আমাজন, স্প্যানিশ পর্যটক ফ্রান্সিস দে ওরেলানাই প্রথম মানুষ যিনি আমাজন নদী ধরে পৌঁছে যান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই রেইন ফরেস্ট। আয়তনে ৫৫ লাখ বর্গ কিলোমিটার। এই বনের বুক চিরে বয়ে গেছে আমাজন নদী। যে নদী প্রতি সেকেন্ডে ৪.২ মিলিয়ন ঘন ফুট পানি নিয়ে ফেলে সাগরে। গোটা পৃথিবীর ২০ শতাংশ অক্সিজেন উৎপাদন করে আমাজন। যে কারণে আমাজনকে বলা হয় পৃথিবীর ফুসফুস। ছোট পোকা-মাকড় আর রং-বেরঙের পাখিতে সমৃদ্ধ এই বনের প্রাণী ও উদ্ভিদ বৈচিত্র্য গবেষকদেরও বিস্মিত করে। প্রায় ৪০০-এর বেশি আদিবাসীর বসবাস এই বনে, যাদের বেশির ভাগেরই আধুনিক পৃথিবীর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। এখনো আমাজনের বহু গহীন স্থানে মানুষের পা পড়েনি।
গোপন, লুকানো ও নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের বাড়তি কৌতূহল রয়েছে। সেই কৌতূহল থেকেই মানুষ অভিযান করে, গবেষকরা খুঁজে বেড়ান রহস্যময়তার পেছনের রহস্য। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বন আমাজন তেমনই এক রহস্য। পৃথিবীর মানচিত্রের দিকে তাকালে সবুজে আচ্ছন্ন সবচেয়ে বড় ভাগটি আমাজনের। গরম আবহাওয়াচ্ছন্ন এই রেইন ফরেস্ট মোট নয়টি দেশজুড়ে বিস্তৃত। দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের উত্তরভাগে ছড়িয়ে রয়েছে বনটি। বনের প্রায় ৬০ শতাংশ রয়েছে ব্রাজিলে। ব্রাজিল ছাড়াও পেরু, কলম্বিয়া, বলিভিয়া, ভেনেজুয়েলা, গায়ানা, সুরিনাম এবং ফ্রেঞ্জ গায়ানা আমাজন বিস্ময়ে ডুবে রয়েছে। ৫৫ লাখ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত এই বনের অনেক স্থানেই এখনো মানুষের পা পড়েনি। মানুষ চাঁদে পা ফেলেছে, গুহার অন্ধকারে নেমেছে, ডুব দিয়েছে মহাসাগরেও— কিন্তু আমাজনের গোপনীয়তা ভাঙতে পারেনি সবটুকু। দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় ৪০ শতাংশই হলো এই দুর্গম আমাজন বন।
পৃথিবীজুড়ে রেইন ফরেস্টের যত আয়তন, তার অর্ধেকটাই আমাজন। বিস্ময়কর এই বনের আয়তন যেমন বিশাল তেমনি বিশাল এই বনের প্রাণী ও উদ্ভিদ-বৈচিত্র্য। আমাজন বনের গহিনে মানুষের চলাচল নেই। তবে আমাজনের জেগে থাকা সবচেয়ে বড় শহরটি রয়েছে ব্রাজিলে। ব্রাজিলের মানাস শহরটিতে ২ লাখ মানুষ বসবাস করেন। বলা যায়, আমাজন বেসিনে এটাই সবচেয়ে বড় শহর। আমাজনের ২.১ মিলিয়ন বর্গ মাইলের বেসিন অঞ্চল বিশ্বের নবম ক্ষুদ্র দেশের আয়তনের সঙ্গে সমতুল্য। রেইন ফরেস্ট আমাজনে মাত্র দুটি ঋতু রয়েছে। গ্রীষ্ম ও বর্ষা। গরমপ্রধান এই বনে ছয় মাস গ্রীষ্ম ও বর্ষা থাকে। এই বনে গুমোট গরম আবহাওয়া কখনোই সরে যায় না। প্রায় সবসময় ৮০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা থাকায় এই বনে পথচলা খুবই কষ্টের। এ ছাড়া এখানকার আর্দ্রতা থাকে ৭৭ থেকে ৮৮ শতাংশ। যে কারণে অল্পতেই হাঁপিয়ে যান বনে প্রবেশকারীরা। আমাজনে সারা বছর বৃষ্টিপাত হয়— এমনটি ভাবলে ভুল হবে। বরং রেইন ফরেস্ট বলা হয় এখানকার অত্যধিক আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত (বর্ষা মৌসুমে) এবং গরম আবহাওয়ার কারণে।
বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ইকোসিস্টেম সমৃদ্ধ আমাজনের বয়স কম করে হলেও ৩ হাজার বছর। এখানে আছে ১২০ ফুট উঁচু গাছ, ৪০ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ, ২৫ লাখ প্রজাতির কীট-পতঙ্গ, ১ হাজার ২৯৪ প্রজাতির পাখি, ৩৭৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ৪২৮ প্রজাতির উভচর এবং ৪২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীসহ হাজারো প্রজাতির অজানা জীব-অণুজীব। গবেষকরা শুধু আমাজনের ব্রাজিল অংশেই ১ লাখ ২৮ হাজার ৮৪৩টি অমেরুদণ্ডী প্রজাতি আবিষ্কার করেছেন। আমাজনের প্রাণী-বৈচিত্র্যের ছোট একটি উদাহরণ পেলেই চমকে উঠতে হয়— আমাজনে পেরুর অংশের একটি গাছে ৪৩ হাজার প্রজাতির পিঁপড়ার সন্ধান মিলেছে। সমগ্র ব্রিটেনেও এত প্রজাতির পিঁপড়ার দেখা পাওয়া যায়নি এখন পর্যন্ত।
সোনার সন্ধানে স্প্যানিস কিছু মানুষ আমাজনে প্রবেশ করেছিলেন। তাদের বেশির ভাগই আর ফিরে আসেননি। যে কজন জীবন নিয়ে ফিরতে পেরেছেন তারা বলেছেন, ওই বনে বিষাক্ত পানি আছে। আছে মানুষখেকো সাপ। আর আছে ফুটন্ত নদী, যার পানি নিচ থেকে টগবগিয়ে ফুটছে। সে মিথ এবার বাস্তব হলো। আমাজন বনে সত্যিই রয়েছে ফুটন্ত নদী। এই রহস্যময় নদীর পানির তাপমাত্রা ৮৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর পানি এত গরম যে তাতে মানুষ মারা যেতে পারে। আমাজনের অ্যানাকোন্ডা নিয়েও নানা রকমের মিথ রয়েছে। মানুষ গিলে ফেলা সাপের কথা উঠলেই দৈত্যাকার অ্যানাকোন্ডার দিকে অভিযোগের আঙ্গুল ওঠে। কিন্তু বাস্তবে মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকতেই পছন্দ করে এই দৈত্যাকার সাপ। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আকারের এই সাপ আমাজনের আতঙ্ক বলেই জানেন সাধারণ মানুষ। আমাজনের গ্রিন অ্যানাকোন্ডার ওজন প্রায় ১৫০ থেকে ২২৭ কেজি। লম্বায় ২৭ থেকে ৩০ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। শীতল রক্তবিশিষ্ট এই প্রাণীটি রাতে শিকারে বের হয়। এই দৈত্যাকার অ্যানাকোন্ডার তেমন বিষ নেই।
এ ছাড়া আমাজনে রয়েছে ব্ল্যাক কেইম্যান কুমির। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কুমির এটি। দৈর্ঘ্যে ৯ থেকে ১৬ ফুট পর্যন্ত লম্বা ব্ল্যাক কেইম্যানের ওজন হতে পারে প্রায় ৪০০ কেজি। আমাজন নদীর সবচেয়ে বড় আকর্ষণ গোলাপি ডলফিন। গোলাপি রঙের ডলফিন মিঠাপানির সবচেয়ে বড় সাইজের ডলফিন। প্রায় সাড়ে আট থেকে সাড়ে নয় ফুট লম্বা এই গোলাপি ডলফিন। এদের মস্তিষ্কের আয়তন মানুষের মস্তিষ্কের চেয়ে শতকরা ৪০ ভাগ বেশি বলে গবেষকদের কাছে গোলাপি ডলফিনের আলাদা গুরুত্ব আছে। আমাজনের অন্যতম প্রাণী হলো পিরানহা। আকারে ছোটখাটো হলেও মাংসাশী পিরানহা খুবই হিংস্র। একঝাঁক পিরানহা যখন একসঙ্গে নদীতে সাঁতরে চলে, তখন তাদের ধারালো দাঁত যে কোনো সাইজের প্রাণীদের মুহূর্তের মধ্যে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে পারে। পিরানহা মাছের চোয়াল এবং দাঁত এতটাই শক্ত এবং ধারালো যে আমাজনের আদিবাসীরা এদের দাঁত দিয়ে হাতিয়ার তৈরি করে। মাত্র ১৮ ইঞ্চি লম্বা পিরানহার প্রায় ৬০ রকমের প্রজাতি শুধু আমাজন নদীতেই দেখা যায়।
আমাজনের ইতিহাস পড়লে জানা যাবে, এই বনের বয়স কম করে হলেও ৩ হাজার বছর হতে চলল। আমাজন প্রাচীনকাল থেকেই অত্যন্ত দুর্গম। অতীতে অভিযাত্রীরা আমাজনে সোনা, রুপা এবং ধন-রত্নের খোঁজে প্রবেশ করতেন। এখনো সেটি অব্যাহত আছে। এই রহস্যঘেরা বনে অফুরন্ত সম্পদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এমনটাই বিশ্বাস মানুষের। যেমন পর্তুগিজ অভিযাত্রীরা বিশ্বাস করতেন, বিশাল এ বনের মধ্যেই কোথাও লুকিয়ে আছে ‘এলডোরাডো’ নামের এক গুপ্ত শহর। ধারণা করা হতো, এই শহরটি পুরোটা সোনার।
সেই সোনার শহরের খোঁজ আজও করছেন অভিযাত্রীরা। অনেকে সোনার শহরের গল্প ভ্রান্ত বলেই মানেন। সোনার শহরের ধারণাটি এসেছে গ্রিক পৌরাণিক গল্প থেকে। সে গল্পে বলা হয়েছে ‘এলডোরাডো’ নামক সোনায় মোড়ানো শহরটি পাহারা দেয় একশ্রেণির বিশেষ নারীযোদ্ধা। যাদের গল্পে ‘আমাজন’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। পর্তুগিজ, স্প্যানিশ এবং ফ্রেঞ্চ অভিযাত্রীরা প্রতিযোগিতায় নামেন এই ‘এলডোরাডো’ শহর আবিষ্কারের জন্য। কিন্তু কেউ এই কাল্পনিক শহরের খোঁজ পাননি। শহরের সন্ধান না পেলেও আমাজনের নামটি স্থায়ী হয় সেই নারীযোদ্ধাদের নামে। তাদের নামানুসারেই এই জঙ্গলের নাম হয় ‘আমাজন’।