কথায় বলে ক্রিকেট হচ্ছে রাজাদের খেলা। অনেকদিক বিবেচনা করলে কিন্তু ঠিক তাই দাঁড়ায়। এই যেমন ধরুন নানা ধরনের সরঞ্জাম, মাঠের প্রস্তুতি, ব্যাট বলের খরচ ইত্যাদি বিবেচনা করলে কিন্তু বেশ কিছু গাঁটের পয়সা খরচ করতে হয়। তবে আজ আপনাদের শোনাবো এমন এক রাজার কথা, যিনি ক্রিকেট খেলাকে সত্যিই রাজকীয় উচ্চতায় নিয়ে যেতে পেরেছেন। আর হ্যা, সত্যই তিনি একজন ‘রাজা’ ছিলেন।
তার জন্ম ১৮৭২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর, তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের কাঠিয়াওয়ার এলাকার সাদোদার গ্রামে। ডাকনাম রঞ্জি, স্মিথ। ভারতে যে রঞ্জি ট্রফি খেলা হয়ে থাকে, তা এই রাজার নামের নামকরণ করা হয়েছে। একইসাথে তিনি ছিলেন নওয়ানগরের শাসক। পুরো নামটা বেশ বড়- নওয়ানগরের বিভাজী এইচ.এইচ. জাম সাহিব শ্রী শ্রী রঞ্জিতসিংজী।
ভারতীয় উপমহাদেশ, এমনকি তৎকালীন সময়ে গোটা পৃথিবীতে তার মতো ক্রিকেটার খুব কমই ছিল। সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার আখ্যায় আখ্যায়িত করতে কেউ কুণ্ঠাবোধ করেন না রণজিত-এর প্রতি। নেভিল কারদাস তাকে ‘দ্য মিডসামার’স নাইটস ড্রিম অব ক্রিকেট’ উপমা প্রদান করেন। ইংল্যান্ড দলের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলা, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করা, কাউন্টি ক্রিকেটে সাসেক্সের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করা- সবই করেছেন মহারাজা। তিনি মূলত ডানহাতি ব্যাটসম্যান, তবে ডানহাতে স্লো বোলিঙয়েও পারদর্শী ছিলেন। ১৯০৭ সালে তিনি নওয়ানগরের মহারাজা জাম সাহিব উপাধি লাভ করেন।
খুব ছোট বয়সেই ক্রিকেটের প্রতি তার আগ্রহ জন্মায়। ১৮৮৩ সালে বিদ্যালয় দলে ক্রিকেটে সূচনা ঘটে এবং ১৮৮৪ সালে একই দলের অধিনায়ক হিসেবে মনোনীত হন। পরবর্তীতে ইংল্যান্ডে গমন করেন। ১৮৮৮ সালে সারে ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে অংশ নেন। চার্লস টার্নারের মতো বুকে কাঁপন ধরানো বোলারের বিরুদ্ধে তিনি অগণিত দর্শকের সামনে দৃষ্টিনন্দন সেঞ্চুরি করেন। তার নিজস্ব বয়ান অনুসারে জানা যায়, পরবর্তী দশ বছরের মাঝে এরচাইতে ভালো ইনিংস তিনি আর খেলেননি।
সমগ্র জীবনে তিনি মোট ১৫টি টেস্টে অংশ নিয়েছিলেন। সবগুলোই ছিল অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে। গড় রান ৪৪.৯৬ এবং মোট রান করেন ৯৮৯।
অনেকেই একটি বিষয়ে একমত। সুনীল গাভাস্কার, শচীন তেন্ডুলকার, কপিল দেব কিংবা সৌরভ গাঙ্গুলির মতো নামজাদা খেলোয়ারেরা ভারতীয় ক্রিকেটকে করেছেন সমৃদ্ধ। তবে সূচনাটা হয়েছিল মহারাজা রণজিৎ সিংজীর হাত ধরেই, ভারতের সর্বপ্রথম টেস্ট ক্রিকেট খেলোয়াড়।
তবে স্কুলজীবনে কিন্তু রণজিতের ক্রিকেটীয় কৌশল এতো নিপুণ ছিল না। বলা যায়, তার কৌশল ঠিক তৎকালীন ব্রিটিশ ক্রিকেটের মতো এতো রপ্ত করা ছিল না। এজন্য তিনি টেনিসের প্রতি মনোযোগী হয়েছিলেন। তবে এর পেছনে মজার একটি গল্প আছে। রণজিৎ ‘ব্লু’ পদকটি জিততে চেয়েছিলেন। ব্রিটিশ শাসনামলে এই পদকটির জন্য নির্বাচন করা হতো কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাথলেটদের যারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে ছিলেন সেরা। রণজিৎ এই পদকটি জেতার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন। প্রথমদিকে তিনি চেয়েছিলেন টেনিসে মনোনিবেশ করতে। যেহেতু পদকটি শুধুমাত্র অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজে প্রদান করা হতো, তাই তিনি এই দুই প্রতিষ্ঠানের যে কোনো একটিতে যোগদান করতে ব্রতী হন। নিশ্চয়ই মনে প্রশ্ন জাগছে রণজিৎ পদকটি পেয়েছিলেন কি না?
হ্যা, পেয়েছিলেন। ১৮৯৩ সালে তিনি ব্লু পদক জয় করেন।
রণজিৎ খেলতে গিয়ে দেখলেন ফ্রন্ট ফুটে খেলোয়াড়েরা খেলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করত বেশি কিন্তু শর্ট পিচে এই খেলাটা মাঝে মাঝে বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াত। এই সমস্যা দূর করবার জন্য রণজিৎ ও তার গুরু ড্যানিয়েল হেওয়ার্ড একটি বুদ্ধি বের করেন। ক্রিজে দাঁড়িয়ে রণজিৎ দুই পা সমানভাবে রেখে স্থির হয়ে দাঁড়ালেন। হেওয়ার্ড তার শিষ্যের পা জোড়া দিলেন বেঁধে, যাতে সেগুলো নড়ানো না যায়। রণজিতের পেছনের পায়ের ওপর ভরসা করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। কিছুসময় পর দেখা গেল রণজিৎ দুই পায়ের সাহায্যেই বেশ স্বাচ্ছ্যন্দে খেলতে পারছেন। পরবর্তীতে এই শটের নাম দেয়া হয়- লেগ গ্ল্যান্স।
১৮৯১-৯২ সালে প্র্যাকটিস নেটে সবার দৃষ্টি কাড়লেও তৎকালীন কেমব্রিজ দলের কাপ্তান (পরবর্তীতে ইংল্যান্ড দলেরও) স্ট্যানলি জ্যাকসন কেবলমাত্র ভারতীয় হবার কারণে রণজিৎকে দলে সুযোগ দেন নি। তবে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয় নি তাকে। দলের এক খেলোয়াড়ের ইনজুরিতে পড়ে যাবার কারণে ভাগ্যদেবী সদয় হন। রণজিৎও সুযোগ পেয়ে হাতছাড়া করেন না। মাঠেই নিজের জাত চিনিয়ে আসেন। গড় ৪৪ রানে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় সেরা ব্যাটসম্যান, সেরা ছিলেন স্বয়ং কাপ্তান স্ট্যানলি। শুধুমাত্র ব্যাটসম্যান হিসেবেই নয়, রণজিৎ সুপরিচিত ছিলেন একজন বোলার এবং ফিল্ডার হিসেবেও। ডানহাতি স্লোয়ার বল ছুঁড়তে জুড়ি ছিল না তার। গোটা খেলোয়ারি জীবনে ২৩৩টি ক্যাচ ধরেছিলেন তিনি।
১৯০২ সালের ২৪ জুলাই অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধেই জীবনের শেষ টেস্টটি খেলেন তিনি।
১৯৩৩ সালের ২ এপ্রিল ৬০ বছর বয়সে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের জামনগর প্রাসাদে দেহত্যাগ করেন ক্রিকেটের এই মহারাজা। ভারতের ক্রিকেট মহারাজা রণজিৎ সিংজীর কাছে কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ থাকবে চিরকাল।