প্রযুক্তির প্রতি আসক্ত ?
মাত্র ১৪ বছর বয়সী সাদমান ভিডিও গেমের প্রতি মারাত্মক আসক্ত। তার যখন ৬ বছর বয়স তখন থেকেই সে অনলাইন ভিডিও গেম খেলা শুরু করেছিল। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পর বাকি সময়টা এবং সপ্তাহের শেষে ছুটির দিনগুলোতেও ভিডিও গেম খেলেই সে সময় কাটাতো। প্রথমদিকে এই ঘটনাটিকে অভিভাবকরা একদম গুরুত্ব দিতে চায়নি। ছেলেটি খেলার জন্য তার ঘরের বাইরেই যেত না। এমনকী, খাওয়া-দাওয়া বা পানি খাওয়ার জন্যও তাকে ঘর থেকে বাইরে যেতে দেখা যেত না। সে বাবা-মা বা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে চাইত না। বাবা-মা প্রথমে ভেবেছিল যে, উঠতি বয়সের জন্যই ছেলে এমন ব্যবহার করছে। কিন্তু সমস্যা তখনই গুরুতর হয়ে উঠল যখন স্কুল থেকে জানানো হলো যে, ছেলেটি ক্লাসে ঘুমিয়ে পড়ছে, পড়াশোনায় মন দিতে পারছে না এবং স্কুলের নির্ধারিত কাজগুলোও ঠিকঠাকভাবে করতে পারছে না।
শুধু উঠতি বয়সী ছেলে সাদমানই নয়, এখনকার দিনে কমবয়সী প্রায় সবারই একই অবস্থা। মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, কম্পিউটার আর ইন্টারনেটের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা গোটা প্রজন্মের জন্যই এটা একটা জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। চলুন তবে দেখে আসা যাক প্রযুক্তির প্রতি আসক্ত হলে যে সমস্যা গুলো হতে পারে সেগুলোর আদ্যোপান্ত।
প্রযুক্তিগত আসক্তি থেকে প্রতিকারের উপায়
অন্যান্য নেশা থেকে মানুষকে মুক্ত করার বিষয়টি যেমন মানসিক চিকিৎসার অঙ্গ, ঠিক তেমনই প্রযুক্তির আসক্তি কাটানোর ক্ষেত্রে এই একইরকম চিকিৎসা পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হয়। এই চিকিৎসা প্রণালী মানুষের জীবনধারণ এবং কাজকর্মের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে সাহায্য করে। এর সঙ্গে ইন্টারনেট এবং মোবাইল ফোন ব্যবহারের প্রতি কোনও ব্যক্তির আকর্ষণ কমাতে এহেন চিকিৎসা কার্যকরী হয়।
প্রযুক্তির প্রতি আসক্তির চিকিৎসা তিনটি ধাপে করা হয়ে থাকে
প্রথমে, একজন ব্যক্তি কাউন্সেলর বা সাইকোলজিস্টের সাহায্য নেন। একজন বিশেষজ্ঞ রোগির দায়িত্ব নেওয়ার পর তার সমস্যাগুলি বোঝার চেষ্টা করেন। তাঁর মনে কতগুলো প্রশ্ন জাগে–
- একজন ব্যক্তি প্রযুক্তির উপর কতখানি নির্ভরশীল?
- প্রযুক্তির ব্যবহারের সঙ্গে কোন কোন পরিস্থিতি যুক্ত?
- কী ধরনের মানসিক অবস্থার জন্য একজন ব্যক্তি প্রযুক্তির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে?
- পরিবারগত কারণে কি একজন মানুষের আচরণের পরিবর্তন ঘটছে?
এইভাবে ডাক্তার মানুষের প্রযুক্তি ব্যবহারের চরিত্র বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেন। এটি সম্ভব হয় সাইকো-এডুকেশনের দ্বারা। এই পদ্ধতির মাধ্যমে প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার একজন ব্যক্তি এবং তার পরিবারের জন্য কতটা ক্ষতিকারক, ব্যক্তির আচরণগত সমস্যা বা এর ফলে সৃষ্ট অন্যান্য সমস্যাগুলিকে চিহ্নিত করার প্রচেষ্টা চালানো হয়। এই চিকিৎসার সাহায্যে সমস্যায় আক্রান্ত একজন মানুষ এবং তার পরিচর্যাকারীর সংকটগুলিকে দূর করার সঙ্গে আনুষঙ্গিক আরও অসুবিধা যেমন, ওজন কমে যাওয়া, ঘুম এবং খিদে নষ্ট হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যাগুলি সমাধানের চেষ্টা করা হয়।
চিকিৎসা চলাকালীন অসুস্থ ব্যক্তি বা তার পরিচর্যাকারীর প্রযুক্তিগত আসক্তির বিষয়টিকে ভালো করে জানা উচিত এবং কীভাবে এই সমস্যার সমাধান করা হচ্ছে, তা বোঝা একান্ত জরুরি।
সাইকো-এডুকেশন পদ্ধতির অন্যতম গুরুত্ব হল প্রযুক্তি ব্যবহারকারীর সমস্যা সমাধানের জন্য তাকে উৎসাহ বা প্রেরণা দেওয়া। কোনও মানুষকে যদি প্রযুক্তির ব্যবহার কমাতে উৎসাহ জোগানো হয়, তাহলে ওই বিষয়ের প্রতি তার নেশা ধীরে ধীরে কমতে থাকবে। অন্যান্য নেশার মতোই এই নেশা ছাড়ানোর ক্ষেত্রেও মানুষকে যদি জোরজবস্তি করে তাড়াতাড়ি সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করা হয়, তাহলে তা লাভের থেকে ক্ষতিই বেশি করবে। কারও কারও ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে, তার অস্বস্তি বা বিরক্তি আরও বেড়ে যায়। তাই মানুষের সঙ্গে কথাবার্তা বলে এমন একটি অলিখিত চুক্তি করতে হয়, যাতে প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় সে ইন্টারনেট, কম্পিউটার বা মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারে। এই ধরনের ব্যবস্থা খুব কম সময়ের জন্য নেওয়া উচিত এবং এর ফলাফল ভালোভাবে লক্ষ্য করা জরুরি। আর যার জন্য এই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, তাতে তার মতামত থাকাটা অবশ্যই প্রয়োজন।
সমস্যাটির অস্তিত্বকে স্বীকার করা জরুরি
মানুষ যে প্রযুক্তির দ্বারা আসক্ত হতে পারে, কেউ কেউ সে বিষয়টি অনেকসময় মানতেই চায় না। তারা ভাবতেই পারে না যে প্রযুক্তির ব্যবহার তাদের বিপদ ডেকে আনছে। তাই মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সেই সব মানুষকে জোর করে তাদের জেদ থেকে না সরিয়ে, কীভাবে তাদের ক্ষতি থেকে বাঁচানো যায় বা তাদের এই অস্বাস্থ্যকর অভ্যাসের বদল ঘটানো যায়, সেদিকে মন দেন। কিছু ক্ষেত্রে মানুষকে প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য নানা সুযোগ করে দেওয়া হয়। তবে এই ব্যবস্থা তখনই কার্যকরী হয়, যখন মানুষের মধ্যে প্রযুক্তি ব্যবহারের ঝোঁক কম করার জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়। একজন মানুষের মধ্যে প্রযুক্তির প্রতি আসক্তি তখনই কমবে, যখন সে বুঝতে পারবে যে তার প্রযুক্তির ব্যবহার স্বাস্থ্যকর বা যথাযথ হচ্ছে না এবং এই কারণে তাকে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
অন্যান্য কাজকর্মের দিকে মনোযোগ বাড়ানো প্রয়োজন
একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের উচিত সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে একটি নতুন জীবনযাপন পদ্ধতি অনুসরণের দিকে নিয়ে যাওয়া। যেখানে নিজের প্রতি যত্নশীলতা, নিজেকে সঠিক পথে চালিত করা, এমনকী ঘরের বাইরে বেরিয়ে নানা কাজ করা, লেখাপড়ায় মন দেওয়া এবং সমাজে মেলামেশা করার সুযোগ থাকে। আসলে প্রযুক্তির আসক্তির ফলে মানুষ যে যে সমস্যার সম্মুখীন হয়, তার মধ্যে ঘুম কমে যাওয়া, সমাজে মেলামেশা করতে অনীহা এবং নিজের যত্ন না নেওয়ার ফলে দুর্বল স্বাস্থ্য, পুষ্টির অভাব প্রভৃতি লক্ষ্য করা যায়।
অধিকাংশ বাবা-মা, যারা বুঝতে পারে যে তাদের ছেলে-মেয়েরা প্রযুক্তির নেশায় বুঁদ হয়ে রয়েছে, তারা স্বভাবতই খুব আতঙ্কিত এবং দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এক্ষেত্রে একজন কাউন্সেলর অভিভাবকদের পাশে দাঁড়িয়ে, তাদের সাহায্য করে প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে সাহায্য করেন।