নারী ক্রিকেটে এশিয়ার মধ্যে ভারত যেন এক প্রবল প্রতাপশালী শক্তি। গত নারী বিশ্বকাপের ফাইনালে অল্পের জন্য ইংল্যান্ডের কাছে হারতে হয়েছিল তাঁদের। বৈশ্বিক ক্রিকেটেই ছড়ি ঘোরায় যারা, এশিয়ার এই ছোট্ট গণ্ডিতে তাঁরাই যে আধিপত্য বিস্তার করবে এতে আর আশ্চর্যের কিছু নেই। বরং আশ্চর্য করে তাঁদের আধিপত্যের মাত্রাটা। ভারতীয় নারী ক্রিকেট দলের আধিপত্যের মাত্রা এতটাই ব্যাপক, এতদিন নারী এশিয়া কাপে কোন পরাজয়ের মুখ দেখতে হয়নি তাঁদের! ৬ বার এশিয়া কাপে অংশ নিয়েছে, প্রতিটিতেই তাঁরা অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে।
তবে ভারতের এমন গৌরবান্বিত রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে বাংলার সাহসী বাঘিনীরা। মালয়েশিয়ায় চলমান এশিয়া কাপ ক্রিকেটে অপ্রত্যাশিতভাবে শিরোপাপ্রত্যাশী ভারতকে হারিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের মেয়েরা, তাও আবার যেনতেন ভাবে নয়, ৭ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে!
টসে জিতে ব্যাট করতে নেমে ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারেই অফস্পিনার সালমা খাতুনের শিকার হন ওপেনার স্মৃতি মানধানা। এরপর চতুর্থ ওভারে রান আউট হন অধিনায়ক মিতালী রাজ। তৃতীয় উইকেট জুটিতে বেশ দ্রুতগতিতেই ৪৪ রান যোগ করেন পূজা বস্ত্রকর ও অধিনায়ক হারমানপ্রীত কৌর।
পূজা রান আউট হলেও ৪২ বলে ৫০ রানের জুটিতে রানের চাকা সচল রাখেন হারমানপ্রীত ও দীপ্তি শর্মা। কিন্তু ১৬ তম ওভারে হারমানপ্রীত আউট হতেই মড়ক লাগে ভারতীয় ইনিংসে। ১৪ রানের মধ্যে ৪ উইকেট হারিয়ে ৩ উইকেটে ১২০ থেকে হয়ে যায় ৭ উইকেটে ১৩৪। আর এই মড়ক লাগানোর কৃতিত্বটা বাংলাদেশ অধিনায়ক রুমানা আহমেদের। ১৮ তম ওভারে দীপ্তি ও অনুজা পাতিলকে আউট করে রানের চাকা শ্লথ করে দেন তিনি। এরপর শেষ ওভারে টুর্নামেন্টে নিজের প্রথম ম্যাচ খেলতে নামা ঝুলন গোস্বামীও রান আউট হলে নির্ধারিত ২০ ওভার শেষে ভারতের সংগ্রহ দাঁড়ায় ১৪১ রানে।
পাওয়ারপ্লেতে ২ উইকেট হারালেও ততক্ষণে ওপেনার শামীমা সুলতানার ঝোড়ো শুরুতে স্কোরবোর্ডে ৪৫ রান জমা করে ফেলেছে বাংলাদেশ। ৮ম ওভারে লেগস্পিনার পুনম যাদবের বলে আউট হয়ে নিগার সুলতানা ফিরে গেলে স্কোর দাঁড়ায় ৩ উইকেটে ৪৯ রান।
এরপর বাংলাদেশের ইনিংস পথ হারায় কি না, সে শঙ্কায় ছিলেন অনেকে। কিন্তু ফারজানা হক ও অধিনায়ক রুমানা যে অন্যকিছু ভেবে রেখেছিলেন এদিন! ৪র্থ উইকেট জুটিতে দুজনে মিলে যোগ করলেন অবিচ্ছিন্ন ৯৩ রান। অবিশ্বাস্য এই জুটিতে ভর করেই দুই বল বাকি থাকতে সাত উইকেট হাতে নিয়ে জয়ের বন্দরে ভিড়ে বাংলাদেশের জয়ের নৌকা। নিজের প্রথম আন্তর্জাতিক টি-২০ ফিফটি তুলে নেয়ার পথে ফারজানা মেরেছেন ৫ টি চার ও একটি ছয়। আর ছয় চারের সহায়তায় ক্যারিয়ার সেরা ৪২ রান করে অপরাজিত ছিলেন রুমানা।
বাংলাদেশ ম্যানেজার নাজমুল আবেদীন ফাহিম ম্যাচ শেষে বলেছেন, ‘মেয়েদের জন্য আমি ভীষণ খুশি। তাঁরা এমন কিছু অর্জন করেছে, যা তাঁদের সারাজীবনের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।’
বল হাতে ২১ রানে ৩ উইকেট, ও ব্যাট হাতে ৩৪ বলে ৪২ রানের অসাধারণ ম্যাচজয়ী ইনিংস, সব মিলিয়ে দারুণ অলরাউন্ড পারফরম্যান্সের ম্যাচসেরা হয়েছেন বাংলাদেশের অধিনায়ক রুমানা আহমেদ। তবে আলাদা করে বলতে হবে ওপেনার শামীমার কথাও। পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচেও বাংলাদেশের ইনিংস গতি পেয়েছিল তাঁর ব্যাটে। আজও তাঁর ৭ চারে সাজানো ২৩ বলে ৩৩ রানের ইনিংসটিই এমন মহিমান্বিত জয়ের ভিত্তি গড়ে দিয়েছে।
এশিয়ান ক্রিকেটে এতদিন অপরাজিত থাকা ভারতকে হারিয়েছে বলেই নয়, জয়টি মহিমান্বিত হয়ে থাকবে জয়ের ধরনের কারণেই। নিজেদের সক্ষমতার সীমানা যে এদিন নতুন করে লিখেছে বাংলাদেশের মেয়েরা! এতদিন টি-২০ ক্রিকেটে বাংলাদেশের মেয়েদের সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ ছিল ১৩৭ রান। জিততে হলে তাই নিজেদের সর্বোচ্চ স্কোরের রেকর্ডটাকে নতুন করেই লিখতে হতো বাংলাদেশের মেয়েদের। ফারজানা-রুমানা-শামীমাদের ব্যাটে চড়ে সেই অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করেছে বাংলাদেশ। চতুর্থ উইকেটে ফারজানা-রুমানার ৯৩ রানের জুটি টি-২০ ক্রিকেটে যেকোনো উইকেটে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রানের জুটি। এতদিন বংলাদেশের হয়ে টি-২০ তে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্কোরের মালিক ছিলেন ওপেনার শামীমা সুলতানা। কয়দিন আগেই সাউথ আফ্রিকা সিরিজে করেছিলেন ৫০ রান। আজ সেটিকেও ছাড়িয়ে গেলেন ফারজানা হক। ফারজানার ৫২ রানের ইনিংসটি এখন মেয়েদের বিশ ওভারের ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহ।