তাঁরা রয়েছেন আমাদের হৃদয়ের নিভৃত কোণে, চিরন্তন ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা সারা বছরব্যাপীই গোটা বাংলাদেশ বয়ে নিয়ে চলেছে। তবে ১৪ ডিসেম্বরের দিনটিতে যেন নতুন করে জাতি স্মরণ করবে তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। ভোর থেকে জনতার ঢল নামবে মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ আর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে। ফুলে ফুলে ছেয়ে যাবে তাঁদের স্মরণে নির্মিত সৌধ। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে দেশের মৃত্যুঞ্জয়, মেধা-মননে অনন্য সন্তানদের কথা স্মরণ করা হবে শ্রদ্ধাভরে।
মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত মুহূর্তে বাঙালি জাতি যখন আসন্ন বিজয়ের আনন্দে উন্মুখ, ঠিক তখন দখলদার পাকিস্তানিদের এদেশীয় দোসর আলবদর, রাজাকার, আলশামস-ঘাতকরা রাতের অন্ধকারে মেতে ওঠে বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞে। তারা হত্যা করে বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের।
মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কাছে পরাজয় স্বীকার করে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের দুদিন আগে ১৪ ডিসেম্বর সারা দেশ থেকে সহস্রাধিক বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে পৈশাচিকভাবে হত্যা করে তারা। অনেকের লাশই পাওয়া যায়নি। এভাবে বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার হীন চক্রান্তে মেতে ওঠে নির্মম ঘাতক-দালালরা। দেশমাতৃকার শ্রেষ্ঠ সন্তান শহীদ বুদ্ধিজীবীরা আমাদের মহান মুক্তি সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে নিজ কর্মের মাধ্যমে স্বাধীনতার সংগঠকদের প্রভূত প্রেরণা জুগিয়েছিলেন। মুক্তিকামী জনগণকে উদ্দীপ্ত করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে।
হানাদাররা সেদিন কেবল ঢাকাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিসেবী, পদস্থ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাসহ প্রায় দেড়শ বুদ্ধিজীবী-কৃতী সন্তানকে অপহরণ করে মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করে। সেই থেকে ১৪ ডিসেম্বর আমাদের জাতীয় জীবনে এক শোকাবহ দিন।
একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। হানাদাররা সে রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকসহ সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে হত্যার মাধ্যমে শুরু করে বাঙালি নিধনযজ্ঞ। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস হানাদাররা বাংলাদেশে গণহত্যা, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ অব্যাহত রাখে। ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহেই নিজেদের পরাজয় অনিবার্য জেনে দখলদাররা বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার গোপন নীলনকশা করে। বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি করে তা তুলে দেয় আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনীর হাতে। ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ওই তালিকা অনুযায়ী পাকবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘৃণ্যতম অপকর্মে এ তিনটি ঘাতক গ্রুপ মেতে ওঠে। কারফিউর মধ্যে রাতের অন্ধকারে বুদ্ধিজীবীদের বাসা থেকে ধরে এনে চোখ বেঁধে রায়েরবাজার ও মিরপুরের বধ্যভূমিতে নির্মম-নৃশংসভাবে হত্যা করে। ১৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতের পর সারা দেশে একযোগে সর্বাধিক সংখ্যক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের তথ্যানুযায়ী, এ পর্যন্ত সারা দেশে ৪৬৭টি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়া গেছে। কেবল ঢাকা ও এর আশপাশে ৪৭টি বধ্যভূমি চিহ্নিত করা হয়েছে। যেখানে দখলদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা বুদ্ধিজীবীসহ সর্বস্তরের মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে রয়েছেন অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদ, ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, ড. সন্তোষ ভট্টাচার্য, ডা. মোহাম্মদ শফি, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লাহ কায়সার, নিজামউদ্দিন আহমেদ, খন্দকার আবু তালেব, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, শহীদ সাবের, সৈয়দ নাজমুল হক, চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান, সুরকার আলতাফ মাহমুদ, ড. আবদুল খায়ের, ড. সিরাজুল হক খান, ড. ফয়জল মহী, ডা. আবদুল আলীম চৌধুরী, সাংবাদিক সেলিনা পারভীন, হবিবুর রহমান, মেহেরুন্নেসা, গিয়াস উদ্দীন আহমদ প্রমুখ।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠন আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, স্মৃতিচারণা, চিত্রপ্রদর্শনীসহ নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে বাংলাদেশ বেতার, বিটিভি, বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ও এফএম রেডিও বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করবে। জাতীয় দৈনিকগুলোতেও বিশেষ নিবন্ধ ও ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হবে।
শহীদ শিক্ষাবিদ ও আইনজীবীদের জেলাওয়ারি একটি তালিকা এখানে উল্লেখ করা হলো।
জেলা ও বিভাগ |
শিক্ষাবিদ | আইনজীবী | ||
প্রাথমিক | মাধ্যমিক | কলেজ | ||
ঢাকা | ৩৭ | ৮ | ১০ | ৬ |
ফরিদপুর | ২৭ | ১২ | ৪ | ৩ |
টাঙ্গাইল | ২০ | ৭ | ২ | |
ময়মনসিংহ | ৪৬ | ২৮ | ১ | ২ |
ঢাকা বিভাগ | ১৩০ | ৫৫ | ১৭ | ১১ |
চট্টগ্রাম | ৩৯ | ১৬ | ৭ | ১ |
পার্বত্য চট্টগ্রাম | ৯ | ৪ | ১ | ১ |
সিলেট | ১৯ | ৭ | ২ | |
কুমিল্লা | ৪৫ | ৩৩ | ১ | ৪ |
নোয়াখালী | ২৬ | ১৩ | ৪ | ২ |
চট্টগ্রাম বিভাগ | ১৩৮ | ৭৩ | ১৩ | ১০ |
খুলনা | ৪৮ | ১৫ | ২ | ২ |
যশোর | ৫৫ | ৩১ | ৫ | ৪ |
বরিশাল | ৫০ | ২১ | ৪ | |
পটুয়াখালী | ৩ | ১ | ||
কুষ্টিয়া | ২৮ | ১৩ | ৪ | |
খুলনা বিভাগ | ১৮৪ | ৮১ | ১৫ | ৬ |
রাজশাহী | ৩৯ | ৮ | ৩ | ৫ |
রংপুর | ৪১ | ২২ | ৯ | ৪ |
দিনাজপুর | ৫০ | ১০ | ১ | ২ |
বগুড়া | ১৪ | ১২ | ২ | |
পাবনা | ৪৩ | ৯ | ১ | ২ |
রাজশাহী বিভাগ | ১৮৭ | ৬১ | ১৪ | ১৫ |
বাংলাদেশ | ৬৩৯ | ২৭০ | ৫৯ | ৪১ |
শহীদ শিক্ষাবিদের (বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া) মোট সংখ্যা = ৯৬৮ | ||||
শহীদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংখ্যা = ২১ | ||||
শহীদ শিক্ষাবিদের মোট সংখ্যা = ৯৮৯ |