গত মার্চের ৩০ তারিখ বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকায় আবারও স্থান করে নিয়েছে ডেনমার্ক। ১৫৫টি দেশের মাঝে জরিপে দেখা গিয়েছে প্রথম তিনটি দেশের মাঝেই ডেনমার্কের নাম রয়েছে। গত সাত বছর ধরে অত্যন্ত গর্বের সাথে ডেনমার্কবাসীরা বলতেই পারে যে তাদের দেশে কোনো ধরনের দাঙ্গা ফ্যাসাদ নেই। আচ্ছা, ডেনমার্ক যে এত সুখী একটি দেশ, তার কারণ কী হতে পারে? ‘দ্য কনভার্সেশন’-এর তথ্যমতে আজ আপনাদের এটি সম্পর্কেই কিছু তথ্য দেয়ার চেষ্টা করা হবে।
তবে ডেনমার্কের সাথে যে দেশটির তুলনা করা হয়েছে, তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। দশের মাঝে না থাকলেও বিশের মধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রটির অবস্থান রয়েছে। তা হচ্ছে ১৮তম। গত বছরের তুলনায় দেশটির অবস্থান আরও কিছুটা নেমেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বিশ্বের অন্য যে কোনো ধরনের গবেষণাতেই ডেনমার্কের নাম ওপরের দিকেই থাকে। আর তা বলাই বাহুল্য, দেশটি অন্যতম সুখী একটি রাষ্ট্র। মনস্তত্ববিদদের ভাষায়, এই দেশের অধিবাসীরা বেশ সুখেই জীবন যাপন করেন। বিজ্ঞানীরা অনেক কিছু নিয়েই গবেষণা করতে পছন্দ করেন। তাদের মাঝে চলতে থাকে তর্ক বিতর্ক। তবে যখন ‘সুখ’ শব্দটি নিরূপণ করতে বলা হয়, সাধারণ কিছু ধারণা এমনিতেই মাথায় এসে যায়।
অপরাধের মাত্রা, আয়, নাগরিক যোগ, এবং স্বাস্থ্যহার- মূলত এই চারটি বিষয়ের ওপর একটি সুখী রাষ্ট্রের তালিকা নিরূপণ করা হয়ে থাকে। জনগণ তাদের মানসিক অবস্থানটি ভালোভাবে জানাতে পারছে কিনা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে কিনা, সেটিও থাকে এই তালিকায়। মৌলিক চাহিদাগুলো যখন পূরণ হতে থাকে, আপনাতেই একটি দেশের মানুষ নিজেদের সাম্যাবস্থায় আবিষ্কার করে। তবে ডেনমার্কের শাসনব্যবস্থার দিকেও কিছুটা নজর দেয়া প্রয়োজন।
ডেনমার্কের সরকার মূলত একটি স্থিতিশীল সরকার। সেখানে দুর্নীতির তেমন কোনো প্রভাব নেই, উচ্চশিক্ষা ও শিক্ষিতের হার অনেক বেশী এবং সকল জনগণের জন্য স্বাস্থ্যব্যবস্থা বেশ ভালোভাবেই নিশ্চিত করা হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ডেনমার্ক হচ্ছে বিশ্বের একটি অন্যতম রাষ্ট্র যেখানে জনসাধারণ খুশিমনেই কর প্রদান করে থাকে। সেখানে কর ফাঁকি দেবার মতো কোনো ঘটনা ঘটে না। ডেনমার্কের জনসাধারণের মাঝে একটি জরিপ চালানো হয়। সে জরিপ অনুযায়ী ৯৪ শতাংশেরও অধিক মানুষ মনে করেন যে নিয়মিত কর প্রদান করে একটি উন্নত সমাজ গঠন করা সম্ভব।
ডেনমার্কের জনসাধারণ যে সমাজব্যবস্থা মেনে চলে, সেটির নাম Hygge.
অক্সফোর্ড অভিধানে ২০১৭ সালের জুন মাসে এই শব্দটি যোগ করা হয়। এর মানে হচ্ছে উন্নত সমাজ ব্যবস্থা। বিশেষ্য, বিশেষণ কিংবা ক্রিয়া, এই তিনটি অর্থেই এই Hygge শব্দটি ব্যবহার করা যেতে পারে। যে স্থানে সুন্দর ও উন্নত ব্যবস্থা রয়েছে, তাকে বলা হয়ে থাকে Hyggelige. অনেকসময় এই শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় “আরামদায়ক”, তবে আরও ভালোভাবে বলতে গেলে “ইচ্ছাকৃত সৌহার্দ্য”। যখন একজন ব্যক্তি নিজের সুন্দর অবস্থান চমৎকারভাবে অপরের সাথে আলোচনা করতে পারবে, তখনি কেবলমাত্র এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। ডেনমার্কের পরিবারে এই হাইজিকে খুব গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে। কারো বাড়িতে বেড়াতে এলে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয় যেন সেখানে একটি ‘কোয়ালিটি’ টাইমের ব্যাপার থাকে। অতিথিকে বাসিমুখে ফেরত যেতে দিতে ডেনমার্কের অধিবাসীরা কেউই চায় না। এমনকি খেলাধূলা কিংবা পড়াশোনা করবার সময়ও তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাতে সেখানে একটি সাম্যাবস্থা বজায় থাকে। ডেনমার্কে এই হাইজি বিষয়টির ওপর নানাধরনের গবেষণা করা হয় এবং হচ্ছে। উন্নত একটি সমাজব্যবস্থা কী করে গড়া যায়, তা নিয়ে ডেনমার্কবাসী বদ্ধপরিকর।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, শব্দটি শুধুমাত্র ডেনমার্কের মাঝেই সীমাবদ্ধ নেই। হাইজি এখন ছড়িয়ে গিয়েছে সারাবিশ্বে। অ্যামাজনে দেদারসে মানুষ অর্ডার দিচ্ছেন এই বিষয়ক বই। ইন্সটাগ্রামে মানুষ একে অন্যকে পরামর্শ দিচ্ছে কেমন করে একটি সুখী সমাজ গঠন করা যায় (অবশ্যই তা ভালো ভালো ছবি আপলোড করবার মাধ্যমে)। ২০১৬ সালে গুগলের অন্যতম একটি ট্রেন্ডি শব্দ হলো এই Hygge. শুধুমাত্র ডেনমার্কেই না, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও একই চিন্তাধারার বিভিন্ন টার্ম সৃষ্টি হয়েছে। নরওয়ের কাছে কোসেলিগ, সুইডেনে মিসিগ, হল্যান্ডে গেজেনলিখেইড ও জার্মানীতে গেমুটলিখেইট।
আবারও ফিরে আসি যুক্তরাষ্ট্রের কথায়। যে দেশে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে খুব বেশিমাত্রায় গুরুত্ব দেয়া হয়, সে দেশে আসলে সম্পর্কগুলোকে খুব বেশী স্থায়ী করবার চেষ্টা করা হয়না। আয় মূলত মানুষের সুখী হবার সাথে জড়িত। আপনি যত আয় করবেন, আপনার মনে সুখও তত বেশী হবে। নিজের চাহিদাগুলো বেশ ভালোভাবেই মেটাতে পারবেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এসে দেখা যাচ্ছে যে মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ অনেক বেশী হলেও সেখানে মানসিক সুখের পরিমাণ অনেক কম। সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে, আত্মহত্যার হারও যুক্তরাষ্ট্রে অনেক বেশী।
ডেনমার্কের মানুষের মাঝে একটি বিশ্বাস রয়েছে। আর তা হচ্ছে, বিপদে আপদে পাশের বাড়ির লোক তাকে সাহায্য করবেই। মানুষ মানুষের সাহায্যে যদি এগিয়ে না আসে, তাহলে আর কে আসবে বলুন? সামাজিক অন্তরঙ্গতার ক্ষেত্রে তাই অপরাপর দেশ থেকে এতটা এগিয়ে গিয়েছে ডেনমার্ক। সবকিছুর মূলে রয়েছে এই Hygge
শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রই নয়, ডেনমার্কের কাছ থেকে এই মূল্যবোধ বোধহয় আমরাও শিখতে পারি। তাই নয় কি?
(সূত্রঃ লাইভ সাইন্স)