১৮৯৫ সালের এক শীতের রাত। লন্ডনের ওপর দিয়ে তখন তীব্র ঠান্ডা বায়ু বইছে। এডলফ বেক গায়ের ওপর চড়ানো পারকাটি আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। তারিখটা ১৬ ছিল সেদিন। এই শীতের রাতে বের হবার কোন ইচ্ছেই ছিল না তার। তবুও বের হতেই হবে। এক অপরিচিত ভদ্রমহিলা তার সাথে দেখা করতে আসছেন। কারণটা একটু অদ্ভুত, তবে বেককে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হবে। তিন হপ্তা আগে এই ভদ্রমহিলাই তাকে নিজের অলংকার চুরির দায়ে অভিযুক্ত করেছেন। তবে এখানেই একটু গোলমাল করে ফেললেন বেক। মহিলা যখন তাকে চোর বলে তারস্বরে চিৎকার শুরু করলেন, বেক উর্ধ্বশ্বাসে পালাতে শুরু করলেন!
অটিলি মেজোনিয়ের নাম্নী এই ভদ্রমহিলা তার পেছনে ততক্ষণ তাড়া করতে থাকলেন,যতক্ষণ না এক পুলিশ অফিসারের সাথে তাদের দেখা হয়। বেককে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয় রচেস্টার রো পুলিশ স্টেশনে। সেখানে ডেইজি গ্রান্ট নাম্নী আরেক ভদ্রমহিলার চুরির অভিযোগের সাথে বেকের সাদৃশ্য খুঁজে পান। এই অভিযোগটি করা হয়েছিল আরো কয়েকমাস আগে। ডাকা হল ডেইজির পরিচারিকাকে। বেককে দেখে সে সাক্ষ্য দিল- হ্যা, এই লোকই আমার মনিবের অলংকার চুরি করেছেন। আশ্চর্যের বিষয়! বেককে আরো সাত সাতটি চুরির দায়ে অভিযুক্ত করা হল।
পত্রপত্রিকায় রীতিমত সাড়া ফেলে দিল সে ঘটনা। বেকের ছবি দেখে আরো মহিলারা জড়ো হতে লাগলেন পুলিশ স্টেশনে। সবাইক বেককে চেনেন এবং বেকের চুরি করার অভিযোগ করতে লাগলেন। একজন হাতের লেখা বিশেষজ্ঞকে ডেকে আনা হল বেকের লেখা পরীক্ষা করবার জন্য। তিনিও সায় দিলেন যে এরকম হাতের লেখা বেক কেবলমাত্র চুরি, জালিয়াতি করবার জন্য ব্যবহার করে থাকে। যার পরিণাম- বেকের সাত বছর কারাদন্ডাদেশ!
১৯০১ সালে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে মাত্র তিন বছর পৃথিবীর আলোবাতাসে মুক্ত বিহঙ্গের মত ঘুরবার সৌভাগ্য হয়েছিল বেকের। আরো নারীরা অভিযোগ হানতে লাগলেন হতভাগ্য বেকের ওপর। সবকিছুই অলংকার চুরির অভিযোগ। বেককে আরো পাঁচ বছর কারাদন্ডাদেশ দেওয়া হয়।
তবে ভাগ্যদেবী বোধহয় এবার প্রসন্ন হলেন বেকের ওপর। মাত্র দশদিন বন্দী অবস্থায় থাকার মাঝেই প্রকৃত অপরাধী ধরা পড়ে। সবাই চমকে উঠলেন। এই ব্যক্তি দেখতে একেবারে বেকের মত! যদিও সে নিজেকে জন স্মিথ বলে পরিচয় দিচ্ছে, তবে তার আসল নাম ফ্রেডেরিখ মেয়ার বলে ধারণা পুলিশের। বেক এবং স্মিথের চেহারার মাঝে এতোটাই মিল যে, তাদের আলাদা করে চেনবার কোন উপায় ছিল না। ১৬ জন নারী বেককে অপরাধী বলে সনাক্ত করেন। যার পরিণাম সাত বছর দশ দিন জেলে থাকতে হয় বেককে। ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৫,০০০ ডলার দেয়া হয় তাকে এবং জন স্মিথকে পাঠানো হয় জেলে।
চাঞ্চল্যকর এই ঘটনা ব্রিটেনের অপরাধীদের প্রতি যেসকল আইন রয়েছে, সেগুলোর ওপর নানা সংশোধন আনে এবং সেখানে বলা হয় এখন থেকে অপরাধীদের শুধুমাত্র প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য অনুসারে গ্রেফতার করা হবে না।
চেহারার মাঝে মিল থাকার কারণে যেখানে এত বিভ্রম, সেখানে বেকের মত নিরপরাধ হতভাগ্যদের রক্ষা করবার জন্যই প্রবর্তিত হয় নতুন আইন। তা নাহলে হয়ত আজো বেকের মত ভাগ্য অনেকের কপালেই জুটত। তাই না?
(ফিচারটি তৈরি করতে সাহায্য করেছে এই সাইট)