আসুন, আপনাদের আজ একটি রোমহর্ষক সত্য গল্প শোনাই।
মনোবিজ্ঞানের একজন ছাত্রের গল্প, আত্মহত্যার নীল নকশা প্রণয়নকারী এক হন্তারকের গল্প।
ছাত্রটির নাম ফিলিপ বুদেকিন, রাশিয়ার নামকরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। তাকে তার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল কোন একটি কারণে। একদিন তার হঠাৎ করে মনে হল, পৃথিবীতে “অপ্রয়োজনীয়” মানুষদের বেঁচে থাকবার কোন অধিকার নেই। এক ধরণের “বায়োলজিকাল ক্লিনজিং” বা মানুষ হত্যার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করল সে। এজন্য এক অদ্ভূত পদ্ধতির সূচনা হল তার হাতে। প্ররোচনার কাজে সে বাছাই করল মানুষের অবসর কাটানোর অন্যতম হাতিয়ার, ‘গেম’। প্রযুক্তি ও সামাজিক মাধ্যমের আশীর্বাদ- এই দুটিকে কাজে লাগিয়ে সে এমন একটি গেম আবিষ্কার করল, যে গেমে মানুষকে আত্মহত্যার জন্য প্ররোচিত করা হয়।
গেমটির নাম “ব্লু হোয়েল চ্যালেঞ্জ”। এটি এমন একটি চ্যালেঞ্জ, যার সময়সীমা ৫০দিন। নানা ধরণের চড়াই উৎরাই পার করে খেলোয়ারকে শেষ স্টেজে এসে কি করতে হবে জানেন?
আত্মহত্যা! এটিই এই গেমের সবচেয়ে ভয়ংকর দিক। খেলোয়ার বা চ্যালেঞ্জারকে কোন একটি ছাদের ওপরে দাঁড়িয়ে কিংবা কার্নিশের কিনারা থেকে লাফ দিয়ে আত্মাহুতি দিতে হবে গেমের একদম শেষ ধাপে।
এবার আসা যাক, এই গেমটির স্টেজ বা ধাপগুলো কি কিঃ
প্রথমেই বলে নিচ্ছি, এটি স্বাভাবিক কোন গেম না। আর তা হবেই বা কেন? যে গেমে খেলোয়ারকে শেষ ধাপে এসে মৃত্যুবরণ করতে হয়, তাকে নিশ্চয়ই আপনি সাধারণ কোন গেম বলতে পারেন না। ব্লু হোয়েল চ্যালেঞ্জও কোন সাধারণ গেম নয়। আসুন এই গেমের কয়েকটি ধাপ জেনে নেয়া যাক।
১) খেলোয়ারের নিজের হাতে কোন লেখার মাধ্যমে একটি জখম তৈরি করতে হবে।
২) ভোর ৪:২০-এ ঘুম থেকে উঠে কিউরেটরের পাঠানো ভয়ানক কোন ভিডিও দেখতে হবে।
৩) দৈর্ঘ্য অনুপাতে হাতের তালুতে ক্ষত তৈরি করতে হবে।
৪) যে কোন একটি ভয়কে জয় করতে হবে (যদি সে ভয়কে জয় করবার জন্য ভয়াবহ কোন ধরণের অভিজ্ঞতা বা কাজের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, তাহলে তাই করতে হবে)।
৫) খেলোয়ারের হাতে একটি নীল তিমির ছবি আঁকতে হবে।
এই অংশটি খুব গুরুত্বপূর্ন, কারণ ব্রাজিল, স্পেন, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের টিনেজারদের বাবা মায়েরা সন্তানদের হাতে এই নীল তিমির ছবি দেখে সনাক্ত করতে পেরেছেন। সন্তানদের রিহ্যাবিলিটেশন বা পুনর্বাসনের জন্য তারা প্রাণান্তকর চেষ্টা করেন, যাতে তারা এই ভয়ানক গেমের আসক্তি থেকে সন্তানদের সরিয়ে আনতে পারেন। কেউ কেউ সমর্থ হন, আবার কেউ কেউ সন্তানদের এই গেমের করালগ্রাস থেকে রক্ষা করতে পারেন না।
এছাড়াও নানা ধরণের সিক্রেট মিশন, কোড ইত্যাদি এই গেমের মাধ্যমে দেয়া হয় এবং খেলোয়ারদের শেষ দিন দিতে
হয় আত্মাহুতি।
যেমন করে গড়ে ওঠে এই গেমের মাঝে সম্পর্কঃ
গেমার বা চ্যালেঞ্জার ও এডমিনিস্ট্রেটর (ব্যবস্থাপক) বা কিউরেটর- এই দুজনের মাঝে পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমে এই গেমটি সম্পন্ন হয়ে থাকে। এডমিনিস্ট্রেটরের দেয়া “কর্তব্য”গুলো পালন করবার মাধ্যমে একের পর এক টাস্ক সমাপ্ত করতে থাকে চ্যালেঞ্জার। মাঝে মাঝে চ্যালেঞ্জারকে কিছু গানও শুনতে দেয় এডমিনিস্ট্রেটর। যেমন, নরওয়েজিয়ান সংগীতশিল্পী এমিলি নিকোলাসের ‘স্টেরিও’। এই গানটি ২০১৪ সালে এমিলি নিকোলাসের প্রথম অ্যালবাম “লাইক আই’ম আ ওয়ারিওর”-এ অন্তর্ভুক্ত হয়।
চ্যালেঞ্জ, চ্যালেঞ্জার ও প্রস্তুতকারকের কীর্তিকলাপঃ
এ বছরের আগস্টে বুদেকিনকে রাশিয়ার একটি জেলখানায় বন্দী করে রাখা হয়। পুরো রাশিয়াকে নাড়িয়ে দেয়া ২২ বছরের ফিলিপ বুদেকিন পুলিশকে দেয়া তার বয়ানে বলেছেন,
“চ্যালেঞ্জাররা আমার কথায় হাসতে হাসতে তাদের জীবন দিয়ে দিচ্ছিল। আমি মনে করি, এই গেমের মাধ্যমে সমাজের একটি উপকার করছি আমি। এর মাধ্যমে সমাজ থেকে অপ্রয়োজনীয় সকল ব্যক্তিকে ছাঁটাই করা হচ্ছে।”
রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের ১৬জন টিনেজার মেয়েদের আত্মহত্যার কারণ এই ফিলিপ বুদেকিন। ম্যাকাবার সোশাল মিডিয়া ডেথ গ্রুপের মাধ্যমে বুদেকিনের এই শিকাররা তাদের টাস্কগুলো সমাপ্ত করত। বুদেকিনকে তিন বছরের সাজা দেয়া হয় এবং অনেকেই অবাক হয়েছেন যে বুদেকিনকে বিনাশ্রম কারাদন্ড দেয়া হয়েছে। দুজন টিনেজারকে বুদেকিন আত্মহত্যার জন্য ব্রেইনওয়াশড করে ফেলেছিল কিন্তু শেষ মুহুর্তে তাদের জীবন রক্ষা পায়। মূলত, তাদের দেয়া বয়ান ও পুলিশের প্রাপ্ত নানা প্রমাণের সমন্বয়ের মাধ্যমেই বুদেকিনকে সাজা দেয়া হয়েছে।
রাশান এক সাংবাদিক তার একটি রিপোর্টের মাধ্যমে তুলে ধরেন বুদেকিনের এই ভয়াবহতার কথা। তিনি রিপোর্টে দেখান, রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের ১৬জন টিনেজারদের মৃত্যু একটি অপরটির সাথে জড়িত এবং তাদের আত্মহত্যার প্যাটার্ণও একইরকম।
শুরু হয় তদন্ত। আস্তে আস্তে ফাঁস হতে থাকে আড়ালে লুকিয়ে থাকা ফিলিপ বুদেকিনের নাম। যদিও ১৬টি আত্মহত্যার সাথে সম্পৃক্ততার কথা বলছে পুলিশ কিন্তু রাশিয়ান রাজনীতিবিদ, এম পি ও মিডিয়া বলছে বুদেকিনের এই গেমের মাধ্যমে মৃতের সংখ্যা ১০০-রও অধিক ছাড়িয়ে যেতে পারে।
ইউলিয়া কন্সটানটিনোভা (১৫) ও ভেরোনিকা ভলকাভা (১৬) নামের দুই টিনেজার প্রথম বুদেকিনের এই গেমের শিকার। তারা একটি নির্মাণাধীন ভবনের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে।
মৃত্যুর আগে ইউলিয়া তার সোশ্যাল পেইজে “END”-এই লেখাটি লিখে আত্মহত্যা করে এবং মৃত্যুর আগে সে একটি নীলতিমির সাথে তার ছবি একই পেইজে পোস্ট করে। তার বান্ধবী ভেরোনিকাও ঠিক একইরকম “sense is lost…end”- কথাটি পোস্ট করে আত্মহত্যা করে।
পুলিশকে আবার কোন কোন পিতা-মাতা বলছেন বুদেকিন তাদের মেয়েদের হত্যার পেছনে তেমন কোন ভূমিকা পালন করে নি। পর্দার আড়ালে লুকিয়ে আছে আরো একজন কেউ। সে বুদেকিনের চাইতেও ভয়ংকর। বুদেকিনের অসমাপ্ত কাজগুলো হয়ত সে এবার শুরু করছে। এজন্যই আস্তে আস্তে উত্তর আমেরিকা ও এশিয়ার পারে এসে ঠেকছে এই ভয়ানক “নীল তিমি”।
নানা দিক থেকে রিপোর্ট আসা শুরু হয়েছে; বিশেষ করে যুক্তরাজ্য থেকে। যুক্তরাজ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে আস্তে আস্তে “ব্লু হোয়েল চ্যালেঞ্জ” নামের এই আতংক। মেক্সিকো, চীন, সার্বিয়া, স্পেন, উরুগুয়ে, ভেনিজুয়েলা, প্যারাগুয়ে, পর্তুগাল বিভিন্ন দেশ থেকে আত্মহত্যা ও নানা ধরণের উপসর্গের রিপোর্ট আসা শুরু হয়েছে। রাত জেগে হরর ছবি দেখা, বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা, নিজেদের হাতে কাটাকাটি করা ইত্যাদি নানা ধরণের কাজে এবার পিতা-মাতারা আতঙ্কিত হওয়া শুরু করেছেন।
খেয়াল করে দেখা যাচ্ছে যে, মধ্য আমেরিকা থেকে শুরু করে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় আস্তে আস্তে বীজ বপন করতে শুরু করেছে এই ‘নীল তিমি’। সবচাইতে ভয়ের কথা হচ্ছে, এশিয়ার দিকেও সংক্রমণ শুরু হয়েছে।
চীনের রেললাইনের ওপর হাঁটতে থাকা এক টিনেজার মেয়ের আত্মাহুতির ঘটনা বেশ আলোচিত হয়েছে।
ভারতের দিল্লীতেও এই গেমের এক ধরণের উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে, যা প্রতিবেশী দেশ হিসেবে আমাদের জন্যও আতংকের কথা। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে সতর্কবাণী পৌঁছে দেয়া হচ্ছে যাতে বাবা মায়েরা তাদের সন্তানের ওপর বিশেষ নজরদারি করেন। উত্তর প্রদেশে ব্যান করে দেয়া হয়েছে এই গেমটি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের দেশে যাতে এই সংক্রামক ব্যাধি না আসতে পারে, তার জন্য আমাদের করণীয় কি কি হতে পারে-
১) সুস্থ, স্বাভাবিক বিনোদনের মাধ্যমে নিজেদের নিয়োজিত করতে হবে।
২) কোন ধরণের হুজুগের প্রতি কিংবা ক্ষতিকারক জেনেও আগ্রহের বশে কোন উটকো অ্যাপ ডাউনলোড করা যাবে না।
৩) গেম ডাউনলোড করবার আগে তার রেটিং, রিভিউ এবং ভালোভাবে যাচাই করতে হবে।
৪) আমাদের চারপাশে এমন অনেক মানুষ আছে যারা কোন কিছুর সমাধান হাতের কাছে না পেয়ে আত্মহত্যাকে বেছে নেয়। একটু চিন্তা করলেই হয়ত দেখা যাবে এদেরও সামনে ছিল অমিত সম্ভাবনার একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যত। তাদেরকে মোটিভেট করার জন্য বা মন প্রফুল্ল রাখবার জন্য বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত রাখতে হবে।
৫) সন্তানদের হাতে প্রযুক্তি বাবা মায়েরা তুলে দিচ্ছেন ঠিকই কিন্তু তাদের হাতে ব্যবহার্য যন্ত্রটি কোন কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে, তা অনেক সময়ই তারা নজরে আনতে ভুলে যান। সন্তানকে রক্ষা করতে হলে তাদের সাথে মিশতে হবে, হালহকিকত জানতে হবে ও প্রতি মুহুর্তে তাদের সাথে আপ টু ডেট থাকতে হবে।
সর্বোপরি, নিজেদেরকে সচেতন হতে হবে।
হতাশা কিংবা জীবনের প্রতি অনাগ্রহ মানুষকে ঠেলে দেয় নানা ধরণের ঘৃণ্য ও অমার্জনীয় কাজের দিকে। যেমন, আমাদের এই ফিলিপ বুদেকিন। মনোবিজ্ঞানের এই ছাত্রের মননে এমন কি হয়েছিল, যার কারণে সে হঠাৎ করেই ভাবা শুরু করল মানুষেরাও সমাজের জন্য “অপ্রয়োজনীয়” হয়ে উঠতে পারে? যে প্রযুক্তির সাহায্যে সে মানুষকে প্ররোচিত করতে শুরু করল আত্মহত্যার জন্য, সে প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সে হয়ত মানুষের জন্য একটি বিশাল উপকার বয়ে আনতে পারত। হয়ত বুদেকিনের জীবনের এই অদ্ভুত রহস্যটিও একদিন সমাধান করা হবে। সেদিনের অপেক্ষায় আমরাও আছি।
আজ আর নয়। প্রিয়লেখার সাথেই থাকুন। নিজেদের জীবনকে মূল্য দিতে শিখুন। আমরা সকলেই এই প্রকৃতির প্রয়োজনীয়।
(তথ্যসূত্রঃ ডেইলিমেইল, এভারিপিডিয়া ডট অর্গ, হিন্দুস্তান টাইমস)