অলিম্পিকে অংশগ্রহণকারীরা সাধারণত পেশীবহুল এবং শক্তসমর্থ হয়ে থাকেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খেলবার জন্য বহু বছরের সাধনা ও কসরত করতে হয় এই নিমিত্তে। তবে এ বছরের দুটো অলিম্পিকে এমন দুজন আসছেন, যারা কিছুটা গুটিয়ে থাকবেন। এমনকি শারীরিক কসরত প্রদর্শনের জন্য কোনো ধরনের মেডেলও পাবেন না।
তারা হচ্ছেন ২০১৮ উইন্টার অলিম্পিকের মাসকট সুহোরাং এবং ২০১৮ প্যারালিম্পিকের মাসকট বান্দাবি। সুহোরাং হচ্ছে একটি সাদা বাঘের আদলে গড়া মাসকট এবং বান্দাবি হচ্ছে এশিয়াটিক কালো ভালুকের আদলে গড়া। এবারের আসর যে দেশে হচ্ছে, অর্থাৎ দক্ষিণ কোরিয়ার সংস্কৃতি, কৃষ্টি এবং লোকজ আখ্যান নিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে এই দুই মাসকটকে।
মাসকটদুটো দেখতে কার্টুনের মতো, মোটাসোটা এবং খুবই সুন্দর। তবে তাই বলে একেবারেই হেলায় ফেলে দেয়া যাবে না। কোরিয়ান উপদ্বীপের ইতিহাসে এশিয়াটিক ভালুক এবং সাদা বাঘের ইতিহাস খুবই দীর্ঘ ও গভীর। কোরিয়ান ইতিহাস, সংস্কৃতি, চিত্রকলা ও ভাস্কর্যে অহরহই এই দুটো প্রাণী জড়িয়ে আছে।
কোরিয়ার উৎপত্তি যেভাবে হয়েছে বলে গল্পগাথায় রয়েছে, সেখানে এই দুটো প্রাণীর অস্তিত্ব রয়েছে। “সামগুক ইউসা” কিংবা “মেমোরাবিলিয়া অব দ্য থ্রি কিংডমস” নামক একটি বই, যেখানে ত্রয়োদশ শতাব্দীর কোরিয়ান ইতিহাসের অনেক আলাপন, কিংবদন্তী, লোকজ মিথ ইত্যাদি রয়েছে। গল্পে রয়েছে, ভালুক এবং বাঘ মানুষে রুপান্তরিত হবার আপ্রাণ চেষ্টা করে যায় কিন্তু একটা সময় বাঘ ব্যর্থ হয়। জয়ী ভালুক একজন নারীতে রুপান্তরিত হয় এবং পরবর্তীতে কোরিয়ার প্রতিষ্ঠাতাকে এই নারীই জন্মদান করেন।
সাধারণত যেসব দেশে অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয়, তাদের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে যেসকল মাসকটগুলো ব্যবহার করা হয়ে থাকে, সেগুলো প্রাণীর আদলেই গড়ে তোলা- তবে সবসময় নয়। ১৯৬৮ সালের অলিম্পিকে আনঅফিশিয়ালি যে মাসকটটি ফ্রান্সের প্রতিনিধিত্ব করেছিল, সেটি স্কি এর ওপরে একটি এস(S) আকৃতির দেহ, বাহুবিহীন শরীর ছিল।
২০১২ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে যে দুটো মাসকট ছিল, ওয়েনলক ও ম্যান্ডেভিল, তাদের সুরত ছিল আরো ভয়াবহ। ওয়েনলক ছিল ধাতব গোছের একটি শরীর। এর মাথার ওপরে যে আলোটি জ্বলত, সেটি লন্ডন ক্যাব থেকে ধার নেয়া হয়েছিল। বিশাল, দৈত্যাকার চোখজোড়া ছিল যেন ক্যামেরার লেন্স, যেখানে সবকিছু দৃশ্যায়িত হচ্ছে বলেই রিপোর্ট করে আইওসি।
২০১৬ সালের জুন মাসে একটি অনলাইনভিত্তিক বার্তায় পিয়ংচ্যাং অর্গানাইজিং কমিটি সুহোরাং ও বান্দাবিকে সকলের সামনে পরিচয় করিয়ে দেয়। সফেদ রঙের বাঘটিকে একটি পবিত্র অভিভাবক বলে মনে করা হয়। সুহোরাং এর সুহো (Sooho) কথাটির কোরিয়ান অর্থ হচ্ছে রক্ষাকর্তা বা ত্রানকর্তা।
কোরিয়ার ন্যাশনাল মিউজিয়ামের পরিচালক বায় কি-দং বলেন, ‘কোরিয়াতে বাঘ অন্যতম পরিচিত এবং পূজনীয় প্রাণী। কাব্য, সাহিত্য, কিংবদন্তী অনেক কিছুতে উঠে এসেছে বাঘের কথা।’
আমাদের দেশের যে বাঘ রয়েছে তার বৈজ্ঞানিক নাম Panthera Tigris. সফেদ এই বাঘেরা হচ্ছে এই প্যান্থেরা টাইগ্রিসেরই বংশধর। একটি মাত্র পিগমেন্ট জিনের মাধ্যমে এই বাঘের বংশধর আলাদা করা যায়। ১৯৫৮ সালের পর থেকে এদেরকে বনাঞ্চলে দেখা যায় নি।
দক্ষিণ কোরিয়া একসময় সাইবেরিয়ান বাঘদের আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত ছিল। এই সাইবেরিয়ান বাঘদের আমুর টাইগার হিসেবেও পরিচয় প্রদান করা হয়। ইন্দোনেশিয়া, চীন, কোরিয়া ইত্যাদি অঞ্চলেও এদের সদর্পে বিচরণ ছিল। ন্যাশনাল জিওগ্রাফির মতে রাশিয়ার পুব দিকে, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার দিকে এদের দেখা মেলে বর্তমানে, তবে সংখ্যায় খুবই নগণ্য। অনেকে বলেন ১৯২১ সালে সর্বশেষ কোরিয়ান টাইগার দেখা গিয়েছিল এই অঞ্চলে।
এশিয়াটিক কালো ভালুক (Ursus thibetanus) বা চন্দ্রভল্লুক কোরিয়ান উপকথায় সাহস এবং শক্তির প্রতীক। বান্দাবির নামের প্রথম অংশটুকু এসেছে ‘বান্দাল’ থেকে যার অর্থ “অর্ধ-চন্দ্র”। ভালুক মাসকটটির গায়ে আঁকা অর্ধচন্দ্রাকার এই চিহ্নটি দিয়ে তাই বোঝানো হয়েছে।
এই ভালুকটি এশিয়াতে আগে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত, তবে একুশ শতকের শুরুতেই হুমকির সম্মুখে পড়ে এই প্রজাতিটি। বর্তমানে কোরিয়ান চিড়িয়াখানায় চল্লিশটির মতো কালো ভালুক রয়েছে বলে কর্তৃপক্ষ জানায়।
তবে অলিম্পিকের মাসকট হবার প্রথম সৌভাগ্য “বাঘ” সুহোরাং-এর নয়। ১৯৮৮ সালের গ্রীষ্ম অলিম্পিকে হোডোরি নামক একটি কমলা রঙের আমুল বাঘের আবির্ভাব ঘটে। কোরিয়াতে “হো” শব্দটির মানে হচ্ছে বাঘ ও “ডোরি” শব্দটির মানে হচ্ছে পুরুষের সম্মান।
(ফিচারটি অনূদিত হয়েছে এই সাইট থেকে)