হেমলকাসা, মহারাষ্ট্রের এক প্রত্যন্ত গ্রাম। প্রাকৃতিক বা ঐতিহাসিক এমন কিছু নেই যা হেমলকাসাকে বিখ্যাত করবে। নাগপুর থেকে ৩৫০ কিলোমিটার দূরে এই গ্রাম। এই অখ্যাত গ্রামকে বিখ্যাত করেছে এই গ্রামের এক যৌথ পরিবার। এই যৌথ পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৯০জন। এই সংখ্যা কিন্তু থেমে নেই, বাচ্চাদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। আর এই যৌথ পরিবারের সদস্য কারা জানেন? পরিবারের মাথাতে কে আছেন? এত্ত বড় পরিবারকে কারা সামলাচ্ছেন? কারা রয়েছেন ভরণপোষণের দায়িত্বে? প্রশ্ন অনেক আর উত্তর একটি নাম – ডঃ প্রকাশ এবং মন্দাকিনী আমতে ৷
জী হ্যাঁ, এরাই তৈরি করেছে এই যৌথ পরিবার। ৫০ একর জমিতে গড়ে উঠেছে আমতেজ অ্যানিমেল আর্ক ৷ এই আর্ক হল গত ৪৫ বছরে পশু পাখিদের স্থায়ী আস্তানা ৷ ময়ূর, হরিণ, বাঘ, ভাল্লুক, কুমীর, হায়না কাকে চাই আপনার? ভয়ঙ্কর ভাল্লুক, হায়না যাকে দেখলে রক্ত পানি হয়ে যাবে যে কোনও মানুষের, সেখানে আমতে পরিবার তাদের সঙ্গে খেলায় মত্ত৷ গৃহপালিত প্রাণীদের পাশাপাশি আমতে পরিবারের ভালোবাসা এবং স্নেহে বন্য পশুরাও যেন হয়ে উঠেছে এখানে বাড়িরই সদস্য, যেখানে প্রত্যেকেই সমান গুরুত্বপূর্ণ৷
আর সাপের কথা কি বলব? এ যেন জঙ্গল বুকের থ্রি-ডি ভার্সন৷ তবে বাস্তবে, একেবারে চোখের সামনে, জলজ্যান্ত৷ লম্বা, ছোট, মোটা, রোগা কত কিই না বাহার তাদের৷ কিন্তু কারও সঙ্গে কারও ঝগড়াঝাটি নেই এতটুকু ৷ ফণা তুললেও, তার পিছনে এতটুকুও রাগ নেই৷ কারণ তারা যে ডঃ আমতের মন্ত্রে দীক্ষিত ৷
এমন একটি মহৎ উদ্যোগ নেওয়ার পিছনের কারণ ?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের যেতে হবে অতীতে৷ ডঃ প্রকাশ আমতের বাবা ছিলেন একজন সমাজসেবী, তার ইচ্ছা ছিল এই গ্রামের জন্য কিছু করার৷ যেসব দরিদ্ররা কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত তাঁদের জন্য বাবা আমতে এবং তাঁর স্ত্রী সাধনা আমতে নিরন্তর সাহায্য করে গেছেন ৷ ১৯৫০ সালে কুষ্ঠরোগিদের জন্য আনন্দন নামে একটি অরগানাইজেশনও খোলেন তারা ৷ পদ্ম ভূষণ, গান্ধী পিস প্রাইজ, রামন ম্যাগসাইসাই অ্যাওয়ার্ড, টেম্পলটন প্রাইজ, জামনালাল বাজাজ অ্যাওয়ার্ড এমনই বহু পুরস্কার, বহু সম্মানে সম্মানিত হন তিনি ৷ আর তাঁরই যোগ্য উত্তরসূরীরূপে নিজেকে প্রমাণ করেন তাঁর ছেলে ডঃ প্রকাশ ৷ সঙ্গী হিসাবে পেয়েছেন তাঁর সহধর্মিনী মন্দাকিনী আমতেকে৷
বাবা আমতে গ্রামের মানুষদের পাশেই সবসময় থাকতে চেয়েছিলেন ৷ চেয়েছিলেন তাঁদের জন্যই কাজ করে যেতে৷ সেই ইচ্ছে পরবর্তীকালেও রূপ পায় ডঃ প্রকাশ আমতের উদ্যোগে৷ তবে এই ধরনের উদ্যোগের পিছনেও রয়েছে আরও একটি মর্মস্পর্শী ঘটনা ৷ শোনা যায়, একদিন জঙ্গলের মধ্যে ডঃ প্রকাশ এবং তাঁর স্ত্রী যাচ্ছিলেন, তাঁরা হঠাৎ দেখেন, একদল মানুষ কিছু বাঁদরকে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে৷ তখন তাঁরা অবাক হয়ে যান৷ তাঁরা ওই দলটিকে গিয়ে বলেন, যদি বাঁদরগুলোকে না মেরে তাঁদের দিয়ে দেওয়া হয় তাহলে গ্রামবাসীদের সাহায্য করবেন এই দম্পতি৷ সেদিন থেকেই তাঁরা ঠিক করে নেন বাকি জীবনটা এই হেমলকাসা গ্রামেই কাটাবেন৷
এখন শুধু এই দম্পতিই নন, তাঁদের পরবর্তী দুই প্রজন্মও এই ভালোবাসার ভাষাতেই বিশ্বাসী৷ ভালোবাসা জগত পরিবর্তন করতে পারে, তো জীব জন্তু বশ করা খুব কি কঠিন? এদের ভালবেসেই দেখুন না, এরা আপনাকে ভালবেসে কি দেয়।