লোক সংস্কৃতি হরবোলা জগতের উজ্জল নক্ষত্র শুভেন্দু বিশ্বাস, যার নামের সঙ্গে আমরা অনেকেই বেশ পরিচিত। ভারতের টিভি চ্যানেল জি বাংলার ‘মীরাক্কেল’, ‘দাদাগিরি’, ইটিভি বাংলার ‘কোলকাতা কোলকাতা’, আকাশ বাংলার ‘সুরের যাদুকর’, বিখ্যাত সংগীত শিল্পী সুমন চট্টোপাধ্যায়ের (কবির সুমন) উপস্থাপনায় তারা বাংলায় সরাসরি প্রচারিত লোক সংস্কৃতি অনুষ্ঠানে আমরা যার অদ্ভুত হরবোল দেখতে পাই তিনি শুভেন্দু বিশ্বাস। বর্তমানে কলকাতার স্থায়ী নাগরিক হলেও তাঁর নাড়ি পোতা আছে কুষ্টিয়ার কুমারখালি পৌর এলাকার বাটিকামারা গ্রামে।
শুভেন্দুর বাবা ডাঃ বিষ্ণুপদ বিশ্বাস ১৯২১ সালে কুমারখালির শহরতলীতে বাটিকামারা অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে তোলেন। নষ্টালজিয়ায় আক্রন্ত হয়ে শুভেন্দু বিশ্বাস গত বছর আসেন জন্মস্থান পরিদর্শনে এবং অল্প কিছুদিন এখানে অবস্থান করেই কলকাতায় ফিরে যান। যখন তার বয়স চার বছর তখন বাবার হাত ধরে চলে যান ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। জন্মভূমির স্মৃতি কিছুই তার মনে ছিল না। দীর্ঘদিন ধরে বাবা মায়ের মুখে শুনে তার আগ্রহ জন্মেছিল জন্মভূমি দেখার প্রতি। বর্তমানে তার বয়স ৭০ বছর। প্রায় আড়াই ঘন্টার এক জম্পেস আড্ডায় তিনি জানান হরবোলা সংস্কৃতি সম্পর্কে। তিনি বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে হরবোল পরিবেশন করে অর্জন করেছেন বেশ খ্যাতি। হরবোল শেখার জন্য ‘হরবোলা শিক্ষা ও নাট্য শিল্পে প্রয়োগ’ গ্রন্থ রচনা করেছেন। এটিই পৃথিবীর প্রথম হরবোলা শেখার গ্রন্থ।
স্ত্রী সুদীপ্তা বিশ্বাস ও দুই সন্তান শীর্ষেন্দু বিশ্বাস এবং সঙ্গীতা দাসকে নিয়ে তার ছোট্ট পরিবার। যখন বয়স চার বছর তখন বাবার সাথে পশ্চিমবঙ্গের খগড়পুরে চলে যান। ওখানে যে জায়গাটায় থাকতেন তার নাম ছিল মালঞ্চ। মালঞ্চ স্কুল থেকে মাধ্যমিক, ঝাড়গ্রাম থেকে টেকনিক্যাল এডুকেশন শেষ করে রাইফেল ফ্যাক্টরীতে পাঁচ বছরের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এ্যাপ্রেন্টিস কোর্স করে কাশিপুর গান এন্ড শেল ফ্যাক্টরীতে এক বছরের ট্রেনিং করে ওখানেই চাকরী শুরু করেন। যদিও পুরো মেয়াদের চাকরী করা তার হয়ে ওঠেনি, মেয়াদ শেষ হবার সাত বছর আগেই স্বেচ্ছাবসর নিয়ে নেন তিনি।
৬৫ বছর পরে জন্মভূমিতে এসে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। জীবনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমন করেছেন, বড় বড় মানুষের সঙ্গে মিশেছেন কিন্তু কুমারখালিতে মতো কোথাও এমন হৃদয়ের টান অনুভব করেননি বলে জানান তিনি। জন্মস্থান কুমারখালির মানুষ তাকে স্বাদরে গ্রহণ করেছেন। তাদের দেয়া হৃদয়ের ভালোবাসা গুছিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন শুভেন্দু। দেশে ফিরে সেটাই ভাঙিয়ে ভাঙিয়ে খাবেন। কুমারখালি প্রেস ক্লাব, শিল্পকলা একাডেমির কাছে তিনি চির কৃতজ্ঞ। বাবার ভিটে, নিজহাতে তৈরি স্কুলের গায়ে হাত দিয়ে তার মনে হয়েছে যেন বাবাকেই দেখছেন নতুন করে। আদি ভিটে থেকে এক মুঠো মাটি নিয়েছেন সাথে। দেশে ফিরে অন্য ভাই-বোনদের দেখাবেন সে মাটি।
হরবোলা সংস্কৃতি সম্পর্কে বেশ কিছু কথা বলেন তিনি। হরবোলা প্রাচীন ঐতিহ্য ও লোক সংস্কৃতি, যা আজ প্রায় লুপ্তি পথে। ১৯৩৫ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শব্দ অনুকরণ শিল্পী রবীন ভট্রাচার্যের শব্দের অনুকরণ শুনে মুগ্ধ হয়ে হরবোলা পাখির (ক্লোরপসিস বার্ড) ডাকের অনুকরণে নাম দিয়েছিলেন হরবোলা রবীন ভট্রাচার্য। একই কন্ঠ থেকে হরেক বোল। জহর রায় ও সুনীল চক্রবর্তীর কাছে হাস্যকৌতুক শেখার পর রবীন ভট্রাচার্যের কাছে অনুকরণ ভঙ্গি শেখা শুরু করেন শুভেন্দু। হাতেখড়ি হয় তার হরবোলা তালিমের। হরবোলা এমনই একটা শিল্প, যার ভাষা বুঝতে কোনো ভাষা ভাষী মানুষেরই অসুবিধা হয়না। একসাথে সকলকেই আনন্দ দিতে পারা যায়। বিদেশী বাজনা আর পপ-সঙ্গীতে ছেয়ে যাওয়া জগত থেকে যখন মানুষ একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচতে চায়, তখন মঞ্চে এসে একজন হরবোলা শিল্পী নির্মল আনন্দে মাতিয়ে দিতে পারেন। দৃষ্টিহীনেরা হরবোলার শব্দের জাদুতে মোহিত হয়ে যায়। এ ব্যাপারগুলোই ঘুরছিল তার মাথায়।
ছোটবেলায় গান গাইতেন শুভেন্দু। ভালো তবলাও বাজাতেন। ১৯৬৮ সালে বয়স উনিশ-বিশ হবে তার। মহাজাতি সদনে গিয়েছিলেন বোনের সাথে তবলা বাজাতে। কিন্তু অনুষ্ঠান শুরু হতে কিছুক্ষণ বাকি। মঞ্চে পর্দা ফেলা। দর্শকাসনে অস্থিরভাব। পরিস্থিতি সামাল দিতে মঞ্চে উঠে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে শোনালেন কুকুরের ঝগড়া করার আওয়াজ, পাখির ডাক, বিড়ালের ঝগড়াটে ভঙ্গি। ব্যাস, দর্শকরা সব চুপ। হাততালিতে চারিদিক কেঁপে উঠল। সামনেই স্বপন বুড়ো’র (অখিল নিয়োগী) ডাক পেলেন। জীব জন্তুর ডাক নকল করে ডাকতে হবে নাটকে, তাই দিল্লীতে যেতে হবে। চিঠিও একটা লিখে দিলেন। শুভেন্দু চলে গেলেন দিল্লিতে। সেই থেকে তবলিয়ার নাম মুছে হয়ে শুভেন্দু হয়ে গেলেন হরবোলা। দিল্লিতে গিয়ে তাকে বাঘের ডাক ডাকতে বলা হলো। জীবন বাঘের ডাকই তাদের শোনালেন শুভেন্দু।
জীবনে প্রথম বেতার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন ১৯৭২ সালে। পরীক্ষা দিয়েই সুযোগ পান আকাশবাণীতে। শিশুমহলে যখন গল্প বলা হতো, তখন তিনি হরবোলা করতেন। এরপর ১৯৭৭ সালে প্রথম কলকাতা দূরদর্শনে অনুষ্ঠান পরিবেশন করেন শুভেন্দু। একবার অনুষ্ঠান করে বম্বে থেকে ফিরছিলেন। টাটা নগর স্টেশন থেকে অনেক লোক একসাথে উঠলো। শুভেন্দুদের প্রায় নামিয়ে দেবার মতো অবস্থা। তিনি তখন বন্ধুকে বলে দিলেন, সকলকে বলবি আমার জলাতঙ্ক হয়েছে। চিকিৎসার জন্য কলকাতায় নিয়ে যাচ্ছে। এই বলে তিনি কুকুরের ডাক ডাকতে শুরু করলেন। তিনি এরকম করছেন কেন সকলেই জিজ্ঞাসা করায়, বন্ধুটি তার কথামতো উত্তর দিল। একজন লোক তাকে আলতো করে মেরে চুপ করতে বলল। কুকুরকে মারলে যেমন বিকট সুরে চেঁচিয়ে ওঠে, শুভেন্দুও তখন তাই করলেন। লোকগুলো ভয় পেয়ে ঝাড়গ্রাম স্টেশনে নেমে পড়লো। ট্রেনের বাকি যাত্রিরা সকলেই খুশি। যে যার মতো বসে পড়ল। এই ভাবে ট্রেনে বসে মাঝে মাঝে এই রকম মজা করেন তিনি। ভিড় বাসে হঠাৎ ডেকে ফেলেন মুরগির ডাক। শুরু হয় লোকের চিৎকার চেচামেচি। সে এক হইচই কান্ড।
হরবোলা নিয়ে জাপান, হংকংসহ অনেক দেশে গেছেন তিনি। সম্মানও পেয়েছেন। জাপানের তোয়েমা থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল থেকে পেয়েছেন স্বর্ণপদক। জাপান দূরদর্শন তার অনুষ্ঠান অনেক সময় ধরে সম্প্রচার করেছে। জাপানের রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ কাজুও আজুমা তার সম্পর্কে লিখেছেনঃ জাপানের কয়েকটি জায়গায় তার একক অনুষ্ঠান দেখেছিলাম। তার অনুষ্ঠান বাংলা থেকে জাপানী ভাষায় তর্জমা করেছিলাম। কানাডার ক্যালগ্রে বিশ্ববিদ্যালয় পারদর্শিতার জন্য তাকে সম্মানিত করেছে। বিদেশের বেশ কিছু ছবিতেও কাজ করেছেন শুভেন্দু।
হরবোলা প্রতিভার স্বীকৃতি স্বরুপ ১৯৮৭ সালে চন্ডীগড় সঙ্গীত নাটক একাডেমী থেকে বিশেষ পুরস্কার দেয়া হয় শুভেন্দুকে। মাঙ্গলিকি, যুদ্ধ নয় শান্তি চাই, ওয়ার্কশপ, পথের পাঁচালী, প্রহরী, গুগাবাবা, বন্যা, সঙ্গীত সম্মেলনসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার ভূমিকাটি ছিল হরবোলা’র। তিনি চান শব্দ, কন্ঠস্বর অনুকরনের এই প্রচীন শিল্প বেঁচে থাক। তাই কলকাতায় গড়ে তুলেছেন হরবোলা অ্যাকাডেমি। নাট্যকার মন্থর রায়ের উৎসাহে ‘হরবোলা শিক্ষা ও নাট্য শিল্পে প্রয়োগ’ নামে একটি বইও লিখেছেন তিনি। এই সাক্ষাৎকার চলাকালীন সময়ে তিনি পাখির ডাক, কুকুরের ডাক, এমনকি রেডিওর চ্যানেল ঘোরানোর হরেক আওয়াজ শোনান। চোখ বন্ধ করলে কোনটা আসল আর কোনটা নকল কিছু বোঝার উপায়ই নেই। খান চারেক পল্লীগীতি শোনান নামী শিল্পীর কন্ঠ নকল করে। তিনি বলেন, বাংলার প্রাচীন লোক সংস্কৃতি আর রবীন্দ্রনাথের নামাঙ্কত হরবোলা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। একে বাঁচানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাব।