একনায়ক
শব্দটি শুনলে প্রথমে আপনার মাথায় কোন কথাটি আসবে বলুন তো? অত্যাচারী, নিপীড়নকারী এমনই আরো কতশত কথা, তাই না? মান্য না করবার জন্য ইতিহাসে এমন অনেক একনায়ক রয়েছেন যারা প্রজাদের কিংবা জনগণকে হত্যা করতে বা চরমতম সিদ্ধান্ত নিতেও পিছপা হননি। তবে জেনে অবাক হবেন, পৃথিবীতে এমনও অনেক একনায়ক ছিল, যারা নিজেদেরকে তুলে নিয়ে গিয়েছেন অনন্য উচ্চতায়। প্রজাহিতৈষীতার জন্য হয়েছেন জগতজুড়ে সমাদৃত। জীবনের একটি অস্থির সময় কাটিয়ে তারা হয়ে উঠেছিলেন মানবতার মূর্ত প্রতীক। আসুন, জেনে নেয়া যাক এমনই কিছু একনায়কদের সম্পর্কে।
সম্রাট অশোক
সম্রাট অশোক একজন ভারতীয় সম্রাট। ২৬৮ থেকে ২৩২ খ্রিস্টপূর্ব সনে তিনি মৌর্য শাসক ছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় সমস্ত অঞ্চলই তিনি শাসন করেছেন, যার বিস্তার বাংলা থেকে বর্তমানের আফগানিস্তান পর্যন্ত ছিল। কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়াবহতার পরপরই তার মনে বড় ধরনের একটি পরিবর্তন ঘটে এবং মানুষ ও অন্যান্য জীবের প্রতি তার দয়া দাক্ষিণ্য বেড়ে যায়।
ইতিহাস অনুযায়ী জানা যায়, সম্রাট অশোক অত্যন্ত রক্তপিপাসু ও অত্যাচারী সম্রাট ছিলেন, এমনকি প্রজাদের নির্যাতন করবার জন্য তার একটি ব্যক্তিগত টর্চার চেম্বারও ছিল। তবে ২৬০ খ্রিস্টপূর্বে সংঘটিত কলিঙ্গ যুদ্ধের পর তার মনোভাবে আমূল পরিবর্তন আসে এবং যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং রক্তপাত মনে বিশেষভাবে দাগ কেটে যায়। বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হবার পর তিনি ১৩টি মন্ত্র বা নির্বাণশিক্ষা দেন যেগুলো ইতিহাসবিদরা উদ্ধার করতে পেরেছেন। এই কাজগুলো অনুযায়ী সম্রাট অশোক তার সাম্রাজ্য এবং তার আশেপাশে সকল মানুষ ও পরশুপাখির জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করেন।
রাজকীয় সফরে প্রাণীহত্যা তিনি আইন করে বন্ধ করে দেন (যেহেতু তৎকালীন সময়ে রাজবিহারে বেরিয়ে অনেকেই খেয়ালে কিংবা খেলার বশে প্রাণী হত্যা করত)। শুধুমাত্র খাবার এবং চিকিৎসার সুবিধার্থে পশু হত্যা করা যাবে বা তাদের শিকার করা যাবে, এমনটি বলে দেন তিনি। এছাড়াও প্রজাদের সুবিধার্থে তিনি বৃক্ষরোপণ করেন এবং খাল খনন করেন। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে একজন পথিক যাতে সুপেয় জল পায়, সেজন্য তিনি কূপও খনন করেন। বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারে লক্ষ্যে তিনি ছিলেন একজন অগ্রদূত এবং এধর্মের নানা সুমহান বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য বেশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।
কামাল পাশা
কামাল পাশা তুরস্কের প্রেসিডেন্ট হন ১৯২২ সালে এবং ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় থাকেন। তিনি ছিলেন একজন জাতীয়তাবাদী এবং অটোমান সাম্রাজ্য থেকে যেসব ইউরোপীয়রা এসে এখানে বসতি স্থাপন করেছিল, তাদের বিরুদ্ধে তিনি সেনাবাহিনী গড়ে তুলে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ১৯৩৫ সালে তাকে খেতাব দেয়া হয় “আতাতুর্ক” যার মানে, তুরস্কের পিতা। তুরস্ককে তিনি এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে যান যেটি পূর্বের অবস্থান থেকে অনেক ভালো।
১৯২১ সালে কামাল তুরস্কের হাল নিজের হাতে তুলে নেন এবং ১৯২২ সালে দেশটির প্রেসিডেন্ট হন। ১৯২৩ সালে রিপাবলিক অব টার্কি গঠন করেন, ১৯২৪ সালে খলিফাত প্রথা উঠিয়ে দেন। তিনি একটি মাত্র দলের শাসন ব্যবস্থা প্রচলন করেন যেটি ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত বলবৎ ছিল। যদিও কামাল পাশা সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন কিন্তু তিনি শাসনাবস্থায় থাকাকালে কখনও তার সামরিক পদ বা ক্ষমতা ব্যবহার করেননি। মোটকথায়, সমগ্র তুরস্ককে আজকের অবস্থানে আনতে শুধুমাত্র তার একার শাসন ও নীতিই দায়ী। ১৯৩৪ সালে নারীদের ভোটাধিকার প্রদানের মাধ্যমে তিনি সমানাধিকার প্রবর্তন করেন, বহুবিবাহ প্রথা বিলুপ্ত করেন এবং পিতার সম্পত্তির সমান ভাগ হবে- এমন নীতি প্রচলন করেন। ১৯৩৫ সালে তার পার্লামেন্টে মোট ১৮টি আসনে নারী সাংসদ নিযুক্ত হয়, যেখানে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের দিকে তাকিয়ে দেখা যায় যে সে দেশগুলোতে নারীদের ভোটাধিকারই চালু হয়নি।
পশ্চিমা ব্যবস্থা অনুযায়ী কামাল পাশা ধর্মনিরপেক্ষতা চালু করেন এবং শরিয়া আইনকে নিষিদ্ধ করে দেন। দেশ চালাতে হলে সেখানে ধর্মের মিশেলটা থাকলে ভালো হবেনা- সেটি বুঝতে পেরেই তিনি বেশ কিছু কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সহশিক্ষা কার্যক্রম, শিক্ষাগ্রহণে সহজ সুবিধা, প্রাপ্তবয়স্কদের শিক্ষাসুবিধা ইত্যাদি নানা চমৎকার কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করেন তিনি। সংস্কৃতিরও বেশ ভালো সমঝদার ছিলেন তিনি। অটোমান সাম্রাজ্যে তুরস্কে যা যা করা নিষেধ ছিল, শিল্পচর্চায় সেদিকেই ব্রতী হলেন তিনি। দেশে ছোটবড় অনেক শিল্পকারখানা স্থাপন করে অর্থনীতির চাকাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াতে তার অবদান অনেক। ব্যাংকিং খাত ও জায়গা জমির আইনেও বেশ কিছু রদবদল করে তিনি এনেছেন অভূতপূর্ব পরিবর্তন।
সবশেষে একটি কথা। একনায়কতন্ত্র হলেই যে কাউকে রক্তপিপাসু কিংবা ক্ষমতালোভী হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই; বরং ক্ষমতার মসনদে আরোহণ করেও ভাবা যায় প্রজাদের সম্পর্কে, করা যায় দেশের জন্য চমৎকার কিছু ভালো ভালো কাজ।