মতিন সাহেবের স্কুল পড়ুয়া ছোট ছেলে এবছর প্রথম রোজা রাখছে। এ নিয়ে পরিবারের মাঝে খুশির অন্ত নেই। ছোট ছেলে অন্তু একদিন বাবার কাছে বায়না ধরল যে সে প্রথম রোজার ইফতার একটি বিশেষ আইটেম দিয়ে সারতে চায়। কি খাওয়া যায় সে ইফতারে?
সমাধানটা বাতলে দিল অন্তুই। কয়েকদিন আগে টেলিভিশনে সে একটি খাবারের নাম জানতে পেরেছে। নামটা খুব অদ্ভুত এবং মজার, “বড় বাপের পোলায় খায়”। আচ্ছা, বাবা তো বাবাই। বাবার আবার ছোট বড় কি? সে একথা বাবাকে জিজ্ঞাসা করলে মতিন সাহেব একগাল হেসে এড়িয়ে যান। তবে তিনিও একটু চিন্তান্বিত হয়ে পড়েন। খাবারের এমন নামকরণ হবার আসলেই কি কোন কারণ রয়েছে? তবে দেরি করেন না তিনি। ছেলের আবদার মেটাবার জন্য এবং অদ্ভুত এ খাবারের দর্শন করবার জন্য চলে যান পুরোনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী চকবাজারে। গিয়ে দেখেন এক এলাহী কারবার! ইফতারের পসরা সাজিয়ে তার মতই খদ্দেরদের আশায় বসে আছে বিক্রেতারা।
গল্পটি কল্পিত, তবে খাবারের নামটি কিন্তু নয়। এ গল্পকে ঘিরেই আসুন আজ একটু হলেও ঘুরে আসি পুরোনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী চকবাজারে। রমযান মাস ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য একটি আনন্দের বার্তাও নিয়ে আসে। একটি দীর্ঘ সময় রোজা রাখবার পর রসনার উদ্দেশ্যে কেউ কেউ চলে যান শহরের অন্যতম বৃহত্তম ও ঐতিহ্যবাহী ইফতার বাজার, চকবাজারে। নানা ধরণের খাবার সেখানে পাওয়া যায়। মুখরোচক সব নামের সাথে জিভে জল এনে দেয়া সেসব খাবার হুড়মুড় করে কিনে নিতে থাকেন খদ্দেররা। মোগলদের রেখে যাওয়া রেসিপির তৈরি নানা ধরণের খাবার কিংবা পুরোনো ঢাকার নবাব বাড়ির রসুইতে তৈরি হওয়া খাবার ভিন্ন আঙ্গিকে পেতে পারেন আপনি পুরনো ঢাকায়। তবে প্রধান আকর্ষণ এই বড় বাপের পোলায় খায়-এর দিকেই।
‘বাদশাহ নামদার’ নামক বইতে বলা রয়েছে সম্রাট হুমায়ুনের বিশেষ বাবুর্চি একটি বিশেষ পদ তৈরি করতেন সম্রাটের জন্য। এই খাবারের নাম আজকে আমরা জানি ‘গ্লাসি’ হিসেবে। রাজ-রাজড়াদের সব এলাহী কারবারের সাথে কিছুটা হলেও আমরা পরিচিত হচ্ছি খাবারের মাধ্যমেই। তাই নয় কি?
আবার চলে যাওয়া যাক চকবাজারের দিকেই। খাবারের নাম ‘বড় বাপের পোলায় খায়’। পূর্বে কিন্তু এই খাবারের নাম এটি ছিল না। পূর্বে এর নাম ছিল “সিখ চূড়ার ভর্তা”। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর একটি মজার স্লোগানের সাথে খাবারটির নাম জনপ্রিয় হয়। কেউ কেউ মনে করেন ৭০ বছর আগে ভোজনবিলাসী কামাল মাহমুদ এই আইটেমের আবিষ্কারক, আবার কেউ কেউ বলেন এটি চলে আসছে এর আরো আগে থেকে। মোগল কিংবা নবাবী আমল থেকে।
স্লোগানটি হচ্ছে- বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙায় ভইরা লইয়া যায়। মজার, তাই না?
এর চাইতেও মজার ব্যপার হচ্ছে, নামের সাথে সাথে এই খাবারের প্রস্তুতিতেও যেসব উপকরণ ব্যবহার করা হয়ে থাকে, তাও এক এলাহী কারবার! যেন পুরোনো ঢাকার নবাব বাড়ির ঐতিহ্য নিমিষেই ভুলে যাবার নয়। নানা খাবারে, জীবন চর্চায়, কথা বলায়, এমনকি মানুষের আচরণেও যেন প্রকাশ পাচ্ছে নবাবী বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য। আসুন, জেনে নেয়া যাক কি কি পাচ্ছেন আপনি এই খাবারের মাঝে।
ছোলা, আলু, মসলা মাখানো মাংসের কুঁচি, পিঁয়াজু, চিঁড়া, বেগুনি, মুরগি, ঘি, অন্তত ২৪ পদের মসলার সমন্বয়ে তৈরি হয়ে থাকে ‘বড় বাপের পোলায় খায়’। ৪০০-৫০০ টাকায় বিক্রি হয় প্রতি কেজি তবে খদ্দেরদের আনাগোনা কিংবা জলদি কিনে নেবার প্রবণতায় আপনি সহজেই বুঝতে পারবেন যে, জনপ্রিয়তা ও স্বাদের দিক থেকে এটির দাম মানুষের কাছে কিছুই নয়।
আমাদের গল্পের কল্পিত মতিন সাহেবকে আসুন কল্পনা করি এবার। ছেলে অন্তুর জন্য তিনি বেশ খুশি মনেই নিয়ে নিলেন বড় বাপের পোলায় খায়। আর সাথে পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী জিলিপি তো আছেই। যেতে যেতে তিনি এবার ঝালাই করতে লাগলেন পুরোনো ঢাকার ইতিহাস সম্পর্কে তিনি কতটুকু জানেন। আসুন, তার সাথে আমরাও নিজেদের স্মৃতিটুকু একটু হাতড়ে নেই।
চক বাজারের ইতিহাসঃ
সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহের কথা মনে আছে তো? ১৬০২ সালে তিনি তাঁর প্রধান কার্যালয় বাওয়াল থেকে আজকের ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের কাছে নিয়ে আসেন এবং একই সাথে মোগল দূর্গকেও। এভাবেই চকবাজারের উৎপত্তি।
মোগল সময় থেকেই চকবাজার ছিল অন্যতম একটি ব্যবসায়িক কেন্দ্র এবং সামাজিক আলাপনের স্থান। ৪০০ বছর পরও উদ্ভিন্নযৌবনা চকবাজারের আবেদন কিন্তু একটুও কমে নি; বরং তা মানুষের কাছে আরো বেড়েছে। ১৭০২ সালে মুর্শিদ কুলি খাঁ এর নাম দেন ‘বাদশাহী বাজার’। তাঁর জামাতা দ্বিতীয় মুর্শিদ কুলি খাঁ বাজারটিকে সংস্কার করেন।
ঐতিহ্যগত দিক থেকেই বলুন কিংবা গুরুত্বের দিক থেকে, তৎকালীন সময়ে চকবাজার নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল এটি স্থাপিত হয়েছিল একেবারে বুড়িগঙ্গার কোল ঘেঁষে, যার ফলে ব্যবসায়িক ক্ষেত্র নানাভাবেই বৃদ্ধি লাভ করে। এছাড়াও প্রায় দশ দিক থেকে চকবাজারের সাথে স্থলপথে যোগাযোগ ছিল। চকবাজারকে তৎকালীন সময়ে কেউ চক পোর্ট বা চক বন্দরও বলতেন।
“রোমান্স অফ অ্যান ইস্টার্ন ক্যাপিটাল” নামক ১৯০৬ সালে প্রকাশিত একটি জার্নালে ব্র্যাডলি বার্ট বলেছিলেন যে মোগলদের জৌলুশ কিংবা তাদের জীবনধারার মত চাকচিক্য চকবাজারে এখন আর নেই তবে এখনো চক মসজিদে ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের আনাগোনায় ভরপুর থাকে। এখানে প্রতি শুক্রবার জুম’আর জামাতে এমন জনসমাগম হয়ে থাকে, যার সাথে কেবল ঈদের জামাতেরই তুলনা করা যায়।
১৮৪০ সালে জেমস টেইলর বলেন, চকবাজারের ব্যবসায়িক কেন্দ্রটি এমনভাবে স্থাপিত হয়েছিল যে সেখানে নানা ধরণের পণ্য কেনাবেচা করা হত। ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছিল চকবাজারের ব্যবসায়িক কর্মকান্ড। তবে চকবাজারকে আরবি ‘নাখাশ’ শব্দের মাধ্যমে চয়িত করা হত, যার অর্থ হচ্ছে এখানে পশু ও দাস কেনাবেচা করা হয়। ধারণা করা হয় যে, তৎকালীন এই চকবাজারে দাসপ্রথা ছিল, অর্থাৎ দাস হিসেবে মানুষ কেনাবেচা করা হত। এছাড়াও চকবাজারকে ঘিরে ছোট দেয়াল ছিল। ১৮৬৯ সালে পুনঃসংস্কার করে দেয়ালগুলো উঁচু করার কথা বলা হয় কিন্তু সেখানকার বিক্রেতারা এর প্রতিবাদ করেন।
এবার একটা মজার গল্প বলি। নাজির হোসেন বলেন, বিয়ে করবার আগে হবু জামাতারা নাকি চকবাজারে চক্কর দিতে যেতেন। পুরো চকবাজারকে ঘিরে কেউ একবার, কেউ তিনবার, আবার কেউবা সাতবারও চক্কর কাটতেন। বিশ্বাস করা হত যে, শ্বশুড়বাড়িতে প্রবেশ করবার আগে যদি কুশল বিনিময় না করা হয় চকবাজারে গিয়ে অন্যান্যদের সাথে, তাহলে নাকি বিয়েটাই অপূর্ণ থাকত! তবে কালের পরিক্রমায় এসব ঐতিহ্যবাহী ও মজার রীতিনীতি হারিয়ে যাচ্ছে।
দ্রুত পা চালিয়ে চলছেন মতিন সাহেব। ইফতারের সময় হয়ে এল বলে। বাড়িতে গিয়ে ছেলের সাথে শখের ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ তুলে দিতে হবে যে! শেষবারের মত আবার পিছনে তাকিয়ে দেখে নিলেন চকবাজারকে। তবে বিদায় নয়, আরেকবার প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর সরগরম চকবাজারকে দেখে নিতে! জানা আছে, আবার আসবেন তিনি এখানে!