৫০ বছরেরও বেশি তাঁর ক্যারিয়ারের বয়স। সুধীর মুখার্জীর কমেডি ফিল্ম ‘পাশের বাড়ি’ দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করা সাবিত্রী অভিনয় করেছেন অসংখ্য সিনেমায়। উত্তম কুমারের সাথে জুটি বেঁধে কাজ করেছেন। বর্তমান বাংলাদেশের কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করা গুণী এই অভিনেত্রী ২০১৩ সালে নিজের কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ‘বঙ্গ বিভূষণ’। পরের বছর পেয়েছেন ভারত সরকারের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরষ্কার ‘পদ্মশ্রী’। নিজের ক্যারিয়ার, উত্তম-সুচিত্রা সম্পর্ক, ‘মহানায়ক’ সিরিয়ালের ব্যর্থতা- সবকিছু নিয়েই কথা বলেছেন টাইমস অফ ইন্ডিয়ার সাথে।
উত্তম কুমারের নাট্যদলে যোগ দেয়াটা কিভাবে?
সাবিত্রী চ্যাটার্জী: ভানু বন্দোপাধ্যায় একদিন আমাকে রাসবিহারীতে দেখে নাট্যদলে যোগ দেয়ার প্রস্তাব দিলেন। দলটার নাম ছিল উত্তর সারথি। উত্তম কুমার তখনো উত্তম কুমার হননি, অরুণ কুমার নামেই পরিচিত তখন। একদিন কালিকা থিয়েটারে তিনি আমার রিহার্সাল দেখতে এলেন। উত্তম কুমার এসেছেন শুনে তাঁকে এক নজর দেখতে আমি ছুট লাগালাম। ছুটতে গিয়ে ফার্নিচারের সাথে খেলাম ধাক্কা। ততক্ষণে আমার ডান পা থেকে রক্ত বেরোচ্ছে, কিন্তু উত্তেজনা এক ফোঁটাও কমেনি। আমার জন্য উত্তম কুমারকে দেখতে পাওয়াও তখন বিরাট এক অর্জন। তারপর সেদিন রিহার্সাল শেষ হল, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এসে আমাকে বললেন, উত্তম কুমারের একটা দল আছে, নাম ‘কৃষ্টি ও সৃষ্টি’। তিনি চাইছেন আমি যেন সেই দলে যোগ দেই। আমি বললাম তাঁকে বলুন আমার বাবার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আসতে।
তারপর? অনুমতি পেলেন?
সাবিত্রী চ্যাটার্জী: একদিন কোন কিছু না জানিয়েই উত্তমদা বাড়িতে এসে হাজির। আমাদের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। বালিশগুলো ছেঁড়া-ফাটা, বসার মত জায়গাও নেই। আমার তো খুবই লজ্জা লাগতে লাগলো। আমার বাবা অনুমতি দিলেন, তবে সাথে শর্তও জুড়ে দিলেন। আমাকে থিয়েটারে নিয়ে যেতে হবে, আবার বাড়ি এনে পৌঁছেও দিয়ে যেতে হবে। এরপর ঘটল আরেক ঘটনা। উত্তম’দা উঠতে যাবেন, এমন সময় আমার বাবা কিনা তাঁর কাছে অগ্রিম টাকা চেয়ে বসলেন! আমার তো তখন ‘ধরণী দ্বিধা হও’ অবস্থা। উত্তম’দা পকেট থেকে একটা ৫০ টাকার নোট বের করে আমার বাবার হাতে দিলেন। উত্তম’দা চলে যাওয়ার পর আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম এটা কেন করলে? বাবা বললেন, ‘এমনি এমনি চেয়েছি নাকি? একা হাতে আমি আমার মেয়েদের বড় করিনি? আজ আমার কাছে টাকা চাওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না’। বাবার কথা শুনে আমার প্রচণ্ড মন খারাপ হয়েছিল। সত্যিই তখন আমাদের খাওয়ার টাকাও ছিল না।
‘মহানায়ক’ নামের যে সিরিয়ালটা হল, সেটা নিয়ে আপনি নিশ্চয়ই খুব ক্ষিপ্ত?
সাবিত্রী চ্যাটার্জী: সিরিয়ালটা সম্পর্কে আমি আগেই জানতাম, কারণ এর পরিচালক ছিল বিদিপ্তার স্বামী বিরসা চক্রবর্তী। ওর সাথে আগে দেখা হয়েছে আমার। নতুন ছেলে, অভিশপ্ত নাইটি নামের সিনেমা বানিয়েছিল একটা। বিদিপ্তা বলেছিল একদিন আমায়, সাবুদি, ওরা তো ভালই কাস্ট করেছে, শুধু তোমার চরিত্রের জন্য মন মত কাউকে খুঁজে পাচ্ছে না। আমি জিজ্ঞেস করলাম আরেকটা সাবিত্রী চ্যাটার্জী দিয়ে তোরা করবিটা কি শুনি? তখন শুনলাম ‘মহানায়ক’ এর কথা। প্রসেনজিৎ যে উত্তম কুমারের চরিত্র করবে সেটাও বিদিপ্তার থেকেই শুনলাম। কিছুদিন পরে আমাকে জানালো একটা মেয়েকে পাওয়া গেছে, নামটা এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না। বিদিপ্তা আমাকে বলেছিল মেয়েটার চরিত্র নির্মিত হবে কানন দেবী কিংবা ছায়া দেবীর আদলে। আমাকে বলল তুমি মেয়েটাকে একটু শিখিয়ে পড়িয়ে দিও। অবাক করা বিষয় হল বিদিপ্তা এরপরে আর আমার কাছে আসেনি।
সিরিয়াল শুরু হল, আমিও বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখতে লাগলাম, যেহেতু বিরসা ভালো কাজ করে বলে সুনাম আছে একটা। কিন্তু সত্যি বলতে আমি খুব হতাশ হয়েছি। যা বাস্তবে ঘটেছে সেটা তারা দেখায়নি, কিন্তু যা ঘটেনি সেটা দেখিয়েছে! সুপ্রিয়া, আমি এখনো জীবিত আছি, মাধবীও উত্তম’দার সাথে কাজ করেছে। আমি বুঝলাম না নির্মাতারা আমাদের সাথে একবারও কেন কথা বললেন না! কিছু এপিসোড প্রচারিত হওয়ার পর মমতা শঙ্কর, মাধবী এরা আমাকে বলল তুমি প্রতিবাদ করছো না কেন! এই বুড়ো বয়সে কি আর সারা দুনিয়ার সাথে লড়াই করা যায়!
উত্তম কুমারের স্ত্রী গৌরী দেবীকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, সেটাও তো আপনার পছন্দ হয়নি।
সাবিত্রী চ্যাটার্জী: গৌরী দেবী দেখতে এত সুন্দর ছিলেন, মানুষ উনাকে দুর্গা প্রতিমার সাথে তুলনা করত! সমস্যা একটাই ছিল, উনি ছিলেন খুবই স্পষ্টভাষী। উত্তম’দা আমাকে বলেছিলেন, ভবানীপুরে ওদের দুই বোনকে তিনি গান শেখাতেন। সেখান থেকেই দুজনের প্রেম, এরপর বিয়ে। ‘সুভদ্রা’ মুক্তি পাওয়ার সময় উত্তম’দা বালিগঞ্জে ফার্ন রোডে একটা অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। আমাদের দুজনের তখনো একসাথে কোন কাজ করা হয়নি। তিনি আমার কাছে এসে বললেন, দারুণ অভিনয় করেছো তুমি। আমাদের প্রথম কাজ ছিল ‘লাখ টাকা’, এরপর করলাম ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’। এর মাঝে আমি স্টার থিয়েটারে যোগদান করি। ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’ এ আমি নিয়মিত অভিনয় করতাম, জনপ্রিয়ও হয়েছিল। এসবের কিছুই দেখানো হয়নি ‘মহানায়ক’ এ। আমি নিয়মিত উত্তম’দার বাড়ি যেতাম, গৌরি দেবীর সাথেও আবার ভালো সম্পর্ক ছিল।
তাহলে ‘মহানায়ক’ এ দেখানো সবই কি ভুল?
সাবিত্রী চ্যাটার্জী: আমি এটা দেখা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। স্পষ্ট করেই বলি, আমার মনে হয়না উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেনের মধ্যে কখনো কোন প্রেমের সম্পর্ক ছিল। সুচিত্রা নিজেকে ভালবাসতেন, আর ভালবাসতেন নিজের মেয়ে মুনমুনকে। এমনকি নিজের স্বামী দিবানাথ সেনের প্রতিও সুচিত্রা খুব একটা ভালোবাসা অনুভব করতেন না। সুচিত্রা বেশ মুডি ছিলেন, আমি তাই খুব একটা মিশতাম না। সুচিত্রার সম্পর্কে কোন কিছুই আগেভাগে অনুমান করা যেত না। আজ একরকম, তো কালই আরেকরকম। উত্তম’দা সুচিত্রার প্রতি যত্নশীল ছিলেন এটা সত্য, কিন্তু তাদের মধ্যে প্রেম ছিল না।
‘মহানায়ক’এ নাকি এমন কিছু দৃশ্য ছিল যেগুলোর পুরোপুরি বিরোধিতা করেছেন আপনি?
সাবিত্রী চ্যাটার্জী: সেখানে দেখানো হল, আমার চরিত্রে যেই মেয়েটি অভিনয় করছে, সে কানন দেবীর কাঁধে মাথা রেখে কাঁদছে। কানন দেবী ইন্ডাস্ট্রি থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর আমি ইন্ডাস্ট্রিতে আসি। আমাদের মধ্যে ভাল একটা সম্পর্ক ছিল, কিন্তু আমরা কখনো একসাথে কাজ করিনি। কানন দেবী অভিনয় ছেড়ে দেয়ার অনেক পরে উত্তম কুমারের সাথে আমার পরিচয়। আমি কি করে কানন দেবীর কাছে আমার গোপন কথা বলতে পারি! সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটি হওয়ার পরেও উত্তম-সুচিত্রা জুটি সুচিত্রা নিজেই ভেঙ্গে দিয়েছিল। সুচিত্রা বুঝতে পেরেছিল, জুটিটা জনপ্রিয় হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তার অভিনয় নিয়ে কেউ কথা বলছে না। এ কারণেই ‘দীপ জ্বেলে যাই’ এর মত সিনেমা করেছিল সুচিত্রা।
এরপর বিদিপ্তার সাথে দেখা হয়েছে?
সাবিত্রী চ্যাটার্জী: নাহ। সিরিয়ালে পাওলি দাম আর মিশকা হালিমের অভিনয় ভালো লেগেছে আমার। আমি তো আর সিরিজের প্রযোজক এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারবনা, আমি কাউকেই চিনি না।
সিরিয়ালটার টিআরপি এত কম হল, কি মনে হয় আপনার, কেন এত কম হল টিআরপি?
সাবিত্রী চ্যাটার্জী: আমার মনে হয় দর্শক অন্য কাউকে উত্তম কুমারের চরিত্রে মেনে নিতে পারেনি। ঘটনাগুলো কতটুকু সত্য সেটা নিয়েও হয়তো দর্শক সন্দিহান ছিলেন।