স্টিভেন স্মিথকে মেশিন বললে কি খুব বেশি ভুল বলা হবে? তাঁর ব্যাটিং বিরাট কোহলি কিংবা হাশিম আমলাদের মত দৃষ্টিসুখকর, এই দাবি তিনি নিজেও হয়তো করবেন না। কিন্তু ধারাবাহিকতায় তিনি অনন্য। ম্যাচের পর ম্যাচ রান করে যাওয়ায় তাঁর জুড়ি নেই। কেন তিনি বিশ্বের সেরা টেস্ট ব্যাটসম্যান, গ্যাবা টেস্টে তা আরও একবার প্রমাণ করে দিলেন তিনি।
সেঞ্চুরি তিনি আগেও করেছেন, তবে এই সেঞ্চুরিটিকে হয়তো আলাদাভাবেই মনে রাখবেন তিনি। সেঞ্চুরির পর উদযাপনেও সেটি পরিষ্কার করে দিয়েছেন। হেলমেটের ব্যাজে চুমু খেলেন, শার্টে দলের লোগোতে দুবার পাঞ্চও করলেন। আর ড্রেসিংরুমের দিকে তাকিয়ে যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ দৃষ্টি দিলেন, তার একটিই অর্থ হতে পারে, এই ইংল্যান্ডের সাধ্য কি আমাকে আউট করে!
ইংল্যান্ড পারেওনি। অপর প্রান্তে একের পর এক উইকেট পরেছে, টলানো যায়নি স্মিথের ধৈর্য, চিড় ধরেনি তাঁর মনঃসংযোগ ও নিষ্ঠায়। অধিনায়ক হিসেবে প্রথম অ্যাশেজ টেস্ট খেলতে নেমেছেন, আর কি সুন্দরভাবেই না রাঙিয়ে রাখলেন উপলক্ষটা!
ক্রিজে যখন এসেছিলেন, তাঁর দল তখন বিপদের গন্ধ আঁচ পাচ্ছে, ৩০ রানে হারিয়ে ফেলেছে ২ উইকেট। ৩০২ এর জবাব দিতে নেমে কিছুক্ষণ পরই হয়ে গেল ৩ উইকেট ৫৯, তারও কিছুক্ষণ পর ৪ উইকেটে ৭৬। যেই গ্যাবা অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে নিরাপদ দুর্গ হিসেবে পরিচিত, সেই গ্যাবাতেই তখন প্রথম ইনিংসে পিছিয়ে পড়ার শঙ্কায় অস্ট্রেলিয়া। ১৯৮৮ সালের পর যেই মাঠে প্রতিপক্ষ দল এসে কোন টেস্ট জিতে যেতে পারেনি, সেই গ্যাবাতেই তখন চোখ রাঙাচ্ছে ইংল্যান্ড।
উইকেট বিলিয়ে এসেছেন সবাই, কিন্তু বিচলিত হননি স্মিথ। যোগ্য অধিনায়কের মত দলকে উদ্ধার করেছেন, শেষ পর্যন্ত এনে দিয়েছেন লিডও। স্মিথের ধৈর্যের পরীক্ষা নেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টাই করেছেন প্রতিপক্ষ অধিনায়ক জো রুট, স্মিথ সেই পরীক্ষায় পাশ করে গেছেন লেটার মার্ক নিয়ে। নিজের খেলা প্রথম ৮৯ বলে অফ সাইডে একটি সিঙ্গেল রানও নেননি তিনি, নিজের ব্যাটিংয়ের প্রতি কতটা মনঃসংযোগ থাকলে একজন ব্যাটসম্যানের পক্ষে এটা সম্ভব, সেটা যারা ক্রিকেট বোঝেন তারা একবাক্যে স্বীকার করবেন। এর আগে ধৈর্য হারিয়ে উইকেট বিলিয়ে এসেছেন তাঁর সহ-অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নার, কিন্তু স্মিথের টিকে থাকার ইচ্ছায় বিন্দুমাত্র আঁচড়ও কাটতে পারেনি ইংলিশ বোলার-ফিল্ডাররা। প্রতিটি রানের জন্য সংগ্রাম করেছেন, ধৈর্যের চূড়ান্ত পরীক্ষা নিয়েছেন প্রতিপক্ষের।
অপর প্রান্তে উইকেট ফেলা ছাড়া তাই রুটের হাতে কোন উপায় ছিল না। শেষ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার সবকয়টি উইকেট যখন পড়ল, প্রায় সাড়ে আট ঘণ্টা ব্যাট করে স্মিথ তখনো ১৪১ রানে অপরাজিত! শুধু রানের বিচারে নয়, ইনিংসটি তাই স্মিথ মনে রাখবেন নিজের সাথে নিজের লড়াইয়ে জয়ী হওয়ার কারণে, সব প্রতিকূলতার মুখে অবিচল থেকে দলকে বিপদমুক্ত করার জন্যে।
স্মিথের ইনিংস কতটা সংগ্রামী ছিল, তার সাক্ষ্য দেবে পরিসংখ্যানও। ২৬১ বলে করা সেঞ্চুরিটি স্মিথের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে মন্থর সেঞ্চুরি। এর আগে এই বছরেই রাঁচিতে ২২১ বলে সেঞ্চুরি করেছিলেন ভারতের বিপক্ষে, আজ সেটিকেও হার মানালেন। ২০১০ সালে হ্যামিল্টন টেস্টে সাইমন ক্যাটিচের পর আর কোন অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যান সেঞ্চুরি করতে এত বল খেলেননি, যতগুলো বল স্মিথ খেলেছেন এই ইনিংসে। অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে সবচেয়ে মন্থর সেঞ্চুরির রেকর্ড বিল ব্রাউনের, ১৯৩৮ সালে ট্রেন্টব্রিজ টেস্টে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩১৮ বলে সেঞ্চুরি করেছিলেন ব্রাউন।
স্মিথের অনন্যতা বোঝাতে পরিসংখ্যানের খেলা বাকি আছে আরও। এক জায়গায় স্মিথ ছাড়িয়ে গেছেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যান সহ বাকি সকলকেই। ক্যারিয়ারের প্রথম ৫৭ টেস্ট শেষে স্মিথের চেয়ে বেশি রান করতে পারেননি আর কোন টেস্ট ব্যাটসম্যানই। ৫৭ টেস্ট শেষে স্মিথের রান ৫৫১১, ক্যারিয়ারের প্রথম ৫৭ টেস্ট শেষে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সুনীল গাভাস্কারের, ৫৪৬০। ৫৭ টেস্ট শেষে সবচেয়ে বেশি গড়ের মালিকও স্মিথ, ৬১.২৩। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গড় স্যার গ্যারি সোবার্সের, ৬০.১৪। দ্বিতীয় ইনিংসে যদি ডাক ও মারেন স্মিথ, তাও তিনি স্যার সোবার্সের উপরেই থাকবেন।
আপনি হয়তো ভাবতে পারেন, স্যার ব্র্যাডম্যানের গড় তো ৯৯.৯৬, তাহলে এই তালিকায় স্মিথ সবার উপরে থাকেন কিভাবে? স্মিথই উপরে থাকেন, কারণ ব্র্যাডম্যান টেস্টই খেলেছিলেন ৫২ টি। ৫৭ টেস্টের হিসাবে তাই স্মিথই সেরা!
অধিনায়ক হিসেবে কমপক্ষে ৫ টেস্ট খেলেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে স্মিথের গড় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, ৭২.৪৬। শীর্ষে কে বলতে পারবেন? স্যার ডন ব্র্যাডম্যান! শুধু ব্যাটসম্যান হিসেবে গড়ের অঙ্ক সেঞ্চুরি ছুঁতে পারেনি, অধিনায়ক-ব্যাটসম্যান হিসেবে সে অতৃপ্তি ঠিকই ঘুচিয়েছেন। অধিনায়ক-ব্যাটসম্যান হিসেবে ব্র্যাডম্যানের গড় ১০১.৫১।
এসব সংখ্যার চেয়েও আরও বিস্ময়কর তথ্য, স্মিথ তাঁর ক্যারিয়ার বিশেষজ্ঞ ব্যাটসম্যান হিসেবে নয়, বরং শুরু করেছিলেন লেগ স্পিনার হিসেবে! ক্যারিয়ারের শুরুতে ব্যাট করেছেন ৮ নম্বরেও। সেখান থেকে উঠে এসে এমন রেকর্ডের অধিকারী হওয়া সত্যিই বিস্ময়কর।
৫৭ টেস্ট শেষে শচীন টেন্ডুলকারের সেঞ্চুরি সংখ্যা ছিল ১৩ টি, রিকি পন্টিংয়ের ১১ টি, ব্রায়ান লারা, মাহেলা জয়াবর্ধনে ও রাহুল দ্রাবিড়ের ১০ টি, জ্যাকস ক্যালিস, কুমার সাঙ্গাকারা ও এবিডি ভিলিয়ার্সের ছিল ৯ টি করে। স্মিথের সেখানে কয়টি জানেন? ২১ টি!
বয়স সবে ২৮, সামনে না জানি আরও কি কি বিস্ময় উপহার দেবেন এই বিস্ময় ব্যাটসম্যান!
ক্রিকইনফো অবলম্বনে