দার্জিলিং
এসে গেছে শীত, বেড়ানোর একেবারে মোক্ষম সময়। দেশের ভেতরে বেড়ানোর জায়গায় কোনো অভাব নেই, তবে যারা এবার একটু প্রতিবেশী দেশটিতে ঘুরে আসার পরিকল্পনা করছেন তাদের জন্য থাকছে দার্জিলিং ভ্রমণের খুঁটিনাটি সব তথ্য। মেঘের দেশ দার্জিলিংয়ে না গেলে ভারত ভ্রমণই যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। চলুন তবে জেনে নেয়া যাক দার্জিলিং ভ্রমণ বৃত্তান্ত।
পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে আলাদা করে কিছু বলার নেই। বিদেশ ভ্রমণের নিয়ত করার পরপরই পাসপোর্ট তৈরি করতে দিতে হবে, সাধারণ পাসপোর্ট ২১ কার্যদিবসের মধ্যে হাতে পেয়ে যাবেন। ইমারজেন্সির ক্ষেত্রে সময় লাগবে ১২ দিনের মতো। আর ভারতের ভিসার জন্য আবেদন করলে ৮ দিনের মধ্যে তা হাতে পাওয়া যায়। ভিসা হয়ে গেলে এবার বাসে চড়ে বসার পালা। কল্যাণপুর/গাবতলী থেকে পঞ্চগড় বা লালমনিরহাটের প্রচুর বাস পাবেন আপনি, এসে/নন এসি যেটা চান। পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা পর্যন্ত সরাসরি যায় শ্যামলী পরিবহনের একটি বা দুটি বাস, হানিফ/শ্যামলীর আরও কয়েকটি বাস সরাসরি ঢাকা থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত যায়। অন্যান্য বাসগুলো পঞ্চগড় শহরে নামিয়ে দেবে আপনাকে, সেখান থেকে লোকাল বাসে চড়ে বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্টে যেতে হবে। ঢাকা থেকে পঞ্চগড়/তেঁতুলিয়ার নন এসি বাস ভাড়া ৬০০-৭০০ টাকার মধ্যে, এসি পাবেন ৯০০-১৫০০ টাকার ভেতরেই। আর বুড়িমারী বর্ডার পর্যন্ত যাবার জন্যে কল্যাণপুর থেকে বাস পাবেন, চড়ে বসুন। ভাড়া নন-এসি ৫৫০-৬৫০ টাকা।
ইমিগ্রেশনের কাজকর্ম সেরে ঢুকে পড়ুন ভারতে। ফুলবাড়ী(বাংলাবান্ধা) বর্ডার থেকে শিলিগুড়ি বেশ কাছেই, এখান থেকে লোকাল বাসে ১৫/২০ রুপি খরচ করেই শিলিগুড়ি চলে যেতে পারবেন। আর চ্যাংড়াবান্ধা (বুড়িমারি) বর্ডার দিয়ে ভারতে ঢুকলে টাটা সুমো জিপ পাবেন, কয়েকজন একসঙ্গে থাকলে রিজার্ভ করতে পারেন ১৫০০ রূপির মধ্যে, অথবা শেয়ারে গেলে জনপ্রতি ২৫০ রুপি করে ভাড়া পড়বে। খরচ বাঁচাতে চাইলে একটু হেঁটে চলে যান চ্যাংড়াবান্ধা বাজারে, ব্যাটারীচালিত অটোতে করেও যেতে পারেন। এখান থেকে শিলিগুড়ির বাস পাবেন, ৬০/৭০ রূপি খরচায় পৌঁছে যাবেন শিলিগুড়ি।
শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং প্রায় তিন ঘন্টার পথ, যেতে হয় জীপে চড়ে। দল ভারী হলে জিপ রিজার্ভ করতে পারেন, অথবা শেয়ারেও যেতে পারেন। রিজার্ভে খরচ পড়বে ১২০০-১৫০০ রূপি, শেয়ারে গেলে জনপ্রতি ২০০ রূপির মতো। পাহাড়ী আঁকাবাঁকা রাস্তায় চলতি পথে মেঘেদের সঙ্গে সখ্য হবে আপনার, ভাগ্য ভালো থাকলে মেঘেরা এসে ছুঁয়েও দিয়ে যেতে পারে! একটা জিনিস মাথায় রাখবেন, দার্জিলিঙে রাত আটটার মধ্যে মোটামুটি সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়, হোটেল-দোকানপাট প্রায় সবই। কাজেই হাতে সময় নিয়ে দার্জিলিং পৌঁছানোটা জরুরী, যাতে হোটেল ঠিক করা কিংবা খাওয়াদাওয়া’র মতো কাজগুলো সেরে ফেলা যায়। আগে থেকে হোটেল বুকিং দিতে পারেন, অথবা গিয়েও হোটেল বুক করতে পারবেন। সীমান্ত পার হবার সময় কোন হোটেলে থাকবেন সেটা জানাতে হয়, গুগল ঘেঁটে কোন একটা নাম জানিয়ে দিলেই হলো, সেটা নিয়ে এত ভাবনার কিছু নেই।
মোটামুটি ভালো মানের রুম পেয়ে যাবেন ১০০০-১২০০ রূপির মধ্যেই। দার্জিলিং পুরো শহরটাই পাহাড়ের ওপরে অবস্থিত, বেশী ওপরের দিকে হোটেল নিলে নীচে নামতে অসুবিধে, নীচের দিকের কোন হোটেলে উঠলে হোটেল রুম থেকে পুরো শহরের ভিউটা নজরে পড়বে না- তাই ভালো হয় মাঝামাঝি জায়গায় ম্যাল রোডের(মূল সড়ক) আশেপাশে হোটেল বাছাই করলে। হোটেল রুমে গরম পানি আর ওয়াইফাইয়ের ব্যবস্থা থাকবেই। ইচ্ছে করলে খাবারের ব্যবস্থাও হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে করে নিতে পারবেন। তবে সব হোটেলে এই সুবিধা নেই।
কোথায় ঘুরবেন দার্জিলিং-এ? পুরো দার্জিলিং শহরটাই ছবির মতো সুন্দর, টাইগার হিলে ভোররাতে দাঁড়িয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার ওপরে সূর্যকে উদয় হতে দেখবেন। সাদা বরফের রাজ্যে লালের অনুপ্রবেশের সেই মোহনীয় দৃশ্যের সাক্ষী হতে হাজারো মানুষ ছুটে যায় শেষরাতের ঘুমকে বিসর্জন দিয়ে। এই দৃশ্য দেখতে হলে রাত তিনটায় হোটেল থেকে বেরুতে হবে, জিপ রিজার্ভ করে রাখতে হবে আগে থেকেই। ১৫০০ রূপি পড়বে ভাড়া, হোটেলের লোকেদের বলে রাখলে ওরাই জীপের বন্দোবস্ত করে দেবে।
সারাদিনের জন্যে জীপ ভাড়া করতে পারেন, ২০০০-২২০০ রূপি ভাড়া নেবে, আপনাকে ঘুরিয়ে আনবে দার্জিলিঙের সবগুলো ট্যুরিস্ট স্পট। মোটামুটি ছয়/সাতটা স্পট কাভার হয়ে যাবে একদিনেই। জিপ প্রথমেই আপনাকে নিয়ে যাবে ম্যাল রোড থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরের রক গার্ডেনে, এটা একটা পাহাড়ের নীচে পাথরের ওপর দিয়ে প্রবাহিত একটা ঝর্ণা। রক গার্ডেনে যাওয়ার রাস্তাটা অদ্ভুত রকমের সুন্দর। এখানে দশ রূপি দিয়ে টিকেট কাটতে হয়।
চড়তে পারেন ক্যাবল কারে। নর্থ পয়েন্ট থেকে সিংঘা পর্যন্ত বিস্তৃত পাঁচ মাইল লম্বা রোপওয়েতে স্থাপিত ক্যাবল কারে চড়তে খরচ হবে দেড়শো-দুইশো রূপির মতো। আরও আছে ছবির মতো সুন্দর বাতাসিয়া লুপ, বিশ্বের সর্বোচ্চ রেলস্টেশন ঘুম, বিরল পাহাড়ী বাঘের আস্তানা দার্জিলিং চিড়িয়াখানা, হিমালয়ান মাউন্টেইন ইনস্টিটিউট, যেটি তেনজিং রক নামেও পরিচিত। এছাড়াও আছে ঘুম মনেস্ট্রী। এটি একটি প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির, ঘুম রেলস্টেশনের পাশেই অবস্থিত। বাতাসিয়া লুপ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার সৌন্দর্য্য আপনার চোখে ধরা দেবে অন্য একটা রূপে, এখানে পনেরো রূপি দিয়ে এন্ট্রি টিকেট নিতে হয়। জাপানীজ টেম্পলে যেতে পারেন, শহরের একদম উঁচু জায়গাটায় এটার অবস্থান, এখান থেকে পুরো শহরটাকে এক নজরে চোখে পড়ে, নিজেকে আপনার পাখি মনে হবে এখানে দাঁড়িয়ে।
বলা হয়, দার্জিলিঙের বিখ্যাত ট্রয়-ট্রেনে না চড়লে নাকি দার্জিলিং ভ্রমণটাই বৃথা। দুই ঘন্টার রাইডের জন্যে গুণতে হবে জনপ্রতি ৬৩০ রূপি করে। টয়-ট্রেনে চড়লে আপনাকে বাড়তি করে আর ঘুম স্টেশন বা বাতাসিয়া লুপ জায়গাগুলোতে না গেলেও চলবে, কারণ যাত্রাপথে টয়-ট্রেন বাতাসিয়া লুপে দশ মিনিট যাত্রাবিরতি দেয়, ঘুম স্টেশনে দাঁড়ায় প্রায় আধঘন্টা। আর হ্যাঁ, মনে করে সেন্ট পল’স স্কুলটা দেখে আসতে ভুলবেন না একদমই। প্রায় দুইশো বছর পুরনো এই স্কুলটি অনেকেই দেখে থাকবেন। শাহরুখ খান অভিনীত ‘ম্যায় হু না’ সিনেমার অনেকখানি অংশের শুটিং হয়েছিল এখানে। স্কুল প্রাঙ্গন থেকেই চোখে পড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার শ্বেতশুভ্র রূপ। এই জায়গায় গিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে যেতে পারেন শাহরুখভক্তরা।
বেড়ানোর জায়গা আছে আরও, যেতে পারেন দার্জিলিঙের চা বাগানগুলোতে, তবে মনে রাখবেন, সব জায়গায় কিন্ত প্রবেশের অনুমতি নেই। হ্যাপী ভ্যালি টি-গার্ডেনটি দার্জিলিঙের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং পুরনো চা বাগানগুলোর একটি, এটা ঘুরে দেখতে পারেন পর্যটকেরা। প্রায় আটশো ফুট উঁচুতে স্থাপিত গোর্খাল্যান্ড স্টেডিয়ামটিও দেখার জায়গা, এছাড়া যেতে পারেন ভিক্টোরিয়া ফলস কিংবা শতবর্ষের প্রাচীন মন্দির দিরদাহাম টেম্পলেও। হাতে সময় থাকলে সন্ধ্যেবেলায় বিগ বাজারে সিনেমাও দেখে নেয়া যায়।
দার্জিলিং থেকে মিরিক খুব কাছেই, সময় আর টাকার সমস্যা না থাকলে থাকলে জীপে করে ঘুরে আসতে পারবেন মিরিক থেকেও, দিনে গিয়ে দিনেই ফিরে আসা সম্ভব। পাহাড়ের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়ার এই সুযোগটা মিস করা উচিত হবে না একদমই। তবে মিরিকে লেক ছাড়া দেখার তেমন কিছু নেই আর, যাওয়ার রাস্তাটাই যা সুন্দর। চাইলে শিলিগুড়ি থেকেও মিরিক যাওয়া যায়, সেটাই বরং ভালো। লেকে নৌকায় চড়ার ব্যবস্থাও আছে। বলে রাখি, জায়গাটা খুব আহামরি কিছু নয় অবশ্যই।
দার্জিলিঙে খাবারদাবারের দাম খুব বেশী নয়। বাইরে খেতে চাইলে তিনবেলায় জনপ্রতি পাঁচশো রূপি খরচ করলেই যথেষ্ট। আর যে হোটেলে উঠবেন সেখানেই খাওয়ার চুক্তি করে নিলে খরচ আরো কমবে। যারা হালাল-হারাম খাবার নিয়ে চিন্তিত, তাদের জন্যে মুসলিম হোটেল আছে বেশ কয়েকটা। দার্জিলিং খুব পরিস্কার পরিচ্ছন্ন একটা শহর, রাস্তাঘাটে কোথাও ময়লা-আবর্জনার ছিঁটেফোঁটাও দেখতে পাবেন না। প্রকাশ্যে ধূমপান সেখানে নিষিদ্ধ, সিগারেট খেতে চাইলে হোটেলরুমে বসেই কাজ সারতে হবে।
সাধ্যের মধ্যে সবটুকু সুখ খোঁজার ট্যুরের নাম দার্জিলিং ট্যুর। চাইলে আপনি পাঁচ হাজার টাকায় ভ্রমণ সেরে আসতে পারেন, চাইলে দশ হাজার টাকাও খরচ করতে পারেন, তবে দার্জিলিং গিয়ে বোর হবেন না, এটুকু গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায়।