গল্প উপন্যাসে আমরা দেখে থাকি দুঁদে গোয়েন্দারা কিংবা দুর্ধর্ষ পুলিশ অফিসার রহস্যের সমাধান করে ফেলছেন ক্ষুরধার মস্তিষ্কের সাহায্যে। পড়ে আমরা আনন্দিত হয়, শিহরিত হই। বাহবা জানাই শার্লক হোমস কিংবা ফেলুদাকে। কিন্তু বাস্তব অনেক কঠিন। এখানে যেমন খুনের রহস্য কিনারা করা হয়, ঠিক তেমনি শত শত বছর ধরে অমীমাংসিত থাকে আলোচিত কোন খুনের রহস্য। বলা বাহুল্য, এই খুনের কিনারা না হবার কারণেই মানুষের কাছে এটির আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। কি হল? কি হয়েছিল? আসলে খুনী কে ছিল? এমনি হাজারো প্রশ্ন।
আজ আপনাদের একটি গল্প শোনাই। গল্পটি একজন খুনীর।
তার নাম নেই, পরিচয় নেই। সূত্র বলতে আছে তার দ্বারা আক্রান্ত অসহায় নিহত কিছু ভিক্টিম, একটা কুঠার আর একটা চিঠি! এই দিয়ে কি একজন খুনীকে ধরা সম্ভব? গল্প উপন্যাসে হয়ত সম্ভব কিন্তু নিউ অরলিয়েন্সের সে খুনীকে ধরা আজো সম্ভব হয় নি। রাজ্যের পুলিশ ঘোল খেয়ে গিয়েছে এই খুনীকে ধরতে গিয়ে।
১৯১৮ সালের মে মাস থেকে ১৯১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত নিউ অরলিন্স ও লুইজিয়ানা রাজ্যে এক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আটজন নারী ও পুরুষ খুন হয় এই সময়ে। খুনের অস্ত্রটি বেশ অভিনব। খুনী মৃত ব্যক্তিদের বাড়িতে থাকা কুঠার দিয়েই তাদের খুন করেন। তবে কিছু কিছু খুন করা হয় খুনীর নিজস্ব কুঠারের সাহায্যে। মনস্তাত্ত্বিকরা এই খুনী সম্পর্কে বলেছেন, হয়ত কুঠারের প্রতি এই ব্যক্তির কোন আকর্ষণ ছিল কিংবা কুঠার নিয়ে তার বীভৎস কোন অভিজ্ঞতা আছে। এই জিঘাংসার মূল্য চুকাতে হয় আটজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে। মৃত ব্যক্তিরা বেশিরভাগই ছিলেন ইতালীয়-আমেরিকান।
খুনগুলো হঠাৎ করে যেমন শুরু হয়েছিল, ঠিক তেমনি হঠাৎ করেই শেষ হয়ে যায়। তবে ১৯২১ সালে ঐ অঞ্চলে নতুন করেই আবার একই পদ্ধতিতে খুন করা শুরু হয়। তৎকালীন মিডিয়ায় নতুন করে আবার তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। তবে পুলিশের দেয়া এক বিবৃতিতে বলা হয় যে এই খুনীর স্টাইলের সাথে নিউ অরলিন্সের খুনীর আপাত কিছু মিল থাকলেও বৈসাদৃশ্যই বেশি। এই খুনীও কিছুদিন পর শীতনিদ্রায় চলে গেল। বলা বাহুল্য, পুলিশ এরও টিকি’র নাগাল পায় নি। তবে পুলিশ ধারণা করছেন, ইনি আগের খুনী দ্বারা “অনুপ্রাণিত” হয়ে খুনগুলো করতেন।
একটি চিঠি প্রকাশিত হল ১৯১৯ সালের ১৩ই মার্চ। চারদিকে শোরগোল শুরু হল। যিনি চিঠি পাঠিয়েছেন, তিনি স্বয়ং নিউ অরলিন্সের কুঠার খুনী! কি ছিল সে চিঠিতে? তার কিয়দংশ নিচে দেয়া হলঃ
“আমি কোন মানুষ নই। নরকের তীব্র উষ্ণতা থেকে উঠে আসা এক ভয়ঙ্কর আত্মা। বোকা পুলিশ আর অরলিন্সবাসী আমার নাম দিয়েছে দ্য এক্সমেন (কুঠার-মানব)। যখনই আমি কোন মানুষের ছায়া দেখতে পাব, আমি তাকে খুন করব। আমি একাই জানব তারা কারা হবে। আমি কোন সূত্র ছেড়ে যাব না। শুধু ছেড়ে যাব মৃতের রক্তমাখা আর মগজে জর্জরিত কুঠারটি। এই মৃতরা হবে তারাই, যারা আমাকে সঙ্গ দিতে নরকে যাচ্ছে…”
স্বাভাবিকভাবেই এই চিঠি পাবার পর নতুন করে উৎকণ্ঠা আর অবিশ্বাসের দোলাচলে মানুষের দিনকাল কাটতে থাকে। তবে কি সত্যিই ফিরে এল আবার এই খুনী?
কুঠার হাতে এই খুনীকে নিয়ে নানা তত্ত্ব ও তথ্য রয়েছে। একে নিয়ে সবচাইতে বেশি গবেষণা করেছেন অপরাধ বিষয়ক রিপোর্টার কলিন উইলসন। তিনি ধারণা করেন জোসেফ মমফ্রে নামক এক ব্যক্তি হয়তোবা কুঠার খুনী হিসেবে বিবেচ্য হতে পারেন। কিন্তু তার এই তত্ত্ব পরবর্তীতে নানা কারণে গ্রহণযোগ্য হয় নি।
মজার ব্যপার হচ্ছে, চিঠিতে খুনী উল্লেখ করেছিল সে জ্যাজ সঙ্গীতের অনেক বড় ভক্ত। ১৯১৯ সালে জোসেগ জন দ্যাভিলা কুঠার খুনীকে নিয়ে একটি গান রচনা করে।
অপরাধ জগতে এখনো নিউ অরলিন্সের কুঠার খুনী একটি চাঞ্চল্যকর অমীমাংসিত রহস্য।