ভাষা শহীদদের স্মরণে ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে সরকারী ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। ইমার্জেন্সি সার্ভিস ছাড়া এদিন প্রায় সব অফিসই বন্ধ থাকে, ব্যতিক্রম নয় পত্রিকা অফিসগুলোও। এখন যেমন জনপ্রিয় প্রায় প্রতিটি পত্রিকারই অনলাইন ভার্শন রয়েছে, আজ থেকে ২০ বছর আগে সে সুবিধা ছিল না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তো দূরের কথা, টিভি চ্যানেলই ছিল মোটে একটি, বাংলাদেশ টেলিভিশন। খবরের জন্য তাই পত্রিকাগুলোই ছিল সাধারণ মানুষের একমাত্র ভরসা।
সে কারণেই কিনা, ১৯৯৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা হসপিটালে ঘটে যাওয়া ট্র্যাজেডি সম্পর্কে অবগত ছিলেননা বেশিরভাগ মানুষই। ঢাকা প্রিমিয়ার লীগে খেলা ভারতীয় ক্রিকেটার রমন লাম্বা আগের দিন খেলা চলাকালীন অবস্থায় মাথায় গুরুতর আঘাত পেয়েছিলেন। কিন্তু কেউ কি আর তখন ভাবতে পেরেছিল, মেহরাব হোসেন অপির সেই শটই হয়ে থাকবে লাম্বার প্রাণ-হন্তারক!
২২ ফেব্রুয়ারি পত্রিকার রিপোর্টাররা যথারীতি কাজে ফিরে আসলে দাবানলের মত ছড়িয়ে পরে লাম্বার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার খবর। কিন্তু ততক্ষণে তিনি কোমায় পাঞ্জা লড়ছেন মৃত্যুর সাথে, যন্ত্রের সাহায্য নিয়ে চিকিৎসকেরা চেষ্টা করছেন জীবন প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখার। আয়ারল্যান্ড থেকে ততক্ষণে উড়ে এসেছেন তাঁর স্ত্রী কিম ক্রোথার্স। চিকিৎসকেরা ততক্ষণে বুঝে গেছিলেন, জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন লাম্বা, লাইফ সাপোর্ট খোলার জন্য কেবল স্ত্রীর সম্মতির অপেক্ষা তখন। শেষ পর্যন্ত ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৮ মৃত ঘোষণা করা হল রমন লাম্বাকে, ক্রিকেট সাক্ষী হল করুণতম এক দুর্ঘটনার। ফিলিপ হিউজের ঘটনার আগে যেটি ছিল ক্রিকেট ইতিহাসের করুণতম দুর্ঘটনা।
যেভাবে ঘটনার শুরু
লাম্বার সাবেক সতীর্থ খালেদ মাসুদ পাইলটের চোখে যেন এখনো ভাসে সেদিনের বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের ঘটনা। ঘরোয়া ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় ম্যাচ, আবাহনি-মোহামেডানের ম্যাচ ছিল সেদিন। কয়েক বছর ধরেই আবাহনীতে খেলা লাম্বা তখন ঢাকার ক্রিকেটে পরিচিত মুখ। ওই ম্যাচে কিছু সময়ের জন্য আকরাম খানের অনুপস্থিতিতে আবাহনীর অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করছিলেন পাইলট। বাঁহাতি স্পিনার সাইফুল্লাহ খান জেমের ওভারের মাঝখানেই পাইলট লাম্বাকে ডাকলেন ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে ফিল্ডিং করার জন্য।
মাসুদ তাঁকে হেলমেট পরতেই বলেছিলেন, কিন্তু লাম্বা রাজি হননি। “মাত্র তিন বলের ব্যাপার দেখে সে আর হেলমেট নিতে চায়নি। আমিও আর জোরাজুরি করিনি”- বলছিলেন পাইলট।
পরের বলটাই হল শর্ট বল, ব্যাটসম্যান মেহরাব হোসেন সজোরে পুল করলেন। বল উপরে উঠে যাওয়ার আগে লাগল লাম্বার কপালে, ততক্ষণে বল জমা পরে গেছে কিপার পাইলটের গ্লাভসে। বাকি ফিল্ডাররা যখন পাইলটের দিকে ছুটছেন উল্লাসরত অবস্থায়, লাম্বা ততক্ষণে মাটিতে শুয়ে পড়েছেন। পাইলটের মনে খারাপ আশঙ্কার উদয় হল, উদযাপন করা বাদ দিয়ে তৎক্ষণাৎ ছুটলেন লাম্বার দিকে। কিছুক্ষণ পরে নিজে নিজেই উঠে দাঁড়ালেন লাম্বা, বাকিদের তেমন সাহায্য ছাড়া একা একাই হেঁটে গেলেন ড্রেসিংরুমের দিকে। ম্যাচ জিতে আবাহনীও হাসিমুখে মাঠ ছেড়েছিল শেষ পর্যন্ত।
রমন লাম্বা ‘র অবস্থার অবনতি
আবাহনীর কিছু কর্মকর্তার কাছে লাম্বার অবস্থা ভালো ঠেকছিল না। ড্রেসিংরুমে ফিরেই বমি করতে শুরু করেন তিনি। আবাহনী কর্মকর্তা আহমেদ সাজ্জাদুল আলম বলছিলেন, “ড্রেসিংরুম পর্যন্ত ঠিকভাবেই এসেছিল, কিন্তু যখন আমরা খেয়াল করলাম ও ঠিকভাবে কথা ও বলতে পারছে না, তখন বুঝলাম কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। প্রথমে আমরা তাড়াতাড়ি ওকে ধানমন্ডির ডেলটা হসপিটালে নিয়ে যাই, তারপর পিজি হাসপাতালে।”
তাৎক্ষণিকভাবে ব্রেইন সার্জারি করা হল লাম্বার। তারপরেও অবস্থার ক্রমাবনতি দেখে লাইফ সাপোর্ট দেয়া হল তাঁকে। সাজ্জাদুল আলম এখনো আফসোস করেন, জোর করার পরেও কেন লাম্বা হেলমেটটা পরলেন না, “আমি ড্রেসিংরুমের বারান্দা থেকে খেলা দেখছিলাম। যখন দেখলাম ও শর্ট লেগে দাঁড়াচ্ছে, চিৎকার করে ওকে হেলমেট নিতে বলছিলাম। দেখলাম আম্পায়ার অশোকা ডি সিলভাও ওকে কিছু বলছেন। কিন্তু ও নেয়নি হেলমেট।”
আর যার ব্যাট থেকে যাওয়া বলের আঘাতে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটলো, সেই মেহরাব হোসেন অপির কেমন লেগেছিল? দুই দশক পার হয়ে গেলেও এখনো সেই স্মৃতি মাঝে মাঝে তাড়া করে ফেরে তাঁকে। “প্রথম কয়েক বছর আমার খুব ভয়ানক কেটেছে। রাতে ঘুমাতে পারতাম না। যদিও জানতাম এটা নিছকই দুর্ঘটনা, তাও নিজের মনের মধ্যে এক ধরনের অপরাধবোধ কাজ করত। এখন মোটামুটি ঠিক হয়ে গেছে, কিন্তু তাও লোকে এখনো আমার কাছে ওই দুর্ঘটনার কথা বলে। নতুন কারোর সাথে প্রথমবার পরিচিত হলে শুরুতে দেশের হয়ে প্রথম সেঞ্চুরির কথা বলে, কিন্তু এরপর কোন না কোনভাবে কথা ওই দুর্ঘটনার দিকেই চলে যায়”- জানাচ্ছিলেন মেহরাব।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, ২০ বছর পার হয়ে গেলেও ঢাকার বুকে কোন স্মৃতিচিহ্ন নেই ভারতের হয়ে ৪ টি টেস্ট ও ৩২ টি ওয়ানডে খেলা ও বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে ১২১ ম্যাচে ৩১ সেঞ্চুরি সহ প্রায় ৯ হাজারের কাছাকাছি রান করা রমন লাম্বা ‘র। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে এখন আর ক্রিকেট হয়না, ওখানে তাই কোন স্মৃতিচিহ্ন রাখা হয়নি। কিন্তু লাম্বার ক্লাব আবাহনী তো অন্তত ক্লাব প্রাঙ্গনে লাম্বার স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটা স্মারকস্তম্ভ বানাতেই পারত! দুঃখের বিষয়, লাম্বার ভাগ্যে জোটেনি সামান্য এই মর্যাদাটুকুও।
ক্রিকউইজ অবলম্বনে