বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে এক সময় বেশ গৌরবের সাথে রাজত্ব করে গেছে মোঘলরা। বাংলার আনাচে -কানাচে এখনো ছড়িয়ে আছে তার খণ্ডিত কিছু নিদর্শন। তেমনই একটি জায়গার নাম চাঁপাইনবাবগঞ্জের তাহখানা কমপ্লেক্স। গৌড়-লখনৌতির ফিরোজপুর এলাকায় একটি বড় পুকুরের পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত ভবন কাঠামোটি ঐতিহ্যগতভাবে তাহখানা নামে পরিচিত। ভবনটির উত্তর-পশ্চিমে আরও দুটি কাঠামো রয়েছে নিকটস্থটি একটি তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ এবং একটু উত্তরে অবস্থিত অপরটি ভল্টেড বারান্দা ঘেরা একটি গম্বুজ সমাধি। যেহেতু ভবনগুলো একই সময় একটি বিশেষ উদ্দেশ্যেই নির্মিত হয়েছিল, সেহেতু সবগুলো ভবনকে একত্রে একটি একক ইউনিট বা একটি কমপ্লেক্স হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে বর্তমানে এসব ধ্বংসপ্রাপ্ত।
কে এই কমপ্লেক্সের নির্মাতা তা নির্দিষ্ট করে জানা যায় না। তবে ভবনগুলোর স্থাপত্যরীতির বৈশিষ্ট্য, সুলতানি রীতির সৌধসমূহের মাঝে বিষম বৈশিষ্ট্যের মুঘলরীতির প্রয়োগ এবং সমসাময়িক ও পরবর্তী ঐতিহাসিক বিবরণ ইঙ্গিত করে যে এর নির্মাতা মোঘল সুবাহদার শাহ সুজা (১৬৩৯-১৬৬০ খ্রিঃ) । তিনি সুফী সাধক শাহ নেয়ামতউল্লাহ ওয়ালীর প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ মাঝে মাঝে গৌড়-লখনৌতি যেতেন এবং সেখানে অবস্থানও করতেন। রাজমহলেই ছিল শাহ সুজার রাজধানী, যা গৌড় থেকে খুব দূরে নয়। তবে প্রায়ই গৌড়ে তার ভ্রমণ এবং সেখানে অবস্থিত লুকোচুরি দরওয়াজা নামে জাকজমকপূর্ণ মোঘল তোরণ এ যুক্তিটিকে আরও বেশি অকাট্য করে তুলেছে। খুব সম্ভবত শাহ সুজা দরবেশের খানকাহ হিসেবে এই ছোট্ট প্রাসাদটি এবং এর সংলগ্ন মসজিদ ও সমাধিসৌধটি নির্মাণ করেন। সমাধিটি সম্ভবত দরবেশের (মৃত্যু ১৬৬৪ অথবা ১৬৬৯ খ্রিঃ) অন্তিম শয়নের জন্য পূর্বেই নির্মিত হয়েছিল। লুকোচুরি দরওয়াজা গৌড়-লখনৌতি নগর দুর্গের গুমতি গেট থেকে কিছুটা উত্তর দিকে অবস্থিত একটি মোঘল স্থাপত্য। এটি সম্রাট শাহজাহানের পুত্র এবং বাংলার গভর্নর শাহ সুজা সতেরো শতকের মাঝামাঝিতে নির্মাণ করেছিলেন। এ দরওয়াজার নির্মাণশৈলী পরিপূর্ণভাবে মোঘল রীতি অনুসরণ করে। পরিকল্পনায় নগরদুর্গের অন্যান্য প্রবেশ পথের সাথে কিছুটা সাদৃশ্য থাকলেও গঠনগত দিক থেকে এটি সম্পূর্ণ পৃথক।
কেন্দ্রীয় প্রবেশপথটি চতুষ্কেন্দ্রিক খিলানযুক্ত ঈওয়ান-রীতি অনুযায়ী নির্মিত। এর উভয় পার্শ্বদেশে রয়েছে অনুরূপ খিলান প্রবেশপথ। প্রবেশপথটি ইট দ্বারা নির্মিত এবং আয়তাকার। এর পরিমাপ দৈর্ঘ্যে ১৯.৮০ মি এবং প্রস্থে ১২.৯০ মি। এটি উচ্চতায় তিন তলা বিশিষ্ট এবং দ্বিতীয় তলায় নিচের তলার সদৃশ্য প্রবেশপথ রয়েছে। উপরে সমতল ছাদ বিশিষ্ট, যা নক্করখানা হিসেবে ব্যবহূত হতো। এখান থেকে নগর দুর্গে গভর্নরের প্রবেশ ও প্রস্থানের ঘোষণা দেওয়া হতো। সর্বোচ্চ তলায় নিচতলা ও দ্বিতীয় তলার অংশ জুড়ে বিস্তৃত কেন্দ্রীয় খিলানের উপরে তিনটি বড় জানালা আছে। এগুলো ম্যাসিকোলিস (বুরুজগাত্রে গ্যালারি) ধরনের এবং এর উপরে রয়েছে মোঘল স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যের মারলোন রীতির অলঙ্করণ। সম্পূর্ণ ইমারতটি পলেস্তারায় ঢাকা এবং আয়তাকার ফ্রেম নকশায় সজ্জিত। কেন্দ্রীয় খিলানের অভ্যন্তরভাগ মোঘল রীতির ‘মুকারনাস’ নকশা দ্বারা অলংকৃত।
দক্ষিণদিকে এর নিকটে সুলতানি আমলের একটি প্রবেশপথ থাকা সত্ত্বেও লুকোচুরি দরওয়াজাটি নির্মিত হয়েছিল সম্ভবত এ কারণে যে, একজন মোঘল সুবাহদার কখনও সুলতানি আমলের গঠনকে তাঁর রাজকীয় প্রবেশপথ হিসেবে ব্যবহার করবেন না। প্রবেশপথটি ছিল মোঘল শাসনের প্রতীক এবং স্বাধীনতা ও সর্বত্র মোঘলীকরণের ছাপের পরিচায়ক। পুনঃপ্রতিষ্ঠিত ইলিয়াসশাহী বংশের সময় থেকে নগরটি দক্ষিণ দিকে বর্ধিত হতে থাকে। তখন এর গভর্নর ঐ দিকে প্রবেশপথ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তদুপরি আরও জানা যায় যে, শাহ সুজা তাঁর পৃষ্ঠপোষক পীর শাহ নিয়ামতুল্লাহ ওয়ালী, যিনি নগরীর দক্ষিণ দিকে ফিরোজপুর এলাকায় থাকতেন, সেখানে প্রায়ই যেতেন। এ প্রবেশপথটির নির্মাণে তাঁর যাতায়াতের পথ সংক্ষিপ্ত হয়েছিল এবং তাঁকে নগরের মধ্যদিয়ে যাতায়াত করার সুযোগ করে দিয়েছিল। নগরের মধ্যবর্তী স্থানটি তখন প্রবেশপথের পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে ছিল। নগরের মধ্যবর্তী স্থানটি তখন প্রবেশপথের পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে ছিল।
লুকোচুরি (বাংলা) নামটি সম্ভবত পরবর্তী সময়ে দেওয়া হয়েছে। সম্ভবত শিশুদের লুকোচুরি খেলা থেকেই এ নামটির উৎপত্তি হয়েছে। এ ধরনের কমপ্লেক্সের সূত্রপাত হওয়ার পর ঢাকা ও মুর্শিদাবাদে এরূপ প্রাসাদ, মসজিদ অথবা সমাধিসৌধ সম্বলিত কমপ্লেক্স একটি প্রচলিত রীতিতে পরিণত হয়। তাহখানা কমপ্লেক্সটি চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে প্রায় ৩৫ কি.মি. দূরে অবস্থিত। ঢাকা থেকে বাসে করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ চলে যেতে পারেন। সদর থেকে বাস অথবা সিএনজিতে যাওয়া যায়। প্রায় ৪৫ মি. থেকে ১ ঘন্টার মধ্যে সদর থেকে লুকোচুরি দরওয়াজায় পৌঁছে যাবেন।