ভুডু- এই একটি শব্দই পাঠককে আধিভৌতিক, ভয়ানক এক জগতে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। ভুডু কথাটি শুনলে কবর থেকে উঠে এসে টালমাটাল পায়ে হেঁটে বেড়ানো কিছু জম্বি, পুতুলের গায়ে পিন ফুটিয়ে কাউকে মারাত্মক শাস্তি দেয়ার কিছু প্রথার কথাই শুরুতে মনে পড়ে। আদতে ভুডু কিন্তু এমন রহস্যময়, অশুভ কিছু নয়। বরং ভুডু হলো এমন একটি বৈধ ধর্ম যা আফ্রিকা মহাদেশে জনপ্রিয়তা অর্জন করে দিন দিন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে।
‘ভুডু’ কথাটির অর্থ আত্মা। এই রহস্যময় শব্দের সাথে অনেক গা ছমছমে ভৌতিক ধারণা জড়িয়ে আছে। যেমন নরবলি, রক্তপান ইত্যাদি। অনেকে ভাবে ভুডু মানেই অশুভ কিছু। এটি আসলে নানান আদিম সংস্কার ও কৃত্যের আড়ালে থাকা একটি একেশ্বরবাদী ধর্ম। ভুডু চর্চার উৎপত্তি হাইতিতে। তবে আফ্রিকায় এর চর্চা অনেক বেশি। আফ্রিকার ঘানার আদিবাসীরা ভুডু চর্চায় অনেক বেশি ভরসা করে। ককুজানের অধিবাসীরা এ বিদ্যাটির সাঙ্ঘাতিক অনুরাগী। বছরের পর বছর ধরে এমনটিই করে আসছে তারা।
শোনা যায়, ভুডুবিদ্যার সাহায্যে নাকি কবরের লাশ জ্যান্ত করে তাকে গোলামের মতো খাটানো যায়। নিজের ইচ্ছেমতো তাকে দিয়ে সব ধরনের কাজ করানো যায়। যদিও বিজ্ঞান এমনটি মানতে নারাজ। শামানের কাজ মৃত মানুষের আত্মা নিয়ে। কেননা তারা বিশ্বাস করে আত্মায়। শামানকে কেউ বলে জাদুকর, কেউ কবিরাজ। শামান কথাটি এসেছে সাইবেরিয়ার মেষপালকদের কাছ থেকে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর ভ্রমণকারীরা প্রথম শামানদের ব্যাপারে বিশ্ববাসীকে অবহিত করেন। জানা যায়, শামানরা এমন ধরনের মানুষ, যাদের রয়েছে অবিশ্বাস্য শক্তি। মৃতব্যক্তির আত্মার কাছ থেকে জ্ঞান সংগ্রহ করে তারা। শামানদের প্রধান বাসস্থান এক সময় সাইবেরিয়া হলেও সোভিয়েতদের অত্যাচারে তারা দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়।
শামান বর্তমানে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে উত্তর আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের শহরাঞ্চলেও। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, এমনকি ভারতেও বিস্তৃত। পূর্ব ভারতে সোরা নামে এক উপজাতি আছে, জঙ্গলে বাস করে। এরাও শামান সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী। সোরা উপজাতির লোকেরা মৃতের সাথে কথা বলে। তাদের কোনো দেবতা নেই। আত্মা ছাড়া কোনো দেবতার ওপর তাদের বিশ্বাসও নেই। এরা আত্মাকে বিভিন্ন কাজে লাগায়। ভালো কাজের চেয়ে খারাপ কাজেই বেশি আত্মাদের ব্যবহার করা হয়। তাই ভুডু এক ধরনের অপবিদ্যা। ভুডু অনুসারীরাও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে ভুডুবিদ্যাকে। এদের ধারণা যারা ভুডুবিদ্যা জানে, তারা ইচ্ছা করলেই যাকে খুশি তার ক্ষতি করতে পারে। আত্মা দিয়ে মানুষকে ভয় দেখানো ইত্যাদি অনেক কাজ করাতে পারে। তাই যারা একবার ভুডু অনুসারী হয়, তারা আর সহজে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে না।
শামানরা বলে, আত্মা তাদের সব রোগমুক্তির পথ বাতলে দেয়। যারা এ সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী, তারা বলে শামানদের রয়েছে অলৌকিক ক্ষমতা। এরা আত্মার শক্তিতে বলীয়ান হয়ে স্বাস্থ্য, খাদ্য, উর্বরতা বিষয়ক সব সমস্যারও সমাধান করে দিতে পারে। শামানদের ব্যাপ্তি সাইবেরিয়া থেকে ল্যাপল্যান্ড, টিব্বত, মঙ্গোলিয়া, উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকা (বিশেষ করে আমাজন এলাকায়) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়ও বিস্তৃত। সোরা উপজাতির লোকেদের মধ্যে শামানের ভূমিকা সাধারণত পালন করে মহিলারা। তারা দুই ভুবন অর্থাৎ পৃথিবী ও স্বর্গের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে বলে শামান অনুসারীদের বিশ্বাস। মহিলা শামানকে কবর দেওয়া হয়। এরপর তার আত্মা চলে যায় অন্য ভুবনে। সেখানে মৃত ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে সে। লোকে মহিলাকে কথা বলতে দেখে।
ভুডু ডল বলতে আমরা সাধারণত এমন একটি পুতুলকে জানি, যাকে দিয়ে কালো বিদ্যা করা হয়। জাদুটোনাসহ বিভিন্ন রকম কাজ করা হয়। এমনকি মানুষকে হত্যার মতো জঘন্য কাজও করা হয় ভুডু পুতুল দিয়ে। ভুডুর পুরোহিতের আয়ত্তে রয়েছে অবিশ্বাস্য শক্তি। তবে পুরো ব্যাপারটাই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বে জর্জরিত। পৃথিবীর কেউ কেউ ইচ্ছে করে ভুডু অনুসারী হয়, আবার অনেকেই এটাকে ফ্যাশন হিসেবে আয়ত্ত করতে চায়। তবে কালো চর্চা কখনোই শুভ কিছু বয়ে আনতে পারে না। বর্তমানে হাইতিসহ অন্যত্র আট কোটি মানুষ ভুডু চর্চা করে। এর বাইরে অনেকের কাছে ভুডু হলো শিল্প।