জাতি হিসেবে আমাদের একটা দুর্নাম আছে। আমরা নাকি নিজ দেশের গুণীদের কদর করতে জানি না। নিজেদের সম্পর্কে এমন বদনাম থাকায় আমাদের লজ্জা হওয়া উচিত। কিন্তু আসলেই কি আমরা লজ্জিত হচ্ছি? বিন্দুমাত্র লজ্জিত হলেও কি কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী আব্দুল জব্বারের মুখ থেকে এরকম কথা শুনতে হয় আমাদের?
দেশের সঙ্গীতজগতে আব্দুল জব্বারের নাম লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে। কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী তো বটেই, আব্দুল জব্বার চিরকাল মানুষের মনে থেকে যাবেন মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্য। একাত্তরে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে প্রচারিত ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ সহ বহু কালজয়ী গানের গায়ক এই কিংবদন্তি শিল্পী। মুক্তিযুদ্ধের সময় গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে ভারতের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঘুরে ঘুরে ১২ লাখ টাকা সংগ্রহ করে দান করেছিলেন বাংলাদেশ সরকারের ত্রাণ তহবিলে। অথচ সেই আব্দুল জব্বারকেই কিনা এখন চিকিৎসার টাকার অভাবে হাত পাততে হচ্ছে সাধারণ মানুষের কাছে!
কতটা অসহায় হলে একজন সঙ্গীতশিল্পী নিজের জীবন বাঁচাতে আকুতি জানাতে পারেন? কিডনি জটিলতা সহ নানাবিধ সমস্যায় ভুগছেন বহু দিন ধরে। সরকারি বেসরকারি সহযোগিতায় চিকিৎসা চললেও প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্তই অপ্রতুল। শেষ পর্যন্ত উপায় না দেখে টাকার জন্য হাত পাততে হল স্বয়ং শিল্পী আব্দুল জব্বারকেই। গণমাধ্যম কর্মীদের সামনে বলতে হয়েছে, ‘যখন লাইফ সাপোর্টে থাকব তখন অনেকেই দেখতে যাবেন। মারা গেলে শহীদ মিনারে ফুল দেবেন। দাফন করার সময় রাষ্ট্রীয় স্যালুট দেবেন। এসবের আমার কিছু দরকার নেই। আমি আরও কিছুদিন বাঁচতে চাই’।
যে মানুষটার গান উজ্জীবিত করেছে কোটি কোটি মুক্তিযোদ্ধাদের, যার অসংখ্য গান অমর হয়ে থাকবে বাংলা গানের ইতিহাসে, যার গান শুনে-গেয়ে বেড়ে উঠেছে কয়েকটি প্রজন্ম, নিজের জীবনের পরোয়া না করে যে মানুষটা গান গেয়ে যুদ্ধের জন্য তহবিল সংগ্রহ করে বেড়িয়েছেন, তাঁর কি এমন কিছু প্রাপ্য ছিল? ‘তুমি কি দেখেছ কভু’, ‘ওরে নীল দরিয়া’, ‘পিচ ঢালা এই পথটারে ভালোবেসেছি’, ‘সুচরিতা যেওনাকো আর কিছুক্ষণ থাকো’ এরকম অজস্র কালজয়ী গানের জন্মদাতার কি এভাবে টাকার অভাবে হাসপাতালে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গোনার কথা?
বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত সর্বোচ্চ দুটি বেসামরিক পদক ‘একুশে পদক’ (১৯৮০) ও ‘স্বাধীনতা পুরষ্কার’ (১৯৯৬) এ ভূষিত হওয়া শিল্পীর কি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে চিকিৎসার টাকা কিভাবে জোগাড় হবে সেই চিন্তায় দিনানিপাত করার কথা? স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিজয়ের বছর খানেক পরেই যিনি পেয়েছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু স্বর্ণপদক’, তাঁর চিকিৎসার কি আজ এমন বেহাল দশা হওয়ার কথা? যার তিনটি গান ‘তুমি কি দেখেছ কভু’, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ ও ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ ২০০৬ সালে বিবিসি বাংলার শ্রোতাদের বিচারে সর্বকালের সেরা ২০ বাংলা গানের তালিকায় স্থান পেয়েছে, তিনি কি মানুষের থেকে আরেকটু সহমর্মিতা আশা করতে পারেন না?
যেই দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন, সেই দেশের মানুষ হয়ে আমাদের কি উচিত না দেশের এই সূর্যসন্তানের জীবন প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখার জন্য কিছু করা? যে মানুষটা আমাদের এত কিছু দিয়েছেন, প্রতিদানে কি আমরা তাঁকে সামান্য অর্থসাহায্য করতে পারিনা? এক কোটি টাকা হলেই এ যাত্রায় বেঁচে যান আমাদের এই গুণী শিল্পী, আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কি সুস্থ করে তুলতে পারিনা আমাদের প্রিয় শিল্পীকে? এক কোটি টাকা হয়তো টাকার অঙ্কে কম কিছু নয়, কিন্তু একটি স্বাধীনতা পদক, একটি একুশে পদকের চেয়েও কি বেশি দামী এক কোটি টাকা? কেবল রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করলেই কি তাঁর প্রতি আমাদের দায়িত্ব মিটে যাবে?
আমরা এতটা অকৃতজ্ঞ হব কেন?