পুষ্টিবিজ্ঞানী ডক্টর সাবরিনা রশিদ । কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে ১৯৯৬ সালে ব্র্যাকের গবেষণা ও মূল্যায়ন বিভাগে কাজ শুরু করেন। অস্ট্রেলিয়ার কেনবেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবলিক হেলথ নিউট্রিশনের ওপর পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিপ্লোমা করেন। ১৯৯৯ সালে আইসিডিডিআর’বিতে কাজ করতে করতে পিএইচডি করতে যান আমেরিকার কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে আইসিডিডিআর’বিতে অ্যাসোসিয়েট সায়েন্টিস্ট হিসেবে কর্মরত সাবরিনা। একটি প্রকল্পের আওতায় কর্মজীবী মায়েদের বুকের দুধ সংরক্ষণের মাধ্যমে শিশুর পুষ্টির চাহিদা পূরণের পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। আজ থাকছে তাকে নিয়ে লেখা।
২০০৮ সালের কথা। ওই বছর মা হন সাবরিনা রশিদ । মাতৃত্বকালীন ছুটির চার মাস পর কাজে যোগ দেয়ার কথা ভাবলেন। কিন্তু সমস্যা তৈরি হলো সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানো নিয়ে। এক আত্মীয় তাকে একটি ব্রেস্টপাম্প দিয়ে বলেছিলেন, ‘তুমি চাকরি করো, এটি তোমার কাজে লাগবে।’ পরবর্তীতে এটি ব্যবহার করে দেখলেন, পাম্প করে বুকের দুধ সংগ্রহ করা যায়। অফিসে যাওয়ার আগে এ পদ্ধতিতে তিনি বুকের দুধ সংগ্রহ করে রেফ্রিজারেটরে রেখে দিতেন।’
সাবরিনা রশিদ বলেন, ‘আমি শিশুকে কখনো ফর্মুলা খাওয়াইনি। আর এ কাজটি আমি করতে পেরেছি বুকের দুধ রেফ্রিজারেটরে রেখে দেয়ার মাধ্যমে এবং আমার বাড়িতে শিশুকে দেখাশোনার জন্য ছিলেন মা।’
২০১৩ সালে একটি ক্যাফেতে সাবরিনার সঙ্গে পরিচয় হয় কানাডার টরন্টো ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীদের। তিনি বলেন, ‘সেখানে পাঁচ-ছয়জন খাওয়াদাওয়া করছিলেন। তারা সবাই ইঞ্জিনিয়ার। কথায় কথায় আমি জানতে পারি তারা সবাই বাংলাদেশে এসেছেন বিভিন্ন সমস্যা খুঁজতে এবং সে বিষয়ের ওপর কারিগরি সমাধান দিতে। এজন্য বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি ঘুরে দেখতে আগ্রহী তারা।
এ কথা জানার পর স্বভাবতই ডক্টর রশিদ তাদেরকে আইসিডিডিআরবিতে আমন্ত্রণ করেন। এর পর তিনি তাদেরকে বুকের দুধ সংরক্ষণের কাজ করতে রেফ্রিজারেশনের সমস্যার কথা জানান। অবহিত করেন নিম্ন আয়ের কর্মজীবী মায়েদের জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করা না গেলে বুকের দুধ সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। কানাডার দলটি তখন বুকের দুধ পাস্তুরাইজেশন করার বিষয়টি জানালে সাবরিনা তাদের বলেছিলেন, যন্ত্রটি স্বল্প মূল্যের হওয়ার পাশাপাশি সহজে তৈরির ব্যবস্থা করতে হবে।
এর পর শিক্ষার্থীরা কানাডায় ফিরে সাবরিনা রশিদ’র সঙ্গে গ্র্যান্ড চ্যালেঞ্জ কানাডায় অর্থায়নের আবেদন করলে প্রজেক্ট অনুমোদিত হয়। টরন্টো ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রস্তাবনা লিখেন তিনি। তাদের অংশ ছিল যন্ত্রটি প্রস্তুত করে তা পাস্তুরাইজেশনে কাজ করছে কিনা দেখা এবং এটা কর্মজীবী মায়েদের কাজে লাগানো। এভাবেই চলে যায় বছরখানেক সময়। ২০১৪-এর প্রথম দিকে তিনটি মেশিন আনা হয়। তার পর শুরু হয় যন্ত্রটির পরীক্ষা-নিরীক্ষা। বুকের দুধ পাস্তুরাইজেশন করে সাধারণ তাপমাত্রায় কত সময় নিরাপদ রাখা যাচ্ছে এবং সেখানে জীবাণু থাকছে কিনা, এ বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হয়।
সাবরিনা রশিদ বলেন, ‘এই পদ্ধতিতে মায়েরা বুকের দুধ পাস্তুরিত করে ৮ ঘণ্টা পর্যন্ত নিরাপদে রেখে শিশুকে খাওয়াতে পারেন। এর ফলে গুঁড়ো দুধের ওপর নির্ভরশীল কর্মজীবী মায়ের অনুপস্থিতিতেও শিশু পুষ্টি চাহিদার ব্যাঘাত ঘটবে না। একই সঙ্গে স্বল্প আয়ের মায়েদের শিশুদের বুকের দুধ খাওয়ানোর প্রতিবন্ধকতা দূর হবে।’ এভাবেই নিজের সৃষ্টিশীল চিন্তা আর কাজের মাধ্যমে একের পর এক অনন্য কাজ করে চলেছেন ডক্টর সাবরিনা রশিদ । যন্ত্রটির নিরাপদ ব্যবহার সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে তা মাঠপর্যায়ে ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়। এর পর মায়েদের কাছ থেকে বুকের দুধ সংগ্রহ করে পাস্তুরিত ও সাধারণ বুকের দুধ ১০ মিলিলিটার করে বোতলে রেখে ২ ঘণ্টা পর পর দুই ধরনের বোতল খুলে পরীক্ষা করা হয় জীবাণু তৈরির বিষয়টি। সাবরিনা রশিদ দেখলেন, পাস্তুরিত করার ৮ ঘণ্টা পর্যন্ত তেমন জীবাণু তৈরি হচ্ছে না। তবে ৮ ঘণ্টা পর জীবাণু বেড়ে যাচ্ছে, তখন বুকের দুধ আর শিশুকে খাওয়ানোর উপযোগী থাকছে না। সাধারণভাবে দেখলে দুধটা ফেটে যাচ্ছে বা গন্ধ তৈরি হচ্ছে।
সাধারণত বাড়ি থেকে কেউ বাচ্চা নিয়ে এসে দুধ খাইয়ে যান। কিন্তু এতে সমস্যা অনেক—বাচ্চার হয়তো ঘুম ভাঙাতে হয় অথবা বাচ্চার তখন খাওয়াতে মন নেই অথবা বাড়ি অনেক দূরে ইত্যাদি। সাবরিনারা দুধ সংগ্রহ করে নাম লিখে লেবেল লাগিয়ে দিতেন। এখন স্বাস্থ্যকর্মীরাই সে দায়িত্ব পালন করেন। একটি যন্ত্র আইসিডিডিআরবির হাসপাতালেও ব্যবহৃত হচ্ছে।