গোয়ালিয়রে সেদিন ছিল ইতিহাসের ২৯৬২ তম ওয়ানডে ম্যাচ। এর আগের ২৯৬১ টি ওয়ানডে ম্যাচ যা দেখেনি, গোয়ালিয়রের দর্শকেরা সেদিন তারই সাক্ষী হয়েছিলেন, সচক্ষে দেখেছিলেন ইতিহাস নির্মিত হতে। প্রথমবারের মত সাদা বলের ক্রিকেটে দ্বিশতক হয়েছিল আজকের দিনেই! ইতিহাস নির্মাতার নাম নিশ্চয়ই নতুন করে বলার কিছু নেই। আধুনিক ক্রিকেটের ব্যাটিংয়ের প্রায় সব রেকর্ডই যার অধীনে, সেই শচীন টেন্ডুলকার যে এই রেকর্ডেরও মালিক হবেন, এতে আর আশ্চর্যের কি!
ইতিহাস যে সেদিন নির্মিত হয়েই যাচ্ছে, ৪৫ তম ওভার শেষেই তার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। ইনিংসের তখনো বাকি আরও ৫ ওভার, ২০০ পূর্ণ করতে শচীনের দরকার মাত্র ৯ রান। কাঙ্ক্ষিত সেই ৯ রান তিনি পেলেন বটে, তবে সেটা একেবারে ইনিংসের শেষ ওভারে! মহেন্দ্র সিং ধোনির তাণ্ডবে ইনিংসের শেষ ৩০ বলের মধ্যে মাত্র ৯ টিতে স্ট্রাইকে আসতে পেরেছিলেন শচীন!
শচীনের আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের সামনে সেদিন কতটা অসহায় পড়েছিলেন সাউথ আফ্রিকান বোলারের, তা তাদের হিটম্যাপ দেখলেই বোঝা যায়। শর্ট বল থেকে শুরু করে হাঁটু উচ্চতার ফুলটস, আক্রমণে দিশেহারা সেদিন নিজেদের লাইন লেন্থই গুলিয়ে ফেলেছিলেন স্টেইন-পারনেল-ক্যালিসরা। ফুলটস হোক কিংবা হাফভলি, কোনটিকেই বাউন্ডারিছাড়া করতে ভুল করেননি ‘মাস্টার ব্লাস্টার’।
কোন বোলারই সেদিন রক্ষা পাননি টেন্ডুলকারের তাণ্ডব থেকে। ১৪৭ বলে অপরাজিত ২০০ রানের ইনিংটি খেলার পথে মোট ২৫ টি চার মেরেছিলেন শচীন, রোহিত শর্মা ভেঙ্গে দেয়ার আগে যেটি ছিল ওয়ানডেতে এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি চারের রেকর্ড। এই ২৫ চারের মধ্যে সাতটি করে মেরেছিলেন আফ্রিকার দুই মূল বোলার স্টেইন ও পারনেলকে, ভ্যান ডার মারউইকে মেরেছিলেন ৫ টি।
কোন বোলারের বিপক্ষে কত রান করেছিলেন-
বোলার | রান | বল | স্ট্রাইক রেট |
চার্ল ল্যাঙ্গেভেল্ট | ৩০ | ২৮ | ১০৭.১৪ |
জেপি ডুমিনি | ২০ | ১৭ | ১১৭.৬৪ |
ডেল স্টেইন | ৩৭ | ৩১ | ১১৯.৩৫ |
রোলফ ভ্যান ডার মারউই | ৪৩ | ৩২ | ১৩৪.৩৭ |
জ্যাক ক্যালিস | ২৪ | ১৫ | ১৬০.০০ |
ওয়েইন পারনেল | ৪৬ | ২৪ | ১৯১.৬৭ |
একটি পারফেক্ট ওয়ানডে ইনিংস বলতে যা বোঝায়, টেন্ডুলকার সেদিন সেটিই খেলেছিলেন। ইনিংসের শুরু থেকেই রানের চাকা সচল রেখেছিলেন, একটানা চারটির বেশি ডট বল দেননি পুরো ইনিংস জুড়ে! সেটিও একদম ইনিংসের শুরুর ওভারে। ডট বল পুষিয়ে দিতে সময় নেননি একদমই, টানা দুই চারে রানের খাতা খোলার পর প্রথম ২৫ বল থেকে তুলেছিলেন ৩৩ রান। ইনিংসের মাঝপথে কিছুটা শ্লথ হয়ে গেছিলেন, ৫১ থেকে ১০০ এই ৫০ বলে তুলেছিলেন ৫০ রান। আসল ঝড়টা তুলেছিলেন ইনিংসের শেষভাগে, শেষ ৪৭ বলে তাঁর ব্যাট থেকে এসেছে ৮৩ রান।
শচীনের মোট রানের ৫৯% রান এসেছিল বাউন্ডারি থেকে (২৫ চার, ৩ ছয়)। তাই বলে সিঙ্গেল ডাবল নেয়ার কথাও ভুলে যাননি একদমই। পুরো ইনিংসে সিঙ্গেল নিয়েছেন ৫৬ টি, ডাবল ১৩ টি। ১৪৭ বল মোকাবেলা করে মাত্র ৫০ টি বলেই কোন রান বের করতে পারেননি তিনি।
১৩৬.০৫ স্ট্রাইক রেট নিয়ে ইনিংস শেষ করেছিলেন সেদিন তিনি, তাঁর ৪৯ টি ওয়ানডে সেঞ্চুরির মধ্যে যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ স্ট্রাইরেট সম্পন্ন ইনিংস। সর্বোচ্চ স্ট্রাইক রেটের ইনিংসটি খেলেছিলেন ১৯৯৯ বিশ্বকাপে কেনিয়ার বিপক্ষে, বাবার মৃত্যুর পর খেলতে নেমেই ১৩৮.৬১ স্ট্রাইক রেটে করেছিলেন ১০১ বলে ১৪০ রান।
কিংবদন্তী এই ব্যাটসম্যানের এই ইনিংটি দেখে কীভাবে একটি আদর্শ ওয়ানডে ইনিংস গড়ে তুলতে হয়, তা শিখতে পারেন বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানেরা। বাউন্ডারির পাশাপাশি সিঙ্গেলস-ডাবলস নিয়েও যে রানের চাকা সচল রাখা যায়, তার আদর্শ উদাহরণ যে এই ইনিংসটি!
ক্রিকইনফো অবলম্বনে
মরণ বাঁচন ম্যাচে টসে হেরে ব্যাট করতে নামল ভারত। টেন্ডুলকারের অনুপস্থিতিতে জিম্বাবুয়ের সাথে ফিফটি করেছিলেন সাদাগোপান রমেশ। সৌরভ গাঙ্গুলীও সাউথ আফ্রিকার সাথে প্রথম ম্যাচে ভালো করেছেন। আর তিন নম্বর জায়গাটা বরাদ্দ রাহুল দ্রাবিড়ের জন্য। দলে ফিরে তাই টেন্ডুলকারকে নেমে যেতে হল চার নম্বরে। আর সেখানে ব্যাট করেই তিনি খেললেন তাঁর সুদীর্ঘ ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা ইনিংসটি ।
শচীনের কুসংস্কার সম্পর্কে জানতে চান? তাহলে পড়ুন