১৮০০ সালের শেষের দিকে জার্মান শিক্ষক উইলহেলম ভন অস্টেন তার বাড়ি বার্লিন থেকে কিছু বৈজ্ঞানিক কাগজপত্র নিয়ে এলেন। তিনি একইসাথে ছিলেন অনেককিছু তবে বিশেষ করে নিজেকে ফ্রেনোলজির একজন ছাত্র বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন অস্টেন। ফ্রেনোলজি হলো এমন একটি বিদ্যা, যে বিদ্যার সাহায্যে একটি প্রাণীর বুদ্ধিমত্তা, চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব তার মাথার আকার আকৃতি দেখে নির্ধারণ করা যায়। তবে অস্টেন মানুষের চাইতে পশুপাখির বুদ্ধিমত্তা নিয়েই আগ্রহী বেশি ছিলেন। তিনি মনে করতেন যে বুদ্ধিমত্তা আছে, এমন কোনো একটি প্রাণীকে যদি তিনি আবিষ্কার করতে পারেন, তাহলে তার নাম দিগ্বিদিক ছড়িয়ে পড়বে।
মানুষ কেবলমাত্র নিজের বুদ্ধিমত্তা নিয়েই ব্যস্ত এবং চারপাশের পশুপাখিদের মাঝে বুদ্ধি আছে কি নেই, তা নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন মানুষের নেই-এমন চিন্তায় বিশ্বাসী ছিলেন অস্টেন। তার এই ধারণা প্রমাণ করবার জন্য নিজের বাড়িতে একটি বিড়াল, ঘোড়া এবং ছোট আকারের ভালুক নিয়ে গেলেন পড়াশোনা শেখাবার জন্য। বিড়াল খুব বেশি দক্ষতা দেখাতে পারেনি, আঁচড়াতে কামড়াতেই দিন পার করে দিচ্ছিল। ভালুকটিকে দেখে মনে হলো যে এটি যেন আঘাত করতে পারলেই সুখ পায়। তবে হ্যান নামক আরব স্ট্যালিয়ন ঘোড়াটি যেন অস্টেনের বিস্ময়ের মাত্রাকে ছাড়িয়ে গেল। অস্টেন ক্রমেই বুঝতে পারছিলেন যে হ্যান হিসাব করতে জানে। তিনি বোর্ডে যে সংখ্যাটিই লিখতেন না কেন, হ্যান তার খুড়ের সাহায্যে মাটিতে ঠিক ততোবারই আওয়াজ করত। আশায় আশায় বুক বাঁধলেন অস্টেন। এবার বোধহয় তার এতদিনের গবেষণা সত্য হতে যাচ্ছে। তবে হ্যানের একটি সমস্যা ছিল। সে কেবলমাত্র এক থেকে দশ পর্যন্ত সংখ্যা গুণতে পারত। এর বেশি সংখ্যা গুনতে পারত না সে।
কিন্তু তাই বা কম কিসে? অস্টেন তার ছাত্রকে আরও কিছু শেখার জন্য চাপ দিতে শুরু করলেন। তিনি চকের সাহায্যে বোর্ডে কিছু সাধারণ বীজগাণিতিক হিসাব লিখতে শুরু করলেন এবং গণিতের কিছু সহজ চিহ্ন শেখাবার চেষ্টা করলেন। হ্যানের এগুলো শিখতে কোনো ধরনের সমস্যাই রইল না। বরং সে যেন অস্টেনের মনের কথাই বেশ ভালোভাবে বুঝতে শুরু করল। আস্তে আস্তে অস্টেনের তৈরি কারিকুলামের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিল সে। খুব দ্রুতই শিখে ফেলল অস্টেন তাকে কী শেখাতে চাইছে।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে হ্যানের মালিক উইলহেলম ভন অলস্টেন মানুষকে এটাই বোঝাতে চাইতেন যে তার ঘোড়া কোনো সাধারণ ঘোড়া নয়। এটি বেশ বুদ্ধিমান ও মানুষের ন্যায় গণনা ও কঠিন কঠিনসব হিসাব নিমিষেই করে ফেলবার সক্ষমতা রাখে। অলস্টেন ছিলেন একজন গণিতের শিক্ষক এবং জার্মানী থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হ্যানকে নিয়ে যেতেন প্রদর্শনীর উদ্দেশ্যে। মানুষ যাতে হ্যানকে দেখে চমৎকৃত হয়, হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। দর্শকের প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য চালাক হ্যান তার পা মাটিতে ঠুকে দিত। কিছু কিছু ব্যক্তি হ্যানের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলত। তারা বলত যে অলস্টেন একজন বুজরুক এবং তিনি এই ঘোড়াটি নিয়ে নানা ধরনের লোকঠকানো খেলা দেখিয়ে যাচ্ছেন। তাই হ্যানকে তার মালিকের কাছ থেকে অন্যথায় সরিয়ে নিয়ে নানাভাবে পরীক্ষা করা হয়। আশ্চর্যের বিষয়, হ্যান সবগুলো পরীক্ষাতেই পাশ করে। হ্যান ধরা পড়ে যায় যখন তাকে এমন একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করা হয়, যেটির উত্তর সে জানত না। হ্যানের উত্তর দেয়ার বিষয়টি বেশ মজার।
একটি প্রশ্ন করবার পর সে মাটিতে পা ঠুকে যেত এবং প্রশ্নকর্তা যতক্ষণ না আশ্বস্ত হচ্ছেন, সে বুঝে নিত যে প্রশ্নের উত্তর দেয়া এখনো শেষ হয়নি। চালাক হ্যান যখন বুঝতে পারত যে সে উত্তরের কাছে পৌঁছে গিয়েছে, তখন সে মাটিতে পা ঠোকা থামিয়ে দিত এবং লোকজন হাঁ হয়ে যেত। নানা পুরস্কার ও হাততালি কুড়িয়ে নিত হ্যান। এরসাথে গণিত পারা কিংবা কঠিন কঠিন সব হিসাব করবার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে মানুষের মনস্তত্ব বোঝার জন্য হ্যানকে তার প্রাপ্য সম্মানটা দেয়াই যায়, কি বলুন?