গত গ্রীষ্মকালীন দলবদলে সব রেকর্ড ভেঙ্গেচুরে বার্সা ছেড়ে পিএসজিতে নাম লিখিয়েছিলেন নেইমার। এরপর থেকেই নেইমারের যোগ্য উত্তরসূরি খুঁজছিল দলটি। বরুশিয়া ডর্টমুন্ড থেকে ওসমান ডেম্বেলেকে আনলেও ইনজুরির কারণে এখনো ঠিকভাবে মাঠেই নামতে পারেননি তিনি। তবে এবার বোধহয় নেইমারের যোগ্য উত্তরসূরি পেয়েই গেল বার্সেলোনা। এক ব্রাজিলিয়ানের অভাব পূরণ করতে লিভারপুল থেকে অনেক নাটকের পর আরেক ব্রাজিলিয়ানকেই নিয়ে এল তারা, ফিলিপে কুটিনহো। কুটিনহো কি পারবেন বার্সায় তাঁর ব্রাজিলীয় পূর্বসূরিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সফল হতে? সে প্রশ্ন আপাতত সময়ের হাতে তোলা থাক, এখন চলুন দেখে আসা যাক বার্সায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়া ছয় ব্রাজিলিয়ানের কথা।
রোনালদিনহো:
ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে স্কিলফুল ফুটবলারদের একজন রোনালদিনহো গাউচো বার্সার জার্সি গায়ে যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছেন, তা বোধহয় খোদ লিওনেল মেসিও পাননি। শুধু নিজ দলের সমর্থকদের নয়, রোনালদিনহো যে মন জয় করেছিলেন রাইভাল সমর্থকদেরও!
২০০৩ এ ডেভিড ব্যাকহামকে পাওয়ার লড়াইয়ে রিয়াল মাদ্রিদের কাছে হেরে অনেকটা বাধ্য হয়েই রোনালদিনহোকে পিএসজি থেকে নিয়ে আসেন তখনকার বার্সা প্রেসিডেন্ট হুয়ান লাপোর্তা। লাপোর্তা নিজেও বোধহয় তখন জানতেন না, কি রত্ন তিনি নিয়ে এসেছেন ন্যু ক্যাম্পে!
বার্সাকে আবারো মাদ্রিদের সাথে লড়াই করার মত অবস্থায় নিয়ে আসেন রোনালদিনহো। প্রথম মৌসুমেই বার্সাকে লীগ রানার্সআপ করেন, যেখানে মৌসুমের মাঝপথেও তারা ছিল ১২ নম্বরে। পরের মৌসুমেই দলকে লীগ শিরোপা জেতান, চ্যাম্পিয়ন্স লীগের শিরোপা এনে দেন ২০০৬ সালে।
তিনি যে বার্সায় ফুটবলের জাদু দেখাতেই এসেছেন, তা পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন সেভিয়ার বিপক্ষে লীগে নিজের প্রথম গোল দিয়েই। নিজ গোলকিপারের থেকে বল নিয়ে ২ ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে ৩০ গজ দূর থেকে করেছিলেন লা লিগায় নিজের প্রথম গোল। তবে রোনালদিনহোর বার্সা ক্যারিয়ারের সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্তগুলোর একটি এসেছিল ২০০৫ সালের ১৯ নভেম্বর, যেদিন সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে খোদ মাদ্রিদ সমর্থকেরা তাঁকে দাঁড়িয়ে সম্মান জানিয়েছিল। বার্সার ৩-০ গোলের জয় রোনালদিনহো এতটাই অসাধারণ খেলেছিলেন যে তাঁকে সম্মান না জানিয়ে পারেননি চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবের সমর্থকেরাও।
রোনালদিনহোর যে অবদান বার্সা সমর্থকেরা কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করবে তা হল, লিওনেল মেসিকে গড়ে তোলা। মেসি নিজেও বহুবার স্বীকার করেছেন, আজকের মেসি হয়ে ওঠার পেছনে রোনালদিনহোর অবদান অনেক। বার্সায় থাকাকালীন সময়েই রোনালদিনহো জিতেছেন ব্যালন ডি অর, ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলার ও ইউরোপিয়ান প্লেয়ার অফ দ্য ইয়ারের মত ব্যক্তিগত পুরষ্কার। তাইতো বার্সেলোনার ইতিহাসেরই সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার মানা হয় এই কিংবদন্তিকে।
রোনালদো লিমা:
বার্সার ইতিহাসে আরেক ব্রাজিলীয় কিংবদন্তির নাম রোনালদো লিমা। ফুটবল ইতিহাসেরই অন্যতম ভয়ংকর স্ট্রাইকার হিসেবে মানা হয় যাকে, সেই রোনালদো বার্সার জার্সি গায়েও মাঠ মাতিয়েছেন। ১৯৯৬ সালে সেই সময়ের রেকর্ড ট্রান্সফার ফির বিনিময়ে ডাচ ক্লাব পিএসভি আইন্দহোফেন থেকে বার্সায় আসেন রোনালদো। রোনালদোর বার্সা ক্যারিয়ার যদিও মাত্র ১ মৌসুম ব্যাপী ছিল, কিন্তু ওই এক মৌসুমেই দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দিয়ে মন জয় করেছিলেন সব সমর্থকদের। ওই সময়েই এক মৌসুমে ৪৯ ম্যাচে ৪৭ গোল করেছিলেন ‘দ্য ফেনোমেনন’! এখনকার সময়ে এসেও বেশিরভাগ ফুটবলার যা করতে পারেননা।
ডিফেন্ডারদের জন্য এতটাই আতঙ্ক সৃষ্টি করতেন রোনালদো, এতটাই দুর্দান্ত ছিল তাঁর গোল করার দক্ষতা, প্রায়শই তাঁকে পেলের সাথে তুলনা করা হত। যেন নিজের ইচ্ছেমত মুড়ি মুরকির মত গোল করতে পারতেন! বার্সা ক্যারিয়ারে রোনালদোর সবচেয়ে স্মরণীয় গোলটা বোধহয় আসে কম্পোস্তেলার বিপক্ষে। নিজেদের অর্ধে বল পেয়ে চার ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে জালে বল জড়িয়েছিলেন তিনি। রোনালদোর তখনকার কোচ ববি রবসন তো বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না এমন গোলও করা সম্ভব!
এক মৌসুম থেকেই ক্লাবকে জিতিয়েছিলন উয়েফা কাপ উইনার্স কাপ, কোপা ডেল রে ও সুপার কোপা। আর সেই অনবদ্য পারফরম্যান্সের সুবাদেই মাত্র ২০ বছর বয়সে সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে জিতে নেন ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলারের খেতাব।
ওই মৌসুমেই ৩৭ ম্যাচে ৩৪ গোল করে লা লিগার সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরষ্কার জিতেছিলেন। ইউরোপের শীর্ষ ৫ লীগ মিলিয়েই সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়ার কারণে জিতেছিলেন ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুটও। শেষ পর্যন্ত বার্সা বোর্ডের সাথে বনিবনা না হওয়ায় এক মৌসুম পরেই পাড়ি জমিয়েছিলেন ইন্টার মিলানে, কিন্তু বার্সায় তাঁর অবদান এখনো শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন সব সমর্থকেরা।
দানি আলভেজ:
সেভিয়ার অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার ছিলেন তিনি। দলটির হয়ে জিতেছিলেন ২ টি ইউরোপা লীগ, ১টি উয়েফা সুপার কাপ, ১ টি কোপা ডেল রে ও ১ টি সুপারকোপা। মাত্র ৪৩ ম্যাচ খেলেই হয়ে উঠেছিলেন ক্লাবটির বড় ভরসা। আর এই দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দিয়েই তিনি নজর কাড়েন বার্সেলোনার। ২০০৮ সালে ২৩ মিলিয়ন পাউন্ড দিয়ে আলভেজকে সেভিয়া থেকে নিয়ে আসে বার্সা।
বার্সায় এসে নিজেকে মানিয়ে নিতে মোটেও দেরি করেননি এই ব্রাজিলিয়ান রাইট ব্যাক। বার্সেলোনার সোনালী সময়ের অন্যতম প্রধান কাণ্ডারি ছিলেন তিনি। ২০০৮-০৯ ও ২০১৪-১৫, দুই ট্রেবলজয়ী মৌসুমেই দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় ছিলেন তিনি।
রক্ষণ ও আক্রমণে সমান ভূমিকার জন্য পেপ গার্দিওলার দলে অটোমেটিক চয়েস ছিলেন আলভেজ। মেসিকে সর্বোচ্চ সংখ্যক অ্যাসিস্ট করা বার্সা খেলোয়াড়ও এই দানি আলভেজই। মেসির সাথে তাঁর রসায়ন ছিল চমৎকার। মাঠে যে এনার্জি নিয়ে দৌড়াতেন, তা বাকি খেলোয়াড়দের মধ্যেও উদ্যম তৈরি করে দিত।
ট্রফি জয়ের দিক থেকে বার্সার ইতিহাসের অন্যতম সফল ফুটবলারই বলা যায় আলভেজকে। কাতালানদের হয়ে ৩৯১ ম্যাচ খেলে ট্রফি জিতেছেন ২৩ টি! দীর্ঘ ক্যারিয়ারে গোল করেছেন ২১ টি, সাথে করেছেন ৭৪ টি অ্যাসিস্টও। বার্সায় দানির অবদান এতটাই ছিল যে, ক্লাব ছেড়ে যাওয়ার কয়েক মৌসুম হয়ে গেলেও এখনো তাঁর যোগ্য উত্তরসূরি খুঁজে বের করতে পারেনি ক্লাবটি।
রিভালদো:
ফ্রিকিকের মাস্টার হিসেবে খ্যাত ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি রিভালদোও ক্যারিয়ারের সুসময় কাটিয়েছেন বার্সেলোনায়। এক মৌসুম শেষেই রোনালদোর আকস্মিক বিদায়ের পর অনেকটা তাঁর বিকল্প হিসেবেই আনা হয় আরেক ব্রাজিলিয়ান রিভালদোকে। ডিফেন্ডারদের জন্য রীতিমত আতঙ্ক ছিলেন প্রকৃতি প্রদত্ত প্রতিভা নিয়ে জন্মানো এই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার।
প্রতিপক্ষের বক্সের সামনে যেকোনো দূরত্ব ও যেকোনো অ্যাঙ্গেল থেকে নিখুঁত শট নেয়ার ক্ষমতা রাখতেন রিভালদো। তাঁর বাকানো ফ্রিকিক ও ওভারহেড কিকগুলো নিয়ে পুরো ইউরোপেই আলোচনা হত তখন। বার্সেলোনায় এতটাই প্রভাব ফেলেছিলেন রিভালদো, যে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড অধিনায়ক রয় কীন ক্লাবকে বলেছিলেন রিভালদোকে সাইন করাতে।
কাতালান জার্সি গায়ে রিভালদোর সবচেয়ে স্মরণীয় ম্যাচ ছিল ক্লাবে তাঁর শেষ ম্যাচটিই। ২০০০-০১ মৌসুমে ভ্যালেন্সিয়ার বিপক্ষে দারুণ হ্যাট্রিক করে দলকে ৩-২ গোলে জিতিয়েছিলেন, সাথে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের জন্য কোয়ালিফাইও করিয়েছিলেন। ওই ম্যাচেই ৯০ তম মিনিটে যে ওভারহেড কিকে গোলটি করেছিলেন, সেটিকে তাঁর ক্যারিয়ারেরই অন্যতম সেরা গোল বলে মানা হয়।
৫ বছরের বার্সা ক্যারিয়ারে ১৩০ গোল করেছিলেন রিভালদো। ক্লাবকে লা লিগা, কোপা ডেল রের মত শিরোপা জিতিয়েছেন। দুর্দান্ত ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের জন্য ১৯৯৯ সালে জিতেছিলেন ফিফা বর্ষসেরা খেলোয়াড় ও ব্যালন ডি অর দুটি পুরষ্কারই।
রোমারিও:
বার্সার ইতিহাসের আরেক জনপ্রিয় ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার রোমারিও। ১৯৯৩ সালে পিএসভি আইন্দহোফেন থেকে বার্সায় আসেন এই সুপারস্টার। রিস্টো স্টইচকভ, পেপ গার্দিওলা, মাইকেল লাউড্রপদের সাথে মিলে ইয়োহান ক্রুইফের অধীনে গড়ে তোলেন বার্সার ‘ড্রীম টিম’। এসেই ক্লাবকে জেতান লা লিগা, ৩০ ম্যাচে ৩৩ গোল করে হন লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতা। ওই মৌসুমেই দলকে চ্যাম্পিয়ন্স লীগ ফাইনালেও তুলেছিলেন, কিন্তু ফেভারিট হওয়া সত্ত্বেও আন্ডারডগ মিলানের কাছে ৪-০ গোলে বিধ্বস্ত হয় বার্সা।
বার্সার জার্সি গায়ে রোমারিওর অন্যতম সেরা পারফরম্যান্স ছিল ন্যু ক্যাম্পে এল ক্লাসিকোতে মাদ্রিদের বিপক্ষে ৫-০ গোলে জেতা ম্যাচে। চ্যাম্পিয়ন্স লীগে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে দুই লেগে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন। প্রথম লেগে কিপার পিটার স্মাইকেলকে নাটমেগ করে গোল দিয়েছিলেন, দ্বিতীয় লেগে প্রায় ১ লাখ ১৪ হাজার সমর্থকদের সামনে ন্যু ক্যাম্পে ৪-০ গোলে জয়ী ম্যাচে আবারো গোল করেন। ন্যু ক্যাম্পের ওই ম্যাচের পর ইউনাইটেড অধিনায়ক স্টিভ ব্রুস বলেছিলেন, ‘আমি যাদের বিপক্ষে খেলেছি তাদের মধ্যে রোমারিওই সেরা’।
বার্সায় থাকাকালে ১৯৯৪ সালে ফিফা বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের খেতাব জিতেছিলেন রোমারিও। দলটির হয়ে দুই মৌসুম খেলে ৪৬ ম্যাচে করেছিলেন ৩৪ গোল।
নেইমার:
বার্সেলোনায় ব্রাজিলের প্রতিনিধিত্ব করা সর্বশেষ তারকা খেলোয়াড় সময়ের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় নেইমার। তাঁর পিএসজিতে চলে যাওয়া নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু নেইমার যে বার্সার ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্রাজিলীয় খেলোয়াড়, এটা নিয়ে বিতর্কের কোন সুযোগ নেই।
২০১৩ সালে সান্তোস থেকে যখন বার্সায় এলেন, ভবিষ্যতের তারকা হিসেবে তখন থেকেই নামডাক ছিল নেইমারের। বার্সায় এসে কুঁড়ি থেকে ফুল হয়ে ফুটেছেন তিনি। মেসি ও সুয়ারেজের সাথে মিলে ভয়ংকর ত্রয়ী ‘এমএসএন’ গড়ে তুলেছিলেন, যে ত্রয়ী বার্সাকে জিতিয়েছে বহু শিরোপা, ভেঙ্গেছেন গোল করার অনেক রেকর্ড। ড্রিবলিং ও গোল করার ক্ষমতা মিলিয়ে নেইমার হয়ে উঠেছিলেন ক্লাবের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়।
তাঁকে আটকাতে বারবার ফাউল করেছেন ডিফেন্ডারেরা, যে কারণে সবচেয়ে বেশি ফ্রিকিক ও পেনাল্টি পাওয়া খেলোয়াড়ও ছিলেন তিনি। চ্যাম্পিয়ন্স লীগে পিএসজির বিপক্ষে ঐতিহাসিক ৬-১ গোলের জয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি, করেছিলেন জোড়া গোল। চার বছরের বার্সা ক্যারিয়ারে ১০ টি ট্রফি জিতেছেন নেইমার, গোল করেছেন ১০৫ টি।
স্পোর্টসকীড়া অবলম্বনে