২০০৩ এর সাউথ আফ্রিকা বিশ্বকাপ অনেক দিক থেকেই রোমাঞ্চ ছড়িয়েছিল ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে। তবে ওই বিশ্বকাপ সবচেয়ে বেশি স্মরণীয় হয়ে আছে কেনিয়ার দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের কারণেই। শ্রীলঙ্কা, জিম্বাবুয়ে ও বাংলাদেশের মতো টেস্ট খেলুড়ে দেশদের হারিয়ে তারা পৌঁছে গিয়েছিল সেমিফাইনাল পর্যন্তও। এখনো পর্যন্ত কোন সহযোগী দেশের বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ওঠার একমাত্র নজির এটিই।
কিন্তু তখন কে ভাবতে পেরেছিল, মাত্র ১৫ বছর পরেই আফ্রিকান দেশটির ক্রিকেট অস্তিত্ব এমন বিলুপ্তির মুখে পড়ে যাবে!
বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠে সবাইকে চমকে দেয়া দেশটি হারিয়ে ফেলেছে আইসিসির দেয়া ওয়ানডে স্ট্যাটাস। একসময় টেস্ট মর্যাদা দেয়র যোগ্য মনে করা হত যেই দেশটিকে, তারা আজ আইসিসির তৃতীয় বিভাগে খেলছে! নব্বই দশকের শেষ দিকে ও একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে সহযোগী দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল কেনিয়া। আইসিসির ইভেন্টগুলোতেও তখন কেনিয়ার উপস্থিতি ছিল অনেকটাই নিয়মিত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সেই কেনিয়ার দাপট আর নেই। গত বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব পার হতে পারেনি, খেলতে পারেনি গত তিনটি টি-২০ বিশ্বকাপেও। এমনকি ২০১৯ বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে খেলার যোগ্যতাও হারিয়ে ফেলেছি একসময়ের দুর্দান্ত দল কেনিয়া।
কেনিয়ার ক্রিকেটের এই দুর্ভাগ্যজনক পতন নিয়ে চাইলে একটি আস্ত গবেষণাই করে ফেলা যেতে পারে। প্রশাসনিক ব্যর্থতা, দুর্নীতি, আর্থিক সংকট, সরকারের অসহযোগিতা- কেনিয়ান ক্রিকেটের পতনের পেছনে কারণের অভাব নেই। কেনিয়ার সাবেক অধিনায়ক ও কিংবদন্তি খেলোয়াড় আসিফ করিমের মতে, কেনিয়ার ক্রিকেটের এই ভগ্নদশার মূল কারণ খেলাটির প্রতি দেশটির সরকারের চরম অনীহা। শাসক গোষ্ঠী সর্বদাই ক্রিকেটকে একটি উপনিবেশিক খেলা হিসেবে দেখে এসেছে, সে কারণেই খেলাটির প্রসারে কোন পদক্ষেপ নেয়নি।
কেনিয়ায় ক্রিকেটের অস্তিত্ব প্রায় ৭০ বছর ধরে। ব্রিটিশরাই সর্বপ্রথম ক্রিকেট খেলা চালু করেছিল দেশটিতে। কিন্তু স্বাধীনতার পরে এশিয়ানরাই খেলাটিকে আরও বিস্তৃত করে তুলেছে। কেনিয়াতে প্রথমবারের মতো ক্রিকেট খেলা হয় ১৯৫১ সালে। এরপর ১৯৫৩ সালে কেনিয়ান ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন গঠিত হয়। ১৯৭৫ বিশ্বকাপে পূর্ব আফ্রিকা দলের ৭ জনই ছিলেন কেনিয়ান ক্রিকেটার। ১৯৮২ সাল থেকে তারা নিজেদের দেশের পরিচয়েই খেলতে শুরু করেন।
১৯৮০ এর দশকের শেষ দিকে কেনিয়ায় ক্রিকেটের বিস্তৃতি ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। এর মূল কারণ ছিল দেশটির ক্লাব ক্রিকেটের শক্ত ভিত্তি। ১৯৮০ এর দশকে সঞ্জয় মাঞ্জরেকার, সন্দ্বীপ পাতিল, চন্দ্রকান্ত পণ্ডিত, প্রবীণ আমরে, বালভিন্দর সান্ধুর মতো শীর্ষস্থানীয় ভারতীয় ক্রিকেটারেরা নাইরোবিতে ক্লাব ক্রিকেট খেলতে আসতেন। নাইরোবি ক্লাব লীগে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ জন স্থানীয় তরুণ ক্রিকেট খেলতেন তখন।
১৯৯৪ তে আইসিসি ট্রফি অনুষ্ঠিত হয় কেনিয়ায়, এবং প্রত্যাশা অনুযায়ী দারুণ পারফর্ম করে স্বাগতিকেরা। রানার্স আপ হয়ে ১৯৯৬ বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে তারা। ওই বিশ্বকাপে খেলতে গিয়ে দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়েছিল তারা।
১৯৯৭ সালে গোয়ালিয়রে প্রথমবারের মতো ভারতকে হারায় কেনিয়া, ওই বছরেরই আইসিসি ট্রফির ফাইনালও খেলে। ফাইনালে বাংলাদেশের কাছে হেরে গেলেও ১৯৯৯ বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা ঠিকই অর্জন করে নেয় দেশটি। যদিও এই বিশ্বকাপে তারা কোন ম্যাচ জিততে পারেনি, কিন্তু সবচেয়ে শক্তিশালী সহযোগী দেশের মর্যাদা ঠিকই সমুন্নত থাকে তাদের। নব্বইয়ের শেষ থেকে পরের শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত ছিল কেনিয়ার ক্রিকেটের স্বর্ণযুগ।
কিন্তু এত সাফল্যের পরেও দেশটির ক্রিকেট বোর্ড বা সরকার কেউই দেশটিতে ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ছিল না। প্রশাসকদের মধ্যে দক্ষতা ও স্বচ্ছতার অভাব ছিল, এ কারণে স্পন্সররাও পৃষ্ঠপোষকতা করা থেকে পিছিয়ে যায়। অর্থের অভাবে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট আয়োজনও বন্ধ করে দেয় বোর্ড। এমনকি শীর্ষ দলগুলোর সাথে নিয়মিত খেলার সুযোগ প্রাপ্তির ব্যাপারে তাদের বোর্ডগুলোর সাথে কোনরূপ আলোচনাও করেনি কেনিয়ার বোর্ড। জাতীয় দল তো বটেই, ‘এ’ দলের কার্যক্রমও অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছিল। আস্তে আস্তে বাকি বিশ্ব থেকে আলাদা হয়ে পরে ক্রিকেট বিশ্ব থেকে।
হিসাব থেকে জানা যায়, গত ১২ বছরে কেনিয়ান ক্রিকেটের উন্নয়নের জন্য আইসিসি থেকে ১৭ মিলিয়ন ডলার পেয়েছে দেশটির ক্রিকেট বোর্ড। কিন্তু কোন খাতের উন্নয়নে কত টাকা ব্যয় হয়েছে, তার কোন হিসাব কিংবা কাগজপত্র কোন কিছুই নেই। এই দুর্নীতিই কেনিয়ান ক্রিকেট ধ্বংসের পেছনে অন্যতম বড় কারণ।
ক্রিকেটসকার অবলম্বনে