হুমায়ূন ফরীদি
প্রয়াত নাট্যব্যক্তিত্ব আতিকুল হক চৌধুরী তাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন, “ হুমায়ূন ফরীদি ‘র মত শিল্পী যেকোনো দেশে জন্মাতে যুগ যুগ সময় লাগে, শতাধিক বছরও লাগে”। রামেন্দু মজুমদার বলেছিলেন, “ হুমায়ূন ফরীদি যখন প্রথম মঞ্চনাটকে অভিনয় শুরু করল, তখনই আমি সবাইকে বলেছিলাম এই ছেলে মঞ্চ কাঁপাবে। অবশ্য ফরীদি মঞ্চের চেয়েও তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল চলচ্চিত্রে। তাঁর রসবোধ ছিল প্রখর। কোন একটা সিরিয়াস মুহূর্তকে প্রাণচাঞ্চল্যে ভরিয়ে দিতে তাঁর তুলনা ছিল না ”।
বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এখনো পর্যন্ত যতগুলো বড় নাম এসেছে, হুমায়ূন ফরীদি থাকবেন একদম সামনের সারিতেই। শক্তিমান এই অভিনেতা বাংলা চলচ্চিত্রে যতটা অবদান রাখতে পেরেছেন, ততটা আর খুব কম অভিনেতার পক্ষেই সম্ভব হয়েছে। আজ থেকে ঠিক ৬ বছর আগে বসন্তের এই প্রথম দিনটিতেই অগণিত ভক্তকুলকে কাঁদিয়ে মাত্র ৬০ বছর বয়সে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে ইহলোকে পাড়ি জমিয়েছিলেন হুমায়ূন ফরীদি । আজ তাঁকেই শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে প্রিয়লেখা।
হুমায়ুন ফরীদি ‘র জন্ম ১৯৫২ সালের ২৯ মে ঢাকার নারিন্দায়। বাবা এ টি এম নূরুল ইসলাম ও মা বেগম ফরিদা ইসলাম। তিনি নিজ গ্রাম কালীগঞ্জে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। এরপর মাদারীপুর ইউনাইটেড উচ্চবিদ্যালয় হতে ১৯৬৮ সালে এসএসসি এবং চাঁদপুর কলেজ থেকে ১৯৭০ সালে এইচএসসি পাস করেন। হুমায়ুন ফরীদি ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈব রসায়ন বিভাগে অনার্স কোর্সে ভর্তি হন, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে পিতার কর্মস্থল চাঁদপুরে অবস্থান করেন। স্বাধীনতার পর তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে স্নাতক (সম্মান) কোর্সে ভর্তি হন। স্নাতক ফাইনাল পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভ করেন। ১৯৭৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নকালে তিনি ঢাকা থিয়েটারে যোগ দেন এবং নাট্যোৎসবের প্রধান আয়োজক হিসেবে কাজ করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
স্বাধীনতা উত্তরকালে বাঙালির নিজস্ব নাট্য আঙ্গিক গঠনে গ্রাম থিয়েটারের ভূমিকা অসামান্য। এর মূল সঞ্চালক ছিলেন কয়েকজন নাট্য ব্যক্তিত্ব যেমন সেলিম আল দীন, নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, আফজাল হোসেন, গোলাম মোস্তফা, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবর্ণা মোস্তফা এবং হুমায়ুন ফরীদি। ঢাকা থিয়েটারে ‘ভূত’ নাটক নির্দেশনার মাধ্যমে মঞ্চ নাট্যধারায় অভিষেক ঘটে ফরীদির। বাংলাদেশে যখন নাট্য মঞ্চের সংকট তখন তিনি মহিলা সমিতি এবং গাইড হাউজ থেকে মঞ্চনাটকে অভিনয় চালিয়ে যান। বেশ কিছু মঞ্চ নাটকে অভিনয় করে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন তিনি। তাঁর অভিনীত মঞ্চ নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘শকুন্তলা’, ‘কির্তনখোলা,’ ‘কেরামত মঙ্গল,’ ‘মুন্তাসীর ফ্যান্টাসি’ এবং ‘ফণীমনসা’। মঞ্চনাটককে প্রসারিত করার লক্ষ্যে তিনি গড়ে তোলেন নাটক কেন্দ্রিক বিভিন্ন সংগঠন। গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন ও গ্রাম থিয়েটার এর মধ্যে অন্যতম।
টেলিভিশন নাটকে হুমায়ুন ফরীদি ‘র অভিষেক ঘটে ‘নিখোঁজ’ সংবাদ নাটকের মধ্যদিয়ে। এরপর নীল নক্সার সন্ধানে (১৯৮২), দূরবীন দিয়ে দেখুন (১৯৮২), ভাঙ্গনের শব্দ শুনি (১৯৮৩), বকুলপুর কত দূর (১৯৮৫), দু’ভুবনের দুই বাসিন্দা, একটি লাল শাড়ি, মহূয়ার মন (১৯৮৬), সাত আসমানের সিঁড়ি (১৯৮৬), একদিন হঠাৎ (১৯৮৬), চান মিয়ার নেগিটিভ-পজেটিভ (১৯৮৬), ওযাত্রা (১৯৮৭), সংশপ্তক (১৯৮৭-৮৮), পথের সময় (১৯৮৯), দুই ভাই (১৯৯০), শীতের পাখি (১৯৯১), কোথাও কেউ নেই (১৯৯০), সমুদ্রের গাঙচিল (১৯৯৩), তিনি একজন (২০০৫), চন্দ্রগ্রস্ত (২০০৬), কাছের মানুষ (২০০৬), মোহনা (২০০৬), ভবের হাট (২০০৭), শৃংখল (২০১০), প্রিয়জন নিবাস (২০১১), আরমান ভাই দি জেন্টলম্যান (২০১১) ইত্যাদি নাটকে সফলতার সাথে অভিনয় করেন। এর মধ্যে ‘সংশপ্তক’ নাটকের কান কাটা রমজান চরিত্রটি ফরীদিকে বাংলা নাট্যামোদী দর্শকের কাছে ব্যাপক পরিচিতি এনে দেয়। তিনি টেলিভিশন নাট্যাভিনয়ের প্রথাগত ধ্যান ধারণা ভেঙ্গে সৃষ্টি করেন এক নতুন অভিনয় ধারা।
হুমায়ুন ফরীদি কিছু বাংলা চলচ্চিত্রে খলনায়কের অভিনয় করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তিনি একাধারে আর্ট ফিল্ম এবং বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। আর্ট ফিল্মে তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো হুলিয়া, ব্যাচেলর, আহা, মাতৃত্ব, বহুব্রীহী, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র জয়যাত্রা, শ্যামল ছায়া ও একাত্তরের যিশু। মাতৃত্ব চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য তিনি ২০০৪ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর অভিনীত বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রের মধ্যে উল্লেলখযোগ্য হলো দহন, সন্ত্রাস, বিশ্বপ্রেমিক, ত্যাগ, মায়ের মর্যাদা, অধিকার চায়, মায়ের অধিকার, ভন্ড, রিটার্ন টিকেট, প্রাণের চেয়ে প্রিয়, কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি, দূরত্ব, পদ্মানদীর মাঝি ইত্যাদি।
হুমায়ুন ফরীদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে অতিথী শিক্ষক হিসেবে অভিনয় বিষয়ে কিছুদিন পাঠ দান করেন। তিনি বাংলা চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
চলচ্চিত্র শিল্পে তাঁর অসামান্য অবদানের কথা বিবেচনায় নিয়ে তাঁকে এই বছরের মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করে সম্মান জানানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে বিগত কয়েকবছর ধরেই তাঁকে এই পুরষ্কার দেয়ার দাবি উঠেছিল।