E.T. The Extra-Terrestrial, সহজ ভাষায় যেটাকে E.T. বলেই ডাকা হয়, মুভির নাম শোনেননি, এমন মুভিপ্রেমীর সংখ্যা হয়তো হাতে গোণা। এটি ১৯৮২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি আমেরিকান সায়েন্স ফিকশন মুভি যার পরিচালক এবং সহ-প্রযোজক হলেন স্টিভেন স্পিলবার্গ। মুভিটির লেখক হিসেবে মেলিসা ম্যাথিসনকে উল্লেখ করা হয়েছে। ইউনিভার্সাল পিকচার কর্তৃক মুক্তিপ্রাপ্ত এই মুভিটি ছিল ব্লকবাস্টার হিট এবং ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত টানা দশ বছর ধরে ছিল সর্বকালের সর্বোচ্চ আয় করা মুভি। সমালোচকরা ভালো ছাড়া মন্দ বলতে পারেন নি মুভিটা সম্পর্কে। রোটেন টোম্যাটোর জরিপ অনুযায়ী মুভিটার কপালে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সায়েন্স ফিকশনের তকমা এঁটে গেছে আর মেটা ক্রিটিকে এর স্কোর হল ৯৪।
এইই শেষ নয়। প্রিন্সেস ডায়ানা মুভিটা দেখে কেঁদে ফেলেছিলেন, হোয়াইট হাউজে মুভিটা প্রদর্শনের পর প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান আর ফার্স্ট লেডি ন্যান্সি রিগ্যান আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন এবং জাতিসংঘে প্রদর্শনের পর স্পিলবার্গের ঝুলিতে জমা হয়েছে জাতিসংঘের শান্তি পদক।
ভাবছেন, কোন শিরোনাম দেখে কী পড়তে এসে কী পড়ছেন? এতোকিছু বলার কারণ হল, যে মুভিটি নিয়ে এতো মাতামাতি, সেটা কিন্তু প্ল্যাজিয়ারিজমের বিতর্কে কলঙ্কিত। হয়তো অনেকেই ব্যাপারটা জানেন। আর যারা জানেন না, তাদের জন্য সংক্ষিপ্ত পরিসরে কিছু তথ্য উল্লেখ করা হলো আজকের আয়োজনে।
অভিযোগ আছে, মুভিটি বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় রচিত ১৯৬৭ সালের একটি স্ক্রিপ্ট “The Alien” থেকে চুরি করে বানানো হয়েছে। হয়তো “চুরি” শব্দটা বেশী মাত্রায় অশালীন শোনাচ্ছে, কিন্তু প্রকৃত মালিককে কোনো ক্রেডিট না দিয়ে তার আইডিয়া বা কাজকে নিজের বলে চালিয়ে দেওয়া কি চুরি নয়? স্বয়ং সত্যজিৎ বলেছিলেন, “মিমিওগ্রাফ কপির মাধ্যমে আমার লেখা The Alien মুভির স্ক্রিপ্ট যদি হলিউডে ছড়িয়ে না পড়তো, তাহলে E.T. বানানো সম্ভব ছিলো না।”
কিন্তু প্রেস মিডিয়ায় যখন এই বিষয়ে আলোচনা শুরু হলো তখন স্পিলবার্গ সেটা অস্বীকার করে বলেছেন, “সত্যজিৎয়ের স্ক্রিপ্ট যখন হলিউডে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো, তখন আমি নিতান্তই বাচ্চা ছিলাম।” কিন্তু স্পিলবার্গের বক্তব্য নাকচ করে দিয়ে Star Weekend Magazine বলেছে, “১৯৬৫ সালে স্পিলবার্গ গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে ১৯৬৯ সালে পরিচালক হিসেবে হলিউডে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি বাচ্চা ছিলেন বলা যায় না”। কেউ কেউ আবার এও বিশ্বাস করেন, শুধু E.T. নয়, স্পিলবার্গের প্রথম দিককার মুভি Close Encounters of the Third Kindও The Alien এর কাহিনী হতে অনুপ্রাণিত। বিখ্যাত এবং সম্মানিত পরিচালক মার্টিন স্করসিজি এবং রিচার্ড অ্যাটেনবরাও সত্যজিৎয়ের স্ক্রিপ্ট হতে স্পিলবার্গের চুরি শনাক্ত করতে সক্ষম হন।
The Alien ছিল ১৯৬০ সালের শেষের দিকে ভারত-আমেরিকার যৌথ উদ্যোগে প্রস্তাবিত সায়েন্স ফিকশন মুভি, পরবর্তীতে যার বাস্তবায়ন মুখ থুবড়ে পড়ে। মুভিটি পরিচালনা করার কথা ছিল সত্যজিৎ রায়ের এবং হলিউডের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান কলাম্বিয়া পিকচার্স রাজী হয়েছিলো মুভিটি সহ-প্রযোজনা করতে। এটি হতে চলেছিলো সত্যজিৎয়ের হলিউড অভিষেক। মুভির প্রধান চরিত্রে অভিনয় করার কথা ছিল খ্যাতিমান অভিনেতা মার্লন ব্র্যান্ডো এবং পিটার সেলার্সের। কিন্তু সত্যজিৎ অবাক হয়ে আবিষ্কার করলেন, তাঁর রচিত স্ক্রিপ্টটি ইতোমধ্যে মাইক উইলসনের নামে কপিরাইট করা হয়ে গিয়েছে। এই মাইক উইলসন ছিলেন হলিউডে সত্যজিৎয়ের প্রতিনিধি। মাইক স্ক্রিপ্ট রচনায় বিন্দুমাত্র অবদান না রেখেই নিজেকে সহ-লেখক পরিচয় দিয়ে সেটিকে কপিরাইট করে ফেলেন এবং কপিরাইটের টাকা থেকে সম্পূর্ণরূপে সত্যজিৎকে বঞ্চিত করেন। পরবর্তীতে মুভি থেকে মার্লন ব্র্যান্ডোকে বাদ দিয়ে জেমস কোবার্নকে আনার চেষ্টা করা হয়। এসব জোচ্চুরি আর পরিকল্পনায় একের পর এক রদবদল মুভি তৈরীর ব্যাপারে সত্যজিৎয়ের স্বপ্নভঙ্গ ঘটায়। ব্যথিত হৃদয়ে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন।
কলাম্বিয়া পিকচার্স অবশ্য ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ সালের ভেতর বেশ কয়েকবার মুভিটা বাস্তবায়নের কথা তোলে। কিন্তু কোনোবারই সফলতা আসে নি। The Alien মুভিটির জন্য সত্যজিৎ স্ক্রিপ্ট লিখেছিলেন ১৯৬৭ সালে। স্ক্রিপ্টটা ছিল তাঁরই লেখা সায়েন্স ফিকশন গল্প “বঙ্কুবাবুর বন্ধু” এর উপর ভিত্তি করে। এই গল্পটা উনি ১৯৬২ সালে পারিবারিক ম্যাগাজিন “সন্দেশ”-এর জন্য লিখেছিলেন।
সত্যজিতের এজেন্ট হিসেবে কাজ করা মাইক উইলসন পরবর্তীতে স্পিলবার্গের এজেন্ট হিসেবে যোগ দেন। এই লোকই স্পিলবার্গকে সত্যজিৎয়ের আইডিয়া সম্পর্কে ধারণা দেন। তাই ১৯৮২ সালে যখন একই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে E.T. মুক্তি পায় (যে প্রতিষ্ঠানের কথা ছিল The Alien প্রযোজনা করার), অনেকেই হতভম্ব হয়ে মুভির সাথে সত্যজিৎয়ের স্ক্রিপ্টের মিল খুঁজে পান। এদের মধ্যে ছিলেন প্রখ্যাত সায়েন্স ফিকশন লেখক আর্থার সি. ক্লার্কও। মিল খুঁজে পাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হল, পূর্ববর্তী সায়েন্স ফিকশন মুভিগুলোয় এলিয়েনরা সবসময়ই ছিল বিপদজনক প্রাণী। কিন্তু The Alien এর স্ক্রিপ্টে এলিয়েনদের মনোভাব বন্ধুসুলভ দেখানোর প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছিলো। একই কাহিনী দেখা যায় E.T. তে।
এইসব বিতর্কের কখনো মীমাংসা হয় না। বিতর্ক সৃষ্টি হয়, আমজনতা বিষয়টি নিয়ে ভাববার অবকাশ পায় আর দুইদিন পর সেটা ধামাচাপা পড়ে যায়। আপনি নেট ঘেঁটে বহু রেফারেন্স পাবেন এই বিতর্কের কিন্তু কোনো সমাপ্তি পাবেন না। সমাপ্তি নির্ভর করবে আপনারই উপর – আপনি কোন পক্ষের কথা বিশ্বাস করছেন? তবে একদিকে বাঙালি আরেকদিকে সত্য বাবুর গুণগ্রাহীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় শেষ পর্যন্ত হয়তো স্পিলবার্গের হয়ে কথা বলার মতো লোক এ অঞ্চলে খুব একটা খুঁজে পাওয়া যাবে না, তথ্য-প্রমাণও কিন্তু সেদিকেই আঙুল তুলছে।