২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসের কথা। তাঁকে কেন বিশ্বসেরা অ্যাথলেটদের একজন বলা হয়, সেদিনের মাদ্রিদ ডার্বিতে ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। রিয়ালের বক্সে কর্ণার পেয়েছিল অ্যাটলেটিকো, সেই কর্ণার ক্লিয়ার করে দ্রুত প্রতি-আক্রমণে উঠেছিল রিয়াল। ওই প্রতি আক্রমণকে গোলে রুপান্তর করার জন্য ১০ সেকেন্ডে ৯৬ মিটার দৌড়ে এসেছিলেন রোনালদো ! উসাইন বোল্ট তাঁর রেকর্ড করা দৌড়ে ১০০ মিটার দৌড়েছিলেন ৯.৫৮ সেকেন্ডে, আর রোনালদো ৯৬ মিটার দৌড়েছিলেন ১০ সেকেন্ডে!
গত শনিবার আরেকটি মাদ্রিদ ডার্বি খেললেন রোনালদো, অথচ পাঁচ বছর আগে পরের দুটো ডার্বিতে কত ফারাক! ১৬ মিনিটে মাদ্রিদ বক্সে কর্ণার পেয়েছিল অ্যাটলেটিকো, সেটা ক্লিয়ার করে দ্রুত প্রতি-আক্রমণে উঠেছিল জিদানের শিষ্যরা। লুকা মদ্রিচ দ্রুত বল পাঠিয়েছিলেন সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা রোনালদোকে। বলটা ধরে সামনে এগিয়ে গেলে শুধু অ্যাটলেটিকো কিপারকে সামনে পেতেন রোনালদো। অথচ বল পর্যন্ত পৌঁছাতেই পারলেন না তিনি! ৩২ বছর বয়সী রাইট ব্যাক হুয়ানফ্রান অনেকটা পেছন থেকে দৌড়ে এসে সেই বল ক্লিয়ার করলেন। স্প্যানিশ টিভি গ্রাফিক্স পরে হিসেব করে দেখিয়েছে, হুয়ানফ্রান দৌড়াচ্ছিলেন ঘণ্টায় ৩৩.৮ কিলোমিটার গতিতে, আর রোনালদো ঘণ্টায় ৩২.৮ কিলোমিটার গতিতে।
শুধু এই ম্যাচেই না, এই লা লিগা মৌসুমেই যেন নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন পর্তুগীজ যুবরাজ। প্রথম চার ম্যাচ নিষেধাজ্ঞায় কাটানোর পর এখন পর্যন্ত ৮ ম্যাচ খেলেছেন লীগে, তাতে গোল মাত্র ১টি! ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর নামের পাশে যা বড়ই বেমানান। প্রশ্ন তাই উঠেই গেছে, রোনালদোর হলো টা কি?
২০০৯ সালে মাদ্রিদে যোগ দেয়ার পর এবারই লীগে সবচেয়ে বাজে শুরু করেছেন তিনি। এমন না যে রোনালদো গোলের কাছাকাছি যেতে পারছেন না, ৮ ম্যাচে ৫৫ টি অ্যাটেম্পট করেছেন গোলের, কিন্তু গোলের দেখা পেয়েছেন মাত্র ১ টিতে, কনভার্শন রেট ১.৮%!
তবে বিস্ময়ের মাত্রাটা বেড়ে যায় রোনালদো লা লিগা আর চ্যাম্পিয়ন্স লীগে ভিন্ন রুপ দেখে। চ্যাম্পিয়ন্স লীগে ৪ ম্যাচ খেলে করে ফেলেছেন ৬ গোল, কিন্তু লীগে ফিরলেই যেন গোল করা ভুলে যাচ্ছেন তিনি! গত সাত মৌসুমের ৬ টিতেই লীগে তাঁর কনভার্শন রেট ছিল ১৪% থেকে ১৮% এর মধ্যে, এবার যেন সেই রোনালদোকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না!
আর খেসারত দিতে হচ্ছে মাদ্রিদকে। অ্যাটলেটিকোর সাথে ড্র করে এরই মধ্যে ১০ পয়েন্ট পিছিয়ে পরেছে শীর্ষে থাকা বার্সেলোনার সাথে। লা লিগার ইতিহাসে ১০ পয়েন্ট পিছিয়ে থেকে লীগ শিরোপা জিততে পারেনি আর কোন দল। রিয়াল মাদ্রিদের তাই সর্বপ্রথম দায়িত্ব হওয়া উচিত, রোনালদোর সমস্যাগুলি সবার আগে খুঁজে বের করা। কিন্তু কি সেই সমস্যাগুলি?
সবচেয়ে বেশি যেই সমস্যাটি চোখে পড়ছে, রোনালদো যেন আগের মৌসুমের মত সতীর্থদের থেকে ঠিক অতটা সহায়তা পাচ্ছেন না। আক্রমণে তাঁর দুই সঙ্গীর একজন গ্যারেথ বেল তো বেশিরভাগ সময় ইনজুরিতে মাঠের বাইরেই কাটাচ্ছেন, বিবিসি ত্রয়ীর আরেকজন করিম বেঞ্জেমাও সেই কবে থেকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন নিজেকে। না পারছেন নিজে গোল করতে, না পারছেন রোনালদোর জন্য তেমন কোন সুযোগ সৃষ্টি করতে।
জিদান যেই ৪-৪-২ ফর্মেশনে দলকে খেলাতে পছন্দ করেন, সেই ফর্মেশনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন দলের দুই ফুলব্যাক। গত মৌসুমে রোনালদো যেই ৩৭ গোল করেছেন, তার অনেকগুলোতেই সরাসরি অবদান রেখেছিলেন দুই ফুলব্যাক মার্সেলো ও দানি কার্ভাহাল। এই মৌসুমে মার্সেলোও ঠিক নিজের সেরা ফর্মে নেই, রোনালদো নিষেধাজ্ঞা থেকে ফেরার ঠিক পরপরই ইনজুরিতে পরলেন কার্ভাহাল। দুজনে মিলে এখনো পর্যন্ত একসাথে খেলতে পেরেছেন মাত্র ৩টি লীগ ম্যাচে! কার্ভাহালের বিকল্প হিসেবে খেলেছেন রিয়ালের একাডেমীর খেলোয়াড় ১৯ বছর বয়সী তরুণ আশরাফ হাকিমি, কিন্তু তার সাথে রোনালদোর রসায়নটা খুব বেশি জমেনি।
২০১৫ সালে কোচ থাকাকালীন কার্লো আনচেলোত্তি একটা কথা বলেছিলেন, ‘রোনালদোর ভালো খেলতে হলে পুরো দলকে ভালো খেলতে হবে’। ডিপে নেমে নিজে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খেলার মোড় ঘুরিয়ে দেবেন, অমন খেলোয়াড় আসলে রোনালদো নন। তিনি প্রথাগতভাবে একজন উইঙ্গার হয়ে গোল স্কোরিংয়ের অসাধারণ ক্ষমতা রাখে, এটাই তাঁকে গ্রেট বানিয়েছে। আর সেজন্যই রোনালদোর গোল করার জন্য পুরো দলের সাপোর্টটা দরকার।
এক্ষেত্রে রোনালদোর আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে একটা পেনাল্টিই হতে পারে যথেষ্ট। দুই মৌসুম আগে বার্সেলোনার নেইমারের কথা মনে আছে? মেসি আর সুয়ারেজ মিলে গোলের পর গোল করে যাচ্ছিলেন, শুধু গোল পাচ্ছিলেন না নেইমার। সে সময় তার আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার জন্য পেনাল্টি নেয়ার দায়িত্বটা কিছুদিনের জন্য নেইমারের উপরেই ছেড়ে দিয়েছিলেন মেসি। আর এরপর তো এমএসএন মিলে বার্সাকে ট্রেবলই জেতালেন। বাজে সময় সব স্ট্রাইকারদেরই যায়, দুই একটা গোলই পারে আবার সেই হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দিতে। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, এই মৌসুমে লীগে এখনো পর্যন্ত একটিও পেনাল্টি পায়নি রিয়াল মাদ্রিদ! কে জানে, হয়তো একটি পেনাল্টি গোলই পারে আবার সেই পুরোনো রোনালদোকে ফিরিয়ে আনতে!
ফোর ফোর টু অবলম্বনে