কিছুদিন আগেই মুক্তি পেল মার্ভেলের কৃষ্ণাঙ্গ সুপারহিরো ‘ব্ল্যাক প্যান্থার’এর প্রথম কিস্তি। ছবিতে দেখানো হয়েছে আফ্রিকা মহাদেশের একটি কল্পিত রাজ্য ওয়াকান্ডাকে, যেখানে রয়েছে প্রযুক্তি ও সমৃদ্ধির আশ্চর্য মেলবন্ধন। ছবিটি যারা যারা দেখেছেন, তারা একবাক্যে স্বীকার করবেন যে মার্ভেলের এর আগের কোনো সুপারহিরো ফ্র্যাঞ্চাইজে প্রযুক্তির এমন চমৎকার ব্যবহার দেখানো হয়নি। স্বয়ংক্রিয় আকাশযান, ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সাহায্যে নিয়ন্ত্রণযোগ্য গাড়ি এবং উড়োজাহাজ, উচ্চমাত্রার হলোগ্রাফিক ডিসপ্লে এবং তাড়িত চৌম্বকের সাহায্যে ট্রেনচালনা পদ্ধতি- এ সবকিছুই দেখানো হয়েছে ছবিতে।
এছাড়াও ব্ল্যাক প্যান্থারের (নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন চ্যাডউইক বোজম্যান) সুপারহিরো স্যুটে রয়েছে আধুনিক উদ্ভাবনী ক্ষমতার মিশেল, যেখানে দেখানো হয়েছে শক্তি, গতি এবং অভেদ্যতা- সবকিছুই বেড়ে যায় স্যুটটি পরিধান করলে। এছাড়াও বিপুল পরিমাণে গতিশক্তির অধিকারী হন টি’চালা ওরফে ব্ল্যাক প্যান্থার। তার শক্তি এতটাই বেড়ে যায় যে, গাড়ির সাথে দৌড়ে পাল্লা দেন তিনি! ছবিটি দেখে অনেকেই ভাবতে পারেন যে আসলেই কি এমন কিছু করা সম্ভব? তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি, এই ছবিতে প্রযুক্তির যেসকল ব্যবহার দেখানো হয়েছে, তার সবকিছুই বর্তমান বিজ্ঞানের যুগে সম্ভব। গত মার্চের ৩০ তারিখে দ্য ফিউচার কন প্যানেল সেশন আয়োজিত একটি সেমিনার আয়োজন করা হয়েছিল, যার বিষয় হচ্ছে ‘দ্য সাইন্স অব ব্ল্যাক প্যান্থার’, যার মোদ্দাকথায় দাঁড়ায় যে ব্ল্যাক প্যান্থার ছবিতে যেসকল বিজ্ঞানভিত্তিক প্রায়োগিক রুপ দেখানো হয়েছে, তা সম্পর্কে আলাপচারিতা। এই সেমিনারে ছবির সাথে যুক্ত বিভিন্ন গবেষক ও বিশিষ্টরা এমন সব বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করেছেন, যা খুবই চমকপ্রদ ও উপভোগ্য। বিশেষ করে ভাইব্রেনিয়াম নামক মৌল সম্পর্কে- মূলত এই মৌলই ওয়াকান্ডার প্রাযুক্তিক উৎকর্ষতা ও সম্পদের প্রধান হাতিয়ার।
ছবিতে দেখানো হয়েছে বর্তমান বিশ্বে ওয়াকান্ডা এমন একটি অবস্থানে রয়েছে, যেখানে প্রযুক্তির ব্যবহারের সাহায্যে দেশটি সমগ্র বিশ্বের ওপর ছড়ি ঘোরাতে পারে। অবশ্য এজন্য কল্পিত মৌল ভাইব্রেনিয়ামকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়। এটির প্রাচুর্যের কারণেই তো ওয়াকান্ডা এত সমৃদ্ধ! তবে লিনেট ড্রেক, উল্লেখিত সেমিনারের একজন প্রধান প্রজেক্ট লিডার বলেছেন যে শুধুমাত্র কল্পনাতেই নয়, আফ্রিকা মহাদেশে টাইটেনিয়াম ও ক্রোমিয়ামের মতো দুর্লভ ও দুষ্প্রাপ্য মৌলেরও খোঁজ পাওয়া যেতে পারে বিপুল পরিমাণে। তিনি লকহিড মার্টিন নামক একটি প্রজেক্টের সাথেও জড়িত। এই প্রজেক্ট মূলত পরিবেশের সাথে প্রকৌশলবিদ্যার মেলবন্ধন কী করে ঘটানো যায়, তা নিয়ে কাজ করে।
চৌম্বকক্ষেত্র লেভিটেশন বা ম্যাগলেভ সম্পর্কিত একটি প্রযুক্তি এই ছবিতে দেখানো হয়েছে। বর্তমানে জাপান, চীন এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোতে আমরা হাইস্পিড ট্রেনগুলোর ক্ষেত্রে প্রাযুক্তিক ব্যবহার দেখতেই পেয়েছি এধরনের। ঘর্ষণের বাঁধা এড়িয়ে ট্রেনগুলো আরও দ্রুত কীভাবে ছুটতে পারে, এই ব্যবহারই করা হয়েছে উল্লেখ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে। চার্লস জনসন-বে নামক একজন প্রকৌশলী বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেন সেমিনারে।
টি’চালার পোষাকে একধরনের নমনীয় ন্যানোম্যাটেরিয়ালের সংযোজন ঘটানো হয়েছে, যার সাহায্যে শরীরের বিভিন্ন অংশের কার্যাবলী সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। যেমন হার্টরেট সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য তারবিহীনভাবেই কম্পিউটার কিংবা স্মার্টফোনে প্রেরণ করা যায়। শরীরের সাথে আঁটসাঁট হয়ে থাকা এই পোষাক বহিঃকঙ্কালের গতি ও শক্তিও বাড়িয়ে দেয় বিপুল পরিমাণে।
তবে কিছু কিছু জিনিস এখনও বিজ্ঞানের সাহায্যে করা সম্ভব নয়, কল্পনার আশ্রয় নিতেই হয়। যেমন পুরো স্যুটটি ব্ল্যাক প্যান্থারের গলার নেকলেসের ভেতরে প্রেরণ করা। তবে জনসন বলেন যে এখন সম্ভব নয় বলে ভবিষ্যতেও যে সম্ভব হবেনা, এমনটি মোটেও ধরে নেয়া ঠিক হবে না। আমরা কোথাও বেড়াতে যেতে হলে একগাদা জামাকাপড় নিয়ে যাই, বোঝা ভারী হয়। যদি এমন কোনো প্রযুক্তি সত্যিই চলে আসে, যেখানে কাপড় ছোট করে সহজেই কোথাও এঁটে ফেলা যাবে, নিঃসন্দেহে সেটি বিজ্ঞানের একটি জয় হিসেবেই স্বীকৃত হবে।
ওয়াকান্ডার প্রাযুক্তিক উৎকর্ষতা, ব্ল্যাক প্যান্থারের চমৎকার অতিমানবীয় পোষাক- এসবকিছু তৈরির কৃতিত্ব দিতে হয় ব্ল্যাক প্যান্থারের ছোটবোন শুরিকে। অসম্ভবকে সম্ভব করা একজন বিজ্ঞানী তিনি। কমবয়সেই তার এত এত অর্জন কিন্তু বাস্তবের মেয়েদের প্রতি একটি উল্লেখযোগ্য বার্তা হয়েই থাকবে। আর তা হচ্ছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগতে মেয়েরা ছেলেদের চাইতে বরং কয়েকগুণ এগিয়ে থাকতে পারে। বিশেষ করে সেসব মেয়েরা, যারা তাদের চামড়ার রঙ নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগে থাকেন এবং মিডিয়াতেও যাদেরকে তুচ্ছ করে দেখানো হয়। ড্রেক নারী হিসেবে শুরি চরিত্রটিকে নিজের সাথে একাত্ম করতে পেরেছেন এবং তিনি বলেছেন বর্তমান যুগে মেয়েদের বিজ্ঞানের দিকে আরও এগিয়ে আসতে হবে, পিছিয়ে থাকলে চলবে না। কল্পিত রাজ্য ওয়াকান্ডাকে সম্পূর্ণ পরিবর্তন করতে সম্ভব নেহাত ২০-২২ বছরের এক তরুনী।
তাহলে এই ছবি থেকেই মেয়েরা কেন শিক্ষা নিতে পারবে না? সুপারহিরো ছবি বলে কেবল এর রস আস্বাদন করলেই হবেনা, বরং সাথে সাথে গ্রহণ করতে হবে অন্তর্নিহিত অর্থও। সেমিনারে একজন জিজ্ঞাসাও করেছিলেন যে যদি ভবিষ্যতে কেউ ওয়াকান্দাকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে যেতে চায়, তাহলে সে চিন্তাভাবনা একমাত্র কার দ্বারা সম্ভব হতে পারে? ওয়াশিংটন পোস্টের এক সাংবাদিক ডেভিড বেটানকোর্ট নির্ভীক চিত্তে উত্তর দিয়েছেন, এটাও কেবলমাত্র শুরির দ্বারাই সম্ভব।
(সূত্রঃ লাইভ সাইন্স)