ডকুমেন্টারি বা কাঠখোট্টা সত্যের প্রতি আমাদের এক ধরনের বিতৃষ্ণা কাজ করে। সারাদিন যে হতাশা, দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাই, দিনশেষে আবারও সেই অনাচার, অত্যাচারগুলো চোখের সামনে দেখতে কারই বা ভাল্লাগবে? কাজেই সেসব সিরিয়াস বিষয় ভুলে আমরা মজে যাই সস্তা, চটকদার বিনোদনে। সে হিসেবে ২০১২ সালে কার্বি ডিক নির্মিত ‘দ্য ইনভিজিবল ওয়ার’ ডকুমেন্টারিটিও আমরা অনেকেই দেখিনি, সেটাই স্বাভাবিক। আমাদের এই গা সয়ে যাওয়া মনভাবের কারণে প্রতিদিন কত যে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা চোখে এড়িয়ে যাচ্ছে, আমরা যে কত কিছু ভুলতে বসেছি। সে যাকগে, এবার মূল প্রসঙ্গে আসা যাক।
২০১০ সালে আমেরিকান সেনাবাহিনীতে প্রায় ১ লক্ষ ৮ হাজার ১২১ জন সৈন্য যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। তাদের মধ্যে প্রায় ৬৮,৩৭৯ জনকে স্বাস্থ্য সেবা দিতে বাধ্য হয় সরকার। কিন্তু সে বিষয়ে মিডিয়া তোলপাড় শুরু করার আগেই পুরো ঘটনাটিকে ধামাচাপা দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। সে বছরই আবার ৩,১৯৮ জন সৈন্যের উপর নতুন করে নিপীড়নের অভিযোগ ওঠে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রকৃত সংখ্যাটি প্রায় ১৯ হাজার! আরও বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এ বিষয়ে মামলা হয়েছে মাত্র ২৪৪টি! ইরাকে যুদ্ধ করা সাবেক মার্কিন মেরিন কর্মকর্তা জেসিকা (ছদ্মনাম) বলেন, ‘আমার ওপর চালানো যৌন নিপীড়নের ঘটনার অভিযোগ করায় তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। সামরিক বাহিনীর সদস্যরাই এ ধরনের ঘটনার বিচারক ও সাক্ষী। তাদের নিজস্ব আইন আছে। বাহিনীর সুনাম রক্ষার্থে তারা প্রয়োজনে যৌন নির্যাতনের অভিযোগকারীর মুখ বন্ধ করে দেয়।’
এমন একটি গুরুতর বিষয় নিয়ে কথা হবে না, তা মেনেও নেয়া যায় না। কাজেই কার্বি স্বপ্রণোদিত হয়ে উদ্যোগ নেন বিষয়টিকে সবার সামনে তুলে ধরার। যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নেন তিনি। সবার কাছ থেকে মোটামুটি একই গল্প উঠে আসে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি যে কেবল আমাদের দেশেই আটকে নেই, তারই একটি জলজ্যান্ত প্রমাণ আমেরিকার এই অদৃশ্য যুদ্ধ। কেউ এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই বরং তার উপর অত্যাচারের পরিমাণ বেড়ে যেত। সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সৈনিকদের ইচ্ছামতো ধর্ষণ করবে, তাতে আবার বিচার হবে কীসের? কাজেই মুখ বন্ধ করে শারীরিক, মানসিক ও যৌন নিপীড়নের শিকার সৈন্যরা দিন গনে কবে শেষ হবে এই অত্যাচার?
কার্বি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন উকিল, আইনজীবী, সাংবাদিক, মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, সেনা কর্মকর্তা সহ বিচারকদের অনেকের। এখানে বেশ কিছু ফুটেজও সংযুক্ত করা হয়েছে যাতে নিপীড়নের পরে সৈন্যদের মানসিক অবস্থা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। ধর্ষণের শিকার কোস্ট গার্ড সৈন্য কোরি সিওকা কিছু ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিলেন কর্তৃপক্ষের কাছে, তার এই সাক্ষাৎকারটি বিশেষভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। কিন্তু তার আইনজীবী যখন আদালতে দাঁড়িয়ে কোরির হয়ে বিচার চাইলেন, তখন মিলিটারিতে কোনো যৌন নিপীড়নের ঘটনাই ঘটেনি বলে গোটা ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দেন বিচারক! সত্যিই সেলুকাস এই বিচারব্যবস্থা। নিজেকে নির্দোষ দাবি করা এক কর্মকর্তা গোমেজের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে অভিযোগ উঠেছে। তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির বিভিন্ন অভিযোগের ইতিহাস সত্ত্বেও তাকে একের পর এক সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
আমেরিকার প্রায় সহস্রাধিক নার্সিং হোমে অসুস্থ ও মৃত্যুপথযাত্রী ও প্রতিবন্ধী বয়স্ক নারীরা সেবাসহকারীদের হাতে প্রতিনিয়ত ধর্ষিত হচ্ছেন। সম্প্রতি সিএনএনের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এমন করুণ কাহিনী ওঠে এসেছে। এসব নারীদের অনেকেই কথা বলতে পারে না। তারা তাদের শয্যা ত্যাগ ও প্রাকৃতিক কাজকর্মের জন্য ব্যক্তি ও হুইলচেয়ারের উপর নির্ভরশীল। বিভিন্ন কারণেই তাদের স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। আরোগ্য লাভের জন্য তারা নার্সিং হোমে আসেন। কিন্তু এর পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্রের নাসিং হোমগুলোতে তারা যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। এর আগেও ১৯৯১ সালে নেভিতে, ১৯৯৬ সালে সেনাবাহিনীতে এমন যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটে। কিন্তু সেনাবাহিনীতে তা এমনভাবে সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে যে এ কথা নিয়ে প্রতিবাদ করারও কিছু নেই যেন। ২০০৩ সালের বিমান বাহিনীতে যে স্ক্যান্ডাল ছড়িয়ে পড়ে তাতে আইনজীবীরাও ভাবতে বাধ্য হয় এই সংস্কৃতিতে কবে পরিবর্তন আসবে?