আইসিসির হল অফ ফেমে তিন পাকিস্তানি জাভেদ মিয়াঁদাদ, ইমরান খান ও হানিফ মোহাম্মদের অন্তর্ভুক্তির পর এক বারো বছর বয়সী বালক তার চাচাকে জিজ্ঞেস করলো, ইমরান-মিয়াঁদাদের সাথে এই তালিকায় হানিফ কেন? কে এই হানিফ? ওয়াসিম-ইনজামামরা যেই তালিকায় জায়গা পাননি, সেই তালিকায় এই হানিফ কে?
ছেলেটিকে খুব একটা দোষও দেয়া যায়না। সে বেড়ে উঠেছে ১৯৯২ বিশ্বকাপের ডিভিডি দেখে, শারজার সেই ছয়ের কাহিনী শুনে শুনে, রিভার্স সুইং বোলিংয়ের মাহাত্ম্য শুনে শুনে। হানিফ মোহাম্মদকে তাই তার না চেনারই কথা। কিন্তু যারা হানিফের খেলা দেখেছেন, তারা জানেন, কোন মাপের ব্যাটসম্যান ছিলেন এই হানিফ মোহাম্মদ।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে বিরলতম জিনিসগুলোর একটি হলো এক ইনিংসে একজন ব্যাটসম্যানের ৪০০ কিংবা তার চেয়ে বেশি রান করা। দেড়শ বছরের ক্রিকেট ইতিহাসে এক ব্যাটসম্যানের থেকে ৪০০+ রান দেখেছে মাত্র ১০ বার। ছোট্ট সেই তালিকায় নাম আছে হানিফ মোহাম্মদেরও। প্রায় ছয় দশক আগে ১৯৫৯ সালের জানুয়ারি মাসে রেকর্ডবুকের এক শিখরে উঠেছিলেন হানিফ। করাচির মাটিতে করাচির হয়েই খেলেছিলেন ৪৯৯ রানের এক ইনিংস। ওয়ারউইকশায়ারের হয়ে ব্রায়ান লারা ছাড়িয়ে যাওয়ার আগে হানিফের এই ইনিংসটিই ছিল প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে কোন ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংসের রেকর্ড, যা টিকে ছিল ৩৫ বছর। এখানেই শেষ নয়, হানিফের ইনিংসের মাহাত্ম্য ছিল আরও এক জায়গায়। রেকর্ডটি যে তিনি করেছিলেন স্বয়ং ডন ব্র্যাডম্যানের রেকর্ড ভেঙে!
১৯৩০ সালে সিডনিতে কুইন্সল্যান্ডের বিপক্ষে অপরাজিত ৪৫২ রানের ইনিংস খেলে এই রেকর্ডের মালিক হয়েছিলেন নিউ সাউথ ওয়েলসের ব্র্যাডম্যান। হানিফ ভেঙে দেয়ার আগে রেকর্ডটি টিকে ছিল প্রায় তিন দশক। হানিফকে এক কথায় বোঝাতে গেলে তাই সবার আগে এই ৪৯৯ রানের ইনিংসটির কথাই আসে।
বর্ষীয়ান পাকিস্তানি সাংবাদিক কামার আহমেদের ভাষ্যমতে, হানিফকে বল করা ছিল একজন বোলারের পক্ষে সবচেয়ে হতাশাজনক বিষয়। কামারও হানিফের সাথে একই সময়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেছেন। বোলারদের অসহায়ত্বটা তাই খুব কাছ থেকেই দেখেছেন তিনি। তবে তার আরও একটি পরিচয় আছে। ঐতিহাসিক ওই ৪৯৯ রানের ইনিংসটির ঠিক আগের ইনিংসেই হানিফকে আউট করেছিলেন কামার।
পাকিস্তানের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট টুর্নামেন্ট কায়েদে আজম ট্রফির শেষভাগের ম্যাচ ছিল সেটি। জাতীয় দলের বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় সম্বলিত টুর্নামেন্টের সবচেয়ে শক্তিশালী দল করাচির হয়ে খেলছিলেন হানিফ। হায়দ্রাবাদের হয়ে হানিফকে বল করেছিলেন কামার, করাচি ম্যাচটা জিতেছিল ইনিংস ব্যবধানে। হানিফ ততদিনে পাকিস্তানে ব্যাপক জনপ্রিয়, পাকিস্তানের শীর্ষ আন্তর্জাতিক মানের ব্যাটসম্যান। বছর খানিক আগেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে করেছেন মাহাত্ম্যপূর্ণ সেই ট্রিপল সেঞ্চুরি। হানিফের ক্যারিয়ারের তো বটেই, টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা ট্রিপল সেঞ্চুরি বলে মানা হয় এটিকে।
১৯৫৮ সালের জানুয়ারিতে বার্বাডোজে ওয়েস্ট ইন্ডিজ-পাকিস্তান টেস্ট। এই প্রথমবারের মতো ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট খেলছে পাকিস্তান। প্রথম ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৫৭৯ রানের বিশাল সংগ্রহের বিপরীতে পাকিস্তান গুটিয়ে গেলো মাত্র ১০৬ রানে। তৃতীয় দিন বিকেলে আবার ওপেন করতে নামলেন হানিফ। তখন ম্যাচ হতো ছয় দিনে, অর্থাৎ ম্যাচ বাঁচাতে হলে তিন দিন ক্রিজে থাকতে হবে পাকিস্তানী ব্যাটসম্যানদের।
টেকনিক বা টেম্পারমেন্টের দিক থেকে হয়তো সেরা ছিলেন না, কিন্তু মনোযোগ ধরে রাখার ব্যাপারে হানিফ ছিলেন সেরা। প্রত্যেকটা বল এত নিবেদনের সাথে খেললেন, যেন এটিই তাঁর প্রথম বল। ভয়ংকর ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান পেস বোলারদের সামলাতে হচ্ছিল ক্রমশ খারাপ হতে থাকা উইকেটে। তাও একবারের জন্যেও বল থেকে চোখ সরাননি, পজিশনে কোন ভুল করেননি। মাথায় কোন হেলমেট ছিলোনা, এমনকি প্যাডগুলোও ছিল খুব হালকা। কোন আর্ম গার্ড ছিল না। থাই প্যাড হিসেবে কি ব্যবহার করেছিলেন জানেন? মোটা একটি রুমাল!
তারপরেও ওই টেস্টে হানিফ কত করেছিলেন জানেন? ৩৩৭ রান! এর আগে টেস্ট ক্রিকেট ট্রিপল সেঞ্চুরি দেখেছে প্রায় বিশটির মতো, কিন্তু কোনটিই দ্বিতীয় ইনিংসে নয়। সাথে যদি যোগ করেন ৪৭৩ রান পিছিয়ে থেকে ফলো অনে ব্যাট করতে নামার মানসিক চাপটাও, হানিফের ইনিংস অনন্য মর্যাদা পাবেই।
কায়েদে আজম ট্রফির সেমিফাইনালে বহলপুরের মুখোমুখি করাচি। তখনো করাচির পার্সি ইন্সটিটিউট গ্রাউন্ডের দর্শকেরা জানতেন না অমরত্বের সাক্ষী হতে চলেছেন তারা।
প্রথম দিন চা বিরতির আগেই বহলপুর অল আউট ১৮৫ রানে। এরপরই শুরু হানিফের রাজত্ব। দ্বিতীয় দিন শেষ হতে হতে হানিফ পৌঁছে গেলেন ২৫৫ রানে।
নিজের দল বাদ পরে গেলেও কামার ১০০ মাইল বাস ভ্রমণ করে হায়দ্রাবাদ থেকে এই ম্যাচ দেখতে এসেছিলেন করাচিতে, শুধু হানিফের ব্যাটিং দেখার জন্য। করাচিতে হোটেল ভাড়া দিয়ে রাতে থাকতে চাইলেন না কামার, ফিরে এলেন হায়দ্রাবাদে। ২৫৫ তো করেই ফেলেছেন, আরও কতই বা করবেন? এই ভেবে ফেরত গেলেন কামার।
কিন্তু কামার জানবেন কীভাবে, এই টেস্টে হানিফের আরও অনেক রান করা বাকি! নিজের আত্মজীবনীতে হানিফ বলেছেন, ৩০০ এর কাছাকাছি গিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর ভাই ও অধিনায়ক ওয়াজির মোহাম্মদ তাঁকে খেলা চালিয়ে যেতে বলেছিলেন। ওয়াজির এতটাই আগ্রহী ছিলেন, সেদিন সন্ধ্যায় নিজে হাতে হানিফকে অলিভ অয়েল মেখে দিয়েছিলেন, যেন তিনি একটু আরাম পান।
পরের দিন সকাল সকালই ৩০০ পেরিয়ে গেলেন হানিফ, চা বিরতির পরে লেগ সাইডে বাউন্ডারি মেরে ভেঙে দিলেন ব্র্যাডম্যানের ৪৫২ রানের রেকর্ড। এরপর শুধুই ৫০০ রানের প্রতীক্ষা, যেখানে আগে কখনো পৌঁছাতে পারেননি কেউ।
দিনের খেলা শেষ হতে বাকি ছিল মাত্র দুই বল। স্কোরকার্ডের দিকে তাকিয়ে দেখলেন তাঁর স্কোর দেখাচ্ছে ৪৯৬। ভাবলেন অধিনায়ক হয়তো সকালে আর ব্যাট করতে নামাবেনই না, রাতের স্কোরেই ইনিংস ঘোষণা করে দেবেন। পরের বলটা পয়েন্টে ঠেলে দিয়ে নিতে পারলেন এক রান, কিন্তু ফিল্ডার ঠিকমতো বল ধরতে না পারায় দুই রানের জন্য দৌড়ালেন। কিন্তু ক্রিজ অব্দি পোঁছাতে পারলেন না, তাঁর আগেই উইকেটকিপার ভেঙে দিলেন উইকেট।
হিসাব মতো হানিফের আউট হওয়ার কথা ৪৯৭ তে, কিন্তু ফিরে যাওয়ার সময় অবাক বিস্ময়ে তিনি লক্ষ্য করলেন, তাঁর স্কোর দেখাচ্ছে ৪৯৯! হানিফ কিছুই বুঝতে পারলেন না। আসলে দুই বল বাকি থাকতেই হানিফের রান ছিল ৪৯৮, কিন্তু স্কোরকার্ডের দায়িত্বে যিনি ছিলেন, তিনি ৮ অঙ্কটা খুঁজে পাচ্ছিলেন না, তাই ৪৯৬ তেই রেখে দিয়েছিলেন হানিফের স্কোর। সব জানার পরে ভীষণ ক্ষেপে যান হানিফ, ‘আমি যদি জানতাম আমার স্কোর ৪৯৮, তাহলে আমি তাড়াহুড়া করে দুই নিতে যেতাম না, শেষ বল পর্যন্তই অপেক্ষা করতাম।’
ম্যাচ শেষে বহলপুরের অধিনায়ক তাঁর দল নিয়ে করাচির ড্রেসিংরুমে এলেন হানিফকে অভিনন্দন জানাতে, সাথে বললেন, ‘বলেছিলাম না কোন এক পর্যায়ে তোমাকে আউট করবোই? অন্তত ৫০০ তো করতে দেইনি তোমাকে!’
পরের দিন সকালে যখন খবরের কাগজে হানিফের এই কীর্তির খবর এল, অনেকের শুভেচ্ছাবার্তায় সিক্ত হলেন হানিফ। এমনকি যেই ব্র্যাডম্যানের রেকর্ড ভেঙ্গেছেন, শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন সেই ব্র্যাডম্যান নিজেও। হানিফ যেই উচ্চতায় পৌঁছাতে পারেননি, ৩৫ বছর পরে সেই উচ্চতায় উঠেছিলেন ক্রিকেটের আরেক কিংবদন্তি, ব্রায়ান লারা। লারাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন হানিফ, সাথে আক্ষেপ করে এও জানিয়েছিলেন, ভাগ্য সহায় হলে প্রথম এই রেকর্ডের মালিক হতেন ক্রিকেটের প্রথম ‘লিটল মাস্টার’ হানিফ মোহাম্মদই!
ক্রিকইনফো অবলম্বনে