তেলাপোকা রহস্য
তেলাপোকার মতো টিকে থাকার মাঝে কোনো সার্থকতা নেই- এই কথাটির সাথে অনেকেই হয়ত একমত হবেন। সত্যিই তো! বাঁচলে বাঁচার মতোই বাঁচা উচিত। সামান্য একটা পোকার মতো জীবনধারণ করায় তো কোনো সার্থকতা নেই, নেই কোনো গৌরব। তবে একটু বিজ্ঞানের দিকে আসুন তো। কখনও ভেবে দেখেছেন, মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে এই সামান্য পোকাটির টিকে থাকার রহস্যটি আসলে কোথায়? বৃহদাকার ডাইনোসর, অতিকায় সব প্রাণী কালের বিবর্তনে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে কিন্তু তেলাপোকা আজও কিন্তু সগৌরবে বিচরণ করছে এই পৃথিবীতে। রহস্যটি কোথায়?
বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণার মাধ্যমে এটিই খোঁজ করবার চেষ্টা করেছেন। তেলাপোকা টিকে থাকবার মূল রহস্য বোধহয় এতদিন পর উদঘাটন করেই ফেললেন তারা। পেরিপ্লানেটা আমেরিকানা বা তেলাপোকার জিন কোডিং-এর নানা বিষয় অবাক করেছে তাদের। কোনো কিছুর স্বাদ নেবার ক্ষমতা, গন্ধ নেবার ক্ষমতা কিংবা অন্যান্য পোকাদের সাথে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার তারতম্য নিয়েও গবেষণা করেছেন বিজ্ঞানীরা। গত ২০ মার্চ “নেচার কমিউনিকেশনস” নামক জার্নালে গবেষণাত্তোর ফলাফলটি প্রকাশ করেছেন তারা।
নর্থ ক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভার্সিটির কীটপতঙ্গ বিষয়ক গবেষক (এনটোমোলজিস্ট) কোবি শ্যাল তার দেয়া বক্তব্যে বলেন,
“তাদের জীবনধারণ পদ্ধতি সম্পর্কে জানতে পারলে আপনি সবকিছুই বুঝতে পারবেন। অবাক হবার মতো কিছু পাবেন না।” আমেরিকান তেলাপোকা এবং জার্মান তেলাপোকা (বৈজ্ঞানিক নাম- ব্ল্যাটেলা জারমানিকা), এই দু’ধরনের তেলাপোকা নিয়ে গবেষণা করবার পর তারা বলেছেন যে সর্বভূক এই কীট অন্যতম জঘন্য পরিবেশে থেকেও খাবার খেয়ে নিজেদের উদরপূর্তি করতে পারে এবং বেশ স্বাচ্ছ্যন্দে বেঁচে থাকতে পারে। পেরিপ্লানেটা আমেরিকানা, অর্থাৎ আমেরিকান যে তেলাপোকাকে আমরা সাধারণত চিনি, সেটির আগমন ঘটে ১৫০০ সালের দিকে, আফ্রিকা থেকে। মূলত আমাদের বাসস্থানেই এরা নিজেদের ঘর তৈরি করে এবং বসবাস করা শুরু করে। বাড়ির নিচের অন্ধকারময় কুঠুরি কিংবা বেজমেন্ট হয় এদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। তাও যদি তারা না পায়, তাহলেও চিন্তা নেই। নর্দমায় কিংবা সুয়ারেজ লাইনে বেশ দিব্যি আরাম করে কাটিয়ে দিতে পারে জীবনের বহু বছর।
বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে দেখেছেন যে তেলাপোকার জিনোম কোড পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ জিনোম কোড। প্রথম স্থানটি দখল করে নিয়েছে লোকাস্ট (বৈজ্ঞানিক নাম- লোকাস্টা মাইগ্রাটোরিয়া)। সাধারণ তেলাপোকার চাইতে অন্তত ৬০ শতাংশ বেশি আকারে বড় এদের জিনোম কোড। স্বাদ এবং গন্ধ নেবার ক্ষেত্রে এদের জিন অন্যান্য কীট পতঙ্গের চাইতে অনেক অনেক বেশি।আমেরিকান তেলাপোকার টেস্ট রিসেপ্টর বাড বা সংবেদী অঞ্চলের বাড ৫২২টি এবং জার্মান তেলাপোকার টেস্ট রিসেপ্টর ৫৪৫টি।
শ্যাল আরো বলেন, “বিষাক্ত খাবার এড়িয়ে যাবার জন্য তেলাপোকার নাক এবং ঘ্রাণশক্তি খুবই তীব্র হতে হবে এবং ঘটেও ঠিক তাই।” বর্তমান পৃথিবীর দূষিত আলো বায়ু হাওয়া থেকে মুক্ত থাকবার জন্য খুব সতর্কভাবে চলাফেরা করতে হয় তেলাপোকার। তারা যে সকল স্থানে অবস্থান করে বা আবাস তৈরি করে, সাধারণত সেখান থেকেই খাদ্য প্রস্তুত করে।
জার্মান ও আমেরিকান তেলাপোকার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, পৃথিবীতে মানুষ আসবার আগেই প্রকৃতি তাদের এমনভাবে তৈরি করেছে যেন সকল ধরনের বিষাক্ত খাবার খেয়েও তাদের মেটাবলিজম খুবই জোড়ালো ও শক্তিশালী হয়। এমনকি কালের পরিক্রমায় এসে দেখা যাচ্ছে যে প্রতিকূল আবহাওয়ায় থেকেও তাদের টিকে থাকবার ক্ষমতা অতুলনীয়। শ্যালের মতে তেলাপোকা সাধারণত দুই থেকে তিন ইঞ্চি অবধি লম্বা হতে পারে এবং এ দৈর্ঘ্যে যাবার জন্য যতবার ইচ্ছা খোলস পরিবর্তন করতে পারে। তবে একটি কথা ঠিক। আর তা হচ্ছে, তেলাপোকাদের জীবনব্যবস্থা যদি ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তাহলে অনেক নতুন নতুন তথ্য উঠে আসবে। এমনকি মানুষ কিভাবে এমন একটি দীর্ঘ জীবন লাভ করতে পারে, সেটিও আলোচনা করা যেতে পারে এই সংসর্গে। এছাড়াও এক ধরনের তেলাপোকা আছে (বৈজ্ঞানিক নাম- ব্লাটেলা আসাহিনাই), যেগুলো মানুষের আশেপাশে খুব একটা চলাচল করতে পছন্দ করে না, বরং কিছুটা এড়িয়েই চলে।
তবে শেষে একটি কথা বলেছেন তিনি। বর্তমান পৃথিবীতে মোট ৫,০০০ প্রজাতির তেলাপোকা রয়েছে। এদের মাঝে মাত্র দুটির সম্পর্কে জানা গিয়েছে। আরো বহু পথ পাড়ি দেয়া বাকি!
(সূত্রঃ লাইভ সাইন্স)