁ তারপরেও একজন পরিচালক কতটুকু বলতে পারবেন তার একটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আপনি যখন নিশ্চিতভাবেই জানবেন কিছু সংলাপ বা দৃশ্য কখনোই সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পাবে না, তখন সেগুলো বানানোর যৌক্তিকতা কোথায়?

ভারতের রাজনৈতিক আবহাওয়ার কথা যদি বিবেচনা করি, আপনার কি মনে হয় ভারতে একজন চলচ্চিত্র নির্মাতার ভূমিকা স্রেফ একজন পরোক্ষ দর্শকের ন্যায়?  

সত্যজিৎ রায়: আপনি কি ‘হীরক রাজার দেশে’ দেখেছেন? সেখানে একটি দৃশ্যে সরাসরি দেখানো হয়েছে কিভাবে গরীব মানুষদের তাড়িয়ে দেয়া হচ্ছিল। ইন্দিরা গান্ধীর জরুরী অবস্থা জারিকালীন সময়ে দিল্লী সহ অন্যান্য শহরে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল তার প্রত্যক্ষ প্রতিফলন দেখানো হয়েছে সিনেমায়। ‘হীরক রাজার দেশে’র মত ফ্যান্টাসি সিনেমায় আপনি খোলামেলাভাবে বলতে পারবেন, কিন্তু সমসাময়িক চরিত্র নিয়ে নির্মিত সিনেমায় আপনি তা পারবেন না, সেন্সরশিপের কারণে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে আপনাকে আটকে দেয়া হবে। সরাসরিভাবে আপনি ক্ষমতাসীন দলকে আক্রমণ করে বসতে পারেন না। একটা সিনেমায় আমি সেই চেষ্টা করেছিলাম, পুরো সিনেমাটাই নষ্ট করে দেয়া হয়েছিল। কি করতে পারবেন আপনি তখন? আপনি সমস্যা সম্পর্কে জানবেন, সেগুলো নিয়ে কাজও করবেন, কিন্তু আপনি একটি নির্দিষ্ট সীমারেখার বাইরে যেতে পারেন না। এর মধ্যে থেকেই আপনাকে কাজ করতে হবে।

কারোর কারোর মতে এটা পরিচালকের সামাজিক দায়িত্বকে একপ্রকার অস্বীকার করা। বাংলারই কিছু সমালোচকের মতে আপনি প্রয়োজনের তুলনায় কম রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছেন, চাইলেই আপনি আরও দূর আগাতে পারেন। কিন্তু আপনি আপনার সীমাবদ্ধতাকে এখনো চ্যালেঞ্জ করেননি।

সত্যজিৎ রায়: না, আমি মনে করি না আমার আর এগোনোর সুযোগ আছে। দেখুন, প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের বিপক্ষে আক্রমণ করা সহজ। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে, আপনি এমন সব ব্যক্তিদের আক্রমণ করছেন, যারা সেগুলোকে গায়েই লাগাবে না। তাহলে কাজের কাজ টা কি হল? চলচ্চিত্র সমাজকে বদলাতে পারে না, কখনো পারেনি। আমাকে এমন একটি চলচ্চিত্র দেখান যেটি সমাজকে বদলে দিয়েছে, বা কিছু হলেও পরিবর্তন এনেছে।

তাহলে লেনি রাইফেনস্টাল কিংবা সার্গেই আইসেনস্টাইন, যারা কিনা চলচ্চিত্রকে বিপ্লবের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন, তাদের সম্পর্কে কি বলবেন?

সত্যজিৎ রায়: আইসেনস্টাইন এমন একটা বিপ্লবকে সাহায্য করেছেন, যেটা তখন ইতিমধ্যে চলছিল। একটি বিপ্লব চলাকালে চাইলে একজন পরিচালক বিপ্লবের জন্য অনেক কিছুই করতে পারেন। বিপ্লব না থাকলে শুধু চলচ্চিত্র দিয়ে বিপ্লব শুরু করতে পারবেন না।

রাইফেনস্টাল নাৎসি মূল্যবোধের মত একটি মিথকে সহায়তা করছিলেন, আর ওই সময় নাৎসিরা খুব শক্তিশালীও ছিল। ফ্যাসিজমের শুরুর দিকে কিন্তু অনেক বুদ্ধিমান মানুষও সঠিক জিনিসটা ধরতে পারেননি। রোমেন রোল্যান্ড ধরিয়ে দেয়ার আগে পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ভেবেছিলেন মুসোলিনি চমকপ্রদ কিছু করছেন।

একজন পরিচালক হিসেবে আপনার সামাজিক দায়িত্ববোধকে আপনি কিভাবে দেখেন?

সত্যজিৎ রায়: ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র দিকে তাকালে আপনি আমার দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে পারবেন। দুই ভাইয়ের মাঝে ছোট ভাই নকশাল আন্দোলনের সাথে যুক্ত। বড় ভাই তার ছোট ভাইকে তার সাহস ও প্রত্যয়ের জন্য প্রশংসা করে। পরিচালক হিসেবে আমি বড় ভাইয়ের চরিত্রটি নিয়ে বেশি আগ্রহী ছিলাম, কারণ তার চরিত্রটিই ছিল দোদুল্যমান। মনস্তাত্ত্বিক সত্ত্বা, মানুষ হিসেবে তার মধ্যে বিরাজমান সংশয়, দ্বন্দ্ব- সবকিছু মিলিয়ে বড় ভাইয়ের চরিত্রটিই আমার কাছে বেশি কৌতূহলী ছিল। ছোট ভাইয়ের একটা পরিচয় দাঁড় করানো হয়ে গিয়েছিল, সিনেমার প্লট বিবেচনায় তাই বড় ভাইয়ের বিপরীতে তার চরিত্রটা তাৎপর্য হারিয়ে ফেলেছিল।

অনেকেরই ভাষ্য, আপনি আপনার সিনেমায় আবেগকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। রবিন উড লিখেছেন, আপনি মূল্যবোধ প্রকাশের চেয়ে আবেগ ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যোগাযোগে বেশি উৎসাহী।

সত্যজিৎ রায়: একেবারেই ভুল কথা। একটা জিনিস আমার সিনেমায় স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হতেই হবে, সেটা হল শক্তিশালী নৈতিক মনোভাব।

এটা কি আপনার ধর্মীয় শিক্ষাদীক্ষার সাথে সম্পর্কিত? মানে ব্রাহ্ম ধর্ম পালনের সাথে সম্পর্কিত কিনা।

সত্যজিৎ রায়: আমি সেরকম কিছু মনে করি না। আমি তো ব্রাহ্ম মানে কি সেটাই জানি না। আমার যখন ১৪-১৫ বছর বয়স, তখন থেকেই ব্রাহ্ম সমাজে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। কোন নির্মিত ধর্মে আমি বিশ্বাসী না। কোন রাজনৈতিক মনোভাব ফুটিয়ে তোলার চেয়ে নৈতিক মনোভাব ফুটিয়ে তোলাকেই আমি বেশি প্রাধান্য দিতে পছন্দ করি।

আপনার সিনেমার চরিত্রগুলোর মধ্যে আপনার নিজের আবেগ-অনুভুতি কতটা মিশ্রিত থাকে? ‘অশনি সংকেত’ দেখে একজন সমালোচক বলেছেন, গঙ্গাচরণ চরিত্রটিতে আপনি আপনার নিজের খানিকটা অপরাধবোধ, খানিকটা দুর্বলতা ঢুকিয়ে দিয়েছেন। কতটুকু সত্য এটা?

সত্যজিৎ রায়: সমালোচকেরা ভুলে যান, আমি অন্য কারোর কাজ নিয়ে সিনেমা বানাচ্ছি, যেটার অস্তিত্ব ইতোমধ্যে আছে সেরকম কিছু নিয়ে সিনেমা বানাচ্ছি। ‘অশনি সংকেত’ এর গঙ্গাচরণ বিভূতিভূষণের ধারণা থেকে নেয়া চরিত্র। প্রশ্নটা হওয়া উচিত লেখক তার নিজের অপরাধবোধ কিংবা দুর্বলতা গঙ্গাচরণ চরিত্রে ঢুকিয়েছেন কিনা। এখানে খামোখা আমাকে টেনে আনা কেন?

তাহলে কি আপনি বলতে চাইছেন যে সকল বইয়ের উপর ভিত্তি করে আপনার সিনেমাগুলো নির্মিত সেগুলো না পড়লে দর্শকেরা আপনার সিনেমা বুঝতে পারবেন না?  

সত্যজিৎ রায়: মূল লেখককে যদি একেবারেই অগ্রাহ্য করা হয়, তাহলে বলব হ্যাঁ দর্শকদের বুঝতে কিছুটা অসুবিধা হতে পারে। আমি যখন কোন গল্প বা উপন্যাস বাছাই করি, এর নির্দিষ্ট কিছু উপাদান দেখেই করি, ওইসব উপাদান যা আমাকে আকর্ষণ করে। স্ক্রীনপ্লে লেখার সময় থিম হয়তো কিছুটা এদিক সেদিক করি, কিন্তু ওই উপাদানগুলো একই থাকে। একটা গল্প অনেকবার পড়ার পর মনে হয়, লেখক যেভাবে দেখিয়েছেন সেভাবে হয়তো ওই চরিত্রটা নাও দেখানো যেতে পারে। তখন কিছুটা বদল আনা হয়।

আপনি, ফেলিনি, কুরোসাওয়া এবং বার্গম্যান মোটামুটি কাছাকাছি সময়েই সিনেমা বানানো শুরু করেছেন। অনেক সমালোচকের বক্তব্য, বাকিদের তুলনায় আপনি কিছুটা পিছিয়ে পরেছেন, ফেলিনি কিংবা বার্গম্যানের মত ঝুঁকি আপনি নেননি। প্রায় ৩০ বছরের ক্যারিয়ার আপনার, বাকিদের সাথে নিজের ক্যারিয়ারকে কিভাবে তুলনা করবেন?

সত্যজিৎ রায়: আমার মনে হয় আমি বেশ অল্প বয়সেই পরিপক্কতা অর্জন করেছিলাম। সিনেমা বানানোর সময় আমি পশ্চিমের দর্শকদের কথা মাথায় রেখে সিনেমা বানাই না। আমি বাংলায় আমার নিজের দর্শকদের কথা ভেবে সিনেমা বানাই। আমি তাদেরকে আমার নিজের সাথে নিয়ে চলতে চাই, আর এই কাজ করেই আমি সফল হয়েছি। শুরুর দিকে আমার দর্শকেরা সস্তা বাংলা সিনেমার দর্শক ছিল। আস্তে আস্তে তাদেরকে সাথে নিয়ে চলতে হয়েছে আমার, একদিনে তারা আমার সিনেমার দর্শক হয়নি।

এই ঝুঁকিগুলো কিন্তু বার্গম্যান বা ফেলিনিকে নিতে হয়নি। বার্গম্যানের কাজ বেশ সরল, যদিও তার উগ্র হওয়ার সুযোগ ছিল। তাছাড়া দারুণ কিছু ফটোগ্রাফির সহায়তাও কিন্তু বার্গম্যান পেয়েছেন। ফেলিনির ক্ষেত্রে বলতে গেলে, তিনি একই ধরণের সিনেমা একটার পর একটা বানিয়ে গেছেন।

বার্গম্যান ও ফেলিনি যা করে গেছেন, আমি তার সবকিছুই করতে পারব না। আমি তাদের মত পরিস্থিতিতে কাজ করিনা, তাদের মত দর্শকও আমার নেই। ত্রিশ বছর ধরে আমি এই ভারতীয় দর্শকদের সাথে নিয়েই কাজ করে এসেছি। এই সময়ের মধ্যে সিনেমার সাধারণ ধরণ খুব একটা পরিবর্তন হয়নি, বিশেষ করে বাংলায় তো হয়ইনি। পরিচালকেরা এতটাই পশ্চাদপদ এখনো, আপনার বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে আমার কাজের পাশে কিভাবে এখনো তাদের কাজ টিকে আছে। পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়ে কারোর ক্ষতি করবে না এমনভাবে সিনেমা বানাতে হয়েছে আমাকে। মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো তুলে ধরেই তাই আমি সাধারণ মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে চেয়েছি।

Satyajitray.org থেকে সংগৃহীত ও সংক্ষেপিত

About Sanjoy Basak Partha

Check Also

‘ঠিক জায়গায় বল করতে পারলে আমার বলে কেউ রান তুলতে পারবে না’- রশিদ খান

এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা টি-২০ বোলার মানা হচ্ছে তাঁকে। বিশ্বজুড়ে প্রায় সব ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টেই খেলেছেন, …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *