১৯৩৮ সালের ডিসেম্বর মাসের কথা। লন্ডনের ২৯ বছর বয়সী এক শেয়ারের দালাল, নিকোলাস উইন্টন তখন সুইজারল্যান্ডে ছুটি কাটাতে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। ঠিক তার আগে আগে বন্ধু মার্টিন ব্লেকের কাছ থেকে একটা ফোন কল পান উইন্টন। বন্ধু তাকে সুইজারল্যান্ড না গিয়ে যত দ্রুত সম্ভব প্রাগে চলে আসতে বলেন। ওই এক ফোন কলই ঘুরিয়ে দিল উইন্টনের জীবনের মোড়।
মাস দুয়েক আগের কথা। ১৯৩৮ এর অক্টোবরে জার্মানি ও অন্যান্য ইউরোপিয়ান পরাশক্তিদের মধ্যে ‘মিউনিখ চুক্তি’ হওয়ার পর নাৎসিরা পশ্চিম যুগোস্লাভিয়ার একটা অংশ নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালায়। আরেকটা বিশ্বযুদ্ধ তখন কেবল সময়ের ব্যাপার। নভেম্বরের ৯ এবং ১০ তারিখে জার্মান ও অস্ট্রিয়ান ইহুদিদের উপর এক বীভৎস আক্রমণ হয়। দ্রুতই সে খবর প্রাগে ছড়িয়ে পরে। এই খবর শুনে উইন্টন কিছু একটা করার তাগিদ অনুভব করেন।
শত শত পরিবার আশ্রয়হীন হয়ে পরে, রিফিউজি হয়ে ঘুরতে থাকে এদিক সেদিক। উইন্টন সেসব পরিবারকে নিজ দেশ ব্রিটেনে স্থানান্তরের চেষ্টা শুরু করেন। কিন্তু পুরো পরিবারের সবাইকে স্থানান্তর করাটা একপ্রকার অসম্ভব হয়ে ওঠে।
রিফিউজি ক্যাম্পে তখন দুর্বিষহ অবস্থা। খাবার কেনার টাকা পর্যন্ত ছিল না কোন কোন পরিবারের কাছে। মায়েরা খুব করে চেষ্টা করছিল বাচ্চাদের জন্য খাবার জোগাড় করার। অভিভাবকেরা তখন তাদের বাচ্চাদের অন্তত অন্য দেশে নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে পরে। রিফিউজি ক্যাম্পের এই অবস্থা দেখে উইন্টন আর চুপ থাকতে পারেন না। শুরু করেন এক অসাধ্য কর্মযজ্ঞ।
আশেপাশের মানুষের থেকে তেমন কোন সহায়তা না পেয়ে উইন্টন একাই শুরু করেন উদ্ধার কার্যক্রম। প্রথমে প্রাগের ওয়েনসেসলাস স্কয়ারের এক হোটেলের ডাইনিং রুমে তার অফিস খোলেন উইন্টন। উদ্বিগ্ন অভিভাবকেরা একে একে তার অফিসে এসে জমা হন, এবং তাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ উইন্টনের হাতে ছেড়ে দিতে থাকেন। ধীরে ধীরে কার্যক্রমের পরিধি বাড়াতে থাকেন উইন্টন, ভোরসিলস্কা স্ট্রীটে অফিস খোলেন আরেকটা, যার দায়িত্ব দেয়া হয় ট্রেভর চ্যাডউইককে।
নতুন অফিসের সামনে আরও লম্বা লাইন পরে অভিভাবকদের। অফিসে রেজিস্ট্রি করে অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের উইন্টনের কাছে রেখে যেতে শুরু করেন। প্রাগ ছাড়িয়ে স্লোভাকিয়া থেকেও একের পর এক আবেদন আসতে থাকে উইন্টনের অফিসে। এমতাবস্থায় প্রাগের দায়িত্ব চ্যাডউইক ও বিল বারাজেত্তির হাতে দিয়ে বাকি প্রশাসনিক কাজ সারার জন্য লন্ডনে ফেরেন উইন্টন।
বিভিন্ন দেশের সরকারের সাথে যোগাযোগ করতে থাকেন তিনি। শেষ পর্যন্ত তার নিজের দেশ ব্রিটেন ও সুইডেন তার আহবানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসে। গ্রেট ব্রিটেন ১৮ বছর বয়সের নিচের ছেলে মেয়েদের আশ্রয় দিতে রাজি হয়।
কিছু একটা ব্যবস্থা করার পর উইন্টনের মাথায় চিন্তা আসে শিশুদের ব্রিটেনে আনবেন কিভাবে সেটা নিয়ে। দিনে নিজের শেয়ার মার্কেটে সময় দেয়ার পর পুরো বিকাল এবং রাত তিনি এই কাজে ব্যয় করতে থাকেন। তিনি একটি সংস্থা দাঁড় করান, নাম দেন ‘দ্য ব্রিটিশ কমিটি ফর রিফিউজিস ফ্রম চেকোস্লোভাকিয়া, চিল্ড্রেন’স সেকশন’। কমিটির সদস্য ছিলেন উইন্টন নিজে, তার মা, তার সেক্রেটারি ও কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবক।
পরিবহন খরচ মেটাবার জন্য উইন্টনের যথেষ্ট ফান্ডের দরকার ছিল। সাথে ব্রিটেনে আসার পর প্রতিটি শিশুর জন্য একটি করে পরিবারের ব্যবস্থাও করতে হত তাকে। সে উদ্দেশ্যে চার্চে এবং ব্রিটিশ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া শুরু করেন তিনি। শিশুদের ছবি প্রিন্ট করে গোটা ব্রিটেন জুড়ে সেগুলো লাগিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেন উইন্টন। উইন্টন নিশ্চিত ছিলেন যে বাচ্চাদের ছবি দেখে স্পন্সররা অর্থ সাহায্য দিতে এগিয়ে আসবেন, সাথে এমন পরিবারও পাওয়া যাবে যারা ওই বাচ্চাদের ভরণ পোষণের দায়িত্ব নেবে।
কিন্তু এতকিছু করার পরেও প্রশাসনের তরফ থেকে কাঙ্ক্ষিত সাহায্য পান না উইন্টন। বাচ্চাদের ভিসা সংক্রান্ত কাজে খুবই ধীরগতিতে আগাচ্ছিল ব্রিটিশ প্রশাসন, বারবার তাদের কাছে ধর্না দিলেও বিশেষ সুবিধা করতে পারছিলেন না উইন্টন। ‘এত তাড়াহুড়ার কি আছে’ এই বলে উইন্টনকে নিরস্ত করত প্রশাসনের লোকেরা।
শেষ পর্যন্ত উইন্টন তার প্রথম সাফল্য পান ১৯৩৯ সালের ১৪ মার্চ। বিমানে করে প্রাগ থেকে একটি দল লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। প্রাগের উইলসন রেলস্টেশন থেকে আরও ৭ টি গ্রুপের পরিবহনের ব্যবস্থা করেন উইন্টন। নৌকা দিয়ে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে শেষমেশ তারা পৌঁছে লিভারপুল স্ট্রীট স্টেশনে। স্টেশনে অপেক্ষারত ছিলেন বাচ্চাদের দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত পরিবারের সদস্যরা। কোন বাচ্চাটাকে কোন পরিবারে দিলে ভালো হবে সেই দেখভালও করেন উইন্টন নিজে।
বাচ্চাদের নিয়ে শেষ ট্রেনটি প্রাগ ছেড়ে আসে ২ আগস্ট। সবমিলে ৬৬৯ টি বাচ্চাকে প্রাগ থেকে উদ্ধার করে লন্ডন নিয়ে আসেন উইন্টন। কিন্তু এই সংখ্যা কমপক্ষে আরও ২৫০ বাড়তে পারত, পারেনি হিটলারের কারণে। ১ সেপ্টেম্বর তারিখে সবচেয়ে বড় গ্রুপটির লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরুর কথা ছিল, কিন্তু ওই একই দিনে হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করে বসায় জার্মান নিয়ন্ত্রিত সব বর্ডার বন্ধ করে দেয়া হয়। বর্ডার বন্ধের সাথে সাথে বন্ধ হয়ে যায় উইন্টনের উদ্ধার কার্যক্রমও। উইন্টন পরে বহুবার বলেছেন, উইলসন স্টেশনে এতগুলো বাচ্চা উদ্ধার হওয়ার আশায় দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু আমি কিছুই করতে পারছি না, এই দৃশ্য আমাকে বহু বছর পুড়িয়েছে। লিভারপুল স্টেশনে ওই ২৫০ বাচ্চাকে গ্রহণ করার জন্য ২৫০ টি পরিবারই অপেক্ষা করছিল, তাদেরকেও ফেরত যেতে হয় নিরাশ হয়ে।
নিজের এই উদ্ধার কার্যক্রমের কথা উইন্টন কাউকে জানাননি, এমনকি নিজের স্ত্রী গ্রেটিকেও না। প্রায় পঞ্চাশ বছর পর, ১৯৮৮ সালে গ্রেটি একটি স্ক্র্যাপবুক খুঁজে পান, যেখানে বাচ্চাদের নাম ছবি সহ পূর্ণাঙ্গ তালিকা লিপিবদ্ধ ছিল। এরপর গ্রেটি পুরো কাহিনী জানতে পারেন।
গ্রেটি এই ঘটনা হলোকাস্ট বিশেষজ্ঞ ডঃ এলিজাবেথ ম্যাক্সওয়েলের কাছে খুলে বলেন। এলিজাবেথের স্বামী রবার্ট ম্যাক্সওয়েল উইন্টনের এই অনবদ্য ত্যাগের কথা ফলাও করে পত্রিকায় ছাপানোর ব্যবস্থা করেন। এরপরই তৈরি হয় আবেগঘন এক পরিস্থিতির।
বিবিসি’র একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয় উইন্টনকে। স্টুডিওতে হঠাৎ করেই আমন্ত্রিত সব অতিথি একযোগে দাঁড়িয়ে উইন্টনকে অভিবাদন জানাতে শুরু করেন। হকচকিত উইন্টন বুঝতেই পারছিলেন না কি হচ্ছে তার সাথে। এরপর যখন অতিথিরা একে একে তাদের পরিচয় দিয়ে কৃতজ্ঞতা জানাতে শুরু করেন, তখন উইন্টন বুঝতে পারেন, এরা প্রত্যেকেই আসলে উইন্টনের রক্ষা করা সেই শিশুরা! অনুষ্ঠানটি একযোগে সারা দেশজুড়ে প্রচারিত হচ্ছিল বিধায় আরও অসংখ্য ধন্যবাদ বার্তা আসতে থাকে উইন্টনের কাছে, আর সেগুলো পাঠাতে থাকেন ৫০ বছর আগের সেইসব শিশুরা, উইন্টনের বদৌলতে যারা নতুন জীবন ফিরে পেয়েছিলেন।
নিজের এই মহানুভবতার স্বীকৃতিও পেয়েছেন উইন্টন। সাবেক ইসরাইলি প্রেসিডেন্ট এজার উইজম্যান ধন্যবাদ জানিয়ে তাকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। প্রাগের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেয়া হয় উইন্টনকে। ১৯৯৩ সালে রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ উইন্টনকে ‘মেম্বার অফ দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার’ পদবীতে ভূষিত করেন। ২০০২ সালের ৩১ ডিসেম্বর মানবতার জন্য উইন্টনকে ‘নাইটহুড’ উপাধি দেয়া হয়। ২০১৪ সালের ২৮ অক্টোবর চেক রিপাবলিকের সর্বোচ্চ সম্মান ‘অর্ডার অফ দ্য হোয়াইট লায়ন’ পদবীতে ভূষিত করা হয় তাকে।
২০১৫ সালের ১ জুলাই ১০৬ বছর বয়সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন এই মহানুভব মানুষটি।